জামানত বাজেয়াপ্তের পরও জয়, আরও অনেক ‘প্রথম’ ঘটনার চমক

জেলে বসেই জিতেছেন কিশোর গ্যাং লিডার হিসেবে পরিচিত নূর মোস্তফা ওরফে টিনু।

গত বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) ১৬ নম্বর চকবাজার ওয়ার্ডের উপনির্বাচনে অনেকগুলো ঘটনা এই প্রথমবারের মতো ঘটল। এই ঘটনাগুলো এখন চট্টগ্রামের নাগরিকদের আলোচনার বিষয়। বলতে গেলে এই উপনির্বাচনই এখন টক অব দ্য টাউন। এ বছর ২৭ জানুয়ারি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে চকবাজার ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন সাইয়েদ গোলাম হায়দার। তিনি মারা যান ১৮ মার্চ।

নির্বাচিত হওয়ার এত কম সময়ের মধ্যে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের কোনো কাউন্সিলর এর আগে মারা যাননি। এমন করুণ ঘটনা এই প্রথম। একটি নির্বাচনের পর ৮ মাসের মধ্যে উপনির্বাচন করতে হলো। এটাও প্রথম। এভাবে অনেকগুলো প্রথম একসঙ্গে মিলেছে এই উপনির্বাচন ঘিরে। একটি কাউন্সিলর পদের জন্য এবার প্রার্থী ছিলেন ২১ জন। এত বেশি প্রার্থী এর আগে দেখা যায়নি। সেটিও প্রথম।

চকবাজার ওয়ার্ডে ৩২ হাজার ৪১ জন ভোটারের জন্য ভোটকেন্দ্র ছিল ১৫টি। বৃহস্পতিবার এই ভোটের কারণে চকবাজার এলাকায় জনজীবনে কোনো প্রভাব পড়েনি। কারণ, কেন্দ্রগুলোতে ভোটাররা যাননি। এমন প্রভাববিহীন ভোট চট্টগ্রামবাসী আগে দেখেনি। তবে ভোটারের উপস্থিতি কম হওয়ার ব্যাপারটিকে প্রথম কিছুতেই বলা যাবে না। বাংলাদেশের ভোটাররা এখন কেন্দ্রবিমুখ। ভোট আসে ভোট যায়, জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হন, কিন্তু জনতা তাতে সম্পৃক্ত হতে চান না।

এবারেও তা-ই ঘটল। আর এই ভোটারবিহীন নির্বাচনে জিতে এলেন কিশোর গ্যাং লিডার হিসেবে পরিচিত কারাবন্দী নূর মোস্তফা ওরফে টিনু। তিনি ভোট পেয়েছেন ৭৮৯টি। এত কম ভোট পেয়ে এর আগে চট্টগ্রামের কোনো ওয়ার্ড কাউন্সিলর নির্বাচিত হননি। এটাও প্রথম। চকবাজারের মোট ভোটারের মাত্র ২ দশমিক ৪৬ শতাংশ ভোট তিনি পেয়েছেন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী মো. আবদুর রউফ মাত্র ১৬ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হয়েছেন।

চকবাজার ওয়ার্ডের এই উপনির্বাচনে সব কজন প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। এর আগে চট্টগ্রামে এ রকম ঘটনা আমরা দেখিনি। একজন বিজয়ী প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়ার ঘটনা এবারই প্রথম ঘটল।

নবনির্বাচিত কাউন্সিলর ঘরে ঘরে গিয়ে ভোট প্রার্থনা করতে পারেননি। নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহণ করতে পারেননি। তিনি দেখেননি ভোট কেমন করে চলছে। কারণ, তিনি কারাগার থেকেই নির্বাচন করেছেন। ২০১৯ থেকেই তিনি কারাবন্দী। সে বছর অক্টোবরে কাপাসগোলার বাসায় অভিযান চালিয়ে একটি পিস্তল, শটগান, ৭২টি গুলিসহ তাঁকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব।

