জলবায়ু ইস্যুতেও কি যুক্তরাষ্ট্র-চীন একমত হবে না

সব দেশের সমন্বিত অংশগ্রহণ বৈশ্বিক আধিপত্যবাদকে ঠেকাতে ও বিশ্বকে হুমকির হাত থেকে বাঁচাতে পারবে কি না, তার মোক্ষম পরীক্ষা নিচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন। এ প্রসঙ্গে বলা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলা নিয়েও যদি যুক্তরাষ্ট্র-চীন একসঙ্গে কাজ করতে না পারে, তাহলে নিশ্চিতভাবে তারা আর কোনো ইস্যুতেই এক হতে পারবে না। সারা দুনিয়ার সব দেশ মিলে যে পরিমাণ কার্বন নির্গমন করে থাকে, তার ৪০ শতাংশের বেশি এই দুটি দেশ করে থাকে। অনেকেই মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সহযোগিতা ছাড়া নির্গমন রোধে কোনো অর্থবহ অগ্রগতি অর্জন করা সম্ভব হবে না। এভাবে চলতে থাকলে আমরা সবাই ধ্বংস হয়ে যাব। চীন ও আমেরিকা উভয় দেশই এই কথা ভালো করে জানে। পরিতাপের বিষয়, দুই দেশের বিদ্যমান কূটনীতি জলবায়ু ইস্যুতে কোনো দৃশ্যমান ও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না।

জলবায়ু সম্মেলন যত ঘনিয়ে আসছে, সবুজ জ্বালানি উৎপাদনে কে কতটা এগিয়ে এবং কার্বন নিঃসরণে কার ভূমিকা কতটা কম, তা প্রমাণে উন্নত দেশগুলো ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। তবে এখন পর্যন্ত এটি স্পষ্ট যে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বোঝাপড়া না হওয়া পর্যন্ত কার্বন নির্গমন সমস্যার সমাধান প্রায় অসম্ভব।

জো বাইডেন গদিতে বসার পর আলাস্কায় প্রথমবারের মতো দুই দেশের শীর্ষস্থানীয় কূটনীতিকেরা আলোচনায় বসেছিলেন। সেটি গত মার্চের কথা। সেখানে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন চীনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রসঙ্গ উত্থাপন করায় চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ব্লিঙ্কেনের তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। এর পরের মাসে বাইডেনের জলবায়ুবিষয়ক দূত ও সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি চীন সফর করেন। সেখানে তিনি চীনের জলবায়ুবিষয়ক দূত ঝি ঝেনহুমার সঙ্গে বৈঠক করেন। তারপর থেকে এ পর্যন্ত জন কেরি এবং ঝেনহুমার মধ্যে ১২ বারের বেশি বৈঠক হয়েছে কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো কিছু সেই বৈঠক থেকে অর্জিত হয়েছে কি না, তা স্পষ্ট নয়। বোঝা যাচ্ছে, বিদ্যমান কূটনৈতিক তৎপরতা দিয়ে এই ইস্যুতে দুই দেশকে এক জায়গায় আনা যাবে না।

যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলে তিনটি মৌলিক সমস্যা রয়েছে। প্রথমত, ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প বা নিদেনপক্ষে ‘ট্রাম্পিজম’ ক্ষমতায় আসবে—এমন একটা ধারণা এখনো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মন থেকে বাইডেন প্রশাসন সরাতে পারেনি। দ্বিতীয়ত, বাইডেন প্রশাসন বারবার বোঝাতে চাইছে, চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ক্ষেত্রে অন্য সব ইস্যু থেকে জলবায়ু ইস্যুকে আলাদা করে দেখতে হবে। অন্যদিকে চীন বলেছে, বেইজিং-ওয়াশিংটন সম্পর্কের বিশদ প্রতিবেশ থেকে জলবায়ু ইস্যু কোনোভাবেই আলাদা হতে পারবে না। ফলে এই দুই শক্তির মধ্যে ঝগড়া লেগেই আছে। তৃতীয় সমস্যাটিই সবচেয়ে কঠিন। সেটি হলো আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের পরাজয়ের আগে থেকেই আমেরিকার শক্তিই কাজ করছিল না। একসময় আমেরিকা কোনো হুঁশিয়ারি কিংবা হুমকি–ধমকি দিলে যেভাবে সবাই তটস্থ হতো, এখন আর সেভাবে চীনসহ বড় শক্তিগুলো আমেরিকাকে পাত্তা দেয় না।

আগামী মাসে গ্লাসগোতে জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলন (কপ–২৬) হতে যাচ্ছে। সেদিকেই এখন সবার চোখ। সত্যি বলতে কি, অর্থবহ পরিবর্তনের চালকেরা অন্য কোথাও আছে। জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে বিশ্বের সাড়া সফল হবে নাকি ব্যর্থ হবে, তা দেশগুলোর নিজ নিজ জাতীয় স্বার্থের ওপর নির্ভর করছে। প্রশ্ন উঠছে, আগামী দশকগুলোতে কোন দেশ বা কোন ব্যবস্থা সবুজ বিশ্বের প্রদীপ জ্বালাবে। সবুজ প্রযুক্তি থেকে উদ্ভূত অর্থনৈতিক সুবিধাগুলো কে প্রথম ব্যবহার করবে?

২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং জাতিসংঘে বলেছেন, তাঁর দেশ ২০৩০ সাল নাগাদ কার্বন নির্গমনের সর্বোচ্চ শিখর ছোঁবে এবং ২০৬০ সাল নাগাদ আস্তে আস্তে নির্গমন একেবারে কমিয়ে আনবে। নির্গমন শূন্যে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি হিসেবে একটি সুনির্দিষ্ট সাল তিনি উল্লেখ করেছেন। এ দিক থেকে চীন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। তবে চীনে কার্বন নির্গমন শূন্যে নামানোর জন্য এত বেশি সময় নেবে বলে সে ঘোষণা খুব একটা আশা জাগানিয়া মনে হয়নি।

জলবায়ু সম্মেলন যত ঘনিয়ে আসছে, সবুজ জ্বালানি উৎপাদনে কে কতটা এগিয়ে এবং কার্বন নিঃসরণে কার ভূমিকা কতটা কম, তা প্রমাণে উন্নত দেশগুলো ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। তবে এখন পর্যন্ত এটি স্পষ্ট যে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বোঝাপড়া না হওয়া পর্যন্ত কার্বন নির্গমন সমস্যার সমাধান প্রায় অসম্ভব।

ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

জন কাম্ফনার চ্যাটাম হাউসের একজন কনসালটিং ফেলো