
‘প্লেন অমন নাচে ক্যান রে ভাই! রাস্তা কি উচা-নিচা নাকি রে!’
মালয়েশিয়া এয়ারলাইনসের বোয়িংয়ে আমরা তখন। তিনি বসে আছেন জানালার পাশে। মাঝে একটা খালি সিটের পরেই আমি। আড়চোখে দেখি তাঁকে। পাকা চুল, চোখেমুখে রাজ্যের ক্লান্তি। বয়স্ক লোকটা এমন রঙ্গ করে কথাগুলো বললেন কাকে! আশেপাশে তাকিয়ে কিছু বুঝতে পারি না। তিনি এখন ফুর্তিতে পা নাচাচ্ছেন, চোখ বন্ধ করে আছেন। তাঁর ক্লান্ত মুখে হালকা হাসি, তার মানে তিনি ভয