র‍্যাব সে সময় দাবি করেছিল, তিনি নিজের ‘নিয়ন্ত্রণাধীন’ এলাকার ফুটপাত, কোচিং সেন্টার, শপিং মল ও টমটম গাড়ি থেকে সহযোগীদের মাধ্যমে মাসে ৫০ লাখ টাকা আদায় করতেন। র‍্যাবের অভিযোগ, চট্টগ্রাম নগরের পাঁচলাইশ, চকবাজার, বাকলিয়া ও কালুরঘাট এলাকায় তাঁর আধিপত্য। নগর যুবলীগের কোনো পদে না থেকেও তিনি যুবলীগের নেতা বলে পরিচয় দিতেন। গ্রেপ্তারের পর র‍্যাব তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করে। সেই মামলায় তিনি কারাবন্দী আছেন। কারাগারে বন্দী থেকে এর আগে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও জেতেননি। এবার জিতলেন। এটাও প্রথম।

২০১৯ সালে নূর মোস্তফা গ্রেপ্তার হওয়ার পর প্রথম আলোসহ অন্যান্য পত্রিকায় তাঁর কার্যকলাপ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এসব প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, চট্টগ্রাম কলেজ ও সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজে আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্বে নূর মোস্তফার নাম উঠে আসে। চকবাজার এলাকায় নিজের নিয়ন্ত্রণ রাখতে কলেজ দুটিতে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে বহিরাগত ও কিছু ছাত্রকে নিয়ে তিনি প্রতিপক্ষ দল তৈরি করেন। তাঁর দলের সঙ্গে ছাত্রলীগের ৫ বছরে ১৫ বারের বেশি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। তাঁর গ্রেপ্তারের পর চকবাজার এলাকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেছিলেন, নূর মোস্তফার ছেলেদের প্রতিদিন ১০০ থেকে ১৫০ টাকা চাঁদা দিতে হতো তাঁদের। চকবাজার কাঁচাবাজারের পাশে টমটম গাড়ির স্ট্যান্ড থেকেই প্রতিটি গাড়ি থেকে দিনে ৪০০ টাকা করে তুলতেন তাঁর অনুসারীরা।

নূর মোস্তফার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় যেটি অভিযোগ, কিশোর গ্যাংদের ‘বড় ভাই’দের তালিকায় তাঁর নামও রয়েছে। অবশ্য তিনি সব সময় এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। সেগুলোকে ষড়যন্ত্রমূলক বলে অভিহিত করেছেন। সে সময় তিনি আরও বলেছিলেন, সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তিনি প্রার্থী হবেন বলে ঘোষণা দেওয়ায় তাঁর পথ রুদ্ধ করার জন্য এসব অভিযোগ করা হচ্ছে। গত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তিনি কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। কিন্তু সে সময় সাইয়েদ গোলাম হায়দারের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন। কিশোর গ্যাংয়ের বড় ভাই হিসেবে তালিকাভুক্ত কোনো প্রার্থীও এর আগে সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে পাওয়া যায়নি। সুতরাং এটিও প্রথম।

এ রকম অনেকগুলো প্রথম ঘটনায় চট্টগ্রামের নাগরিকদের মনে অনেকগুলো প্রশ্নের উদয় হয়েছে। যে মানুষ দুই বছর আগে অস্ত্রসমেত (র‍্যাবের ভাষ্য অনুযায়ী) গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, যাঁর গ্রেপ্তারের পর এলাকার মানুষের মনে স্বস্তি ফিরে এসেছিল বলে পত্রিকায় খবর বেরিয়েছিল, তিনি কী করে প্রার্থী হন?

অবশ্য তাঁর বিরুদ্ধে মামলা বিচারাধীন। এখনো তিনি দোষী প্রমাণিত হননি। আর যদি দোষী প্রমাণিত না হন, তবে তিনি নতুন দায়িত্ব পালন করবেন। কিন্তু অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হলে, তখন কী হবে? এই সব প্রশ্নের জবাব পেতে চট্টগ্রামবাসীকে আরও বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। তবে অনেকগুলো ‘প্রথম’ ঘটনার চমক এ উপনির্বাচন চট্টগ্রাম শহরে কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন বয়ে আনবে না। বরং তাদের নিরাপত্তার অনিশ্চয়তাকে আরও বহুগুণ যেন বাড়িয়ে দিল।

ওমর কায়সার প্রথম আলোর চট্টগ্রাম কার্যালয়ের বার্তা সম্পাদক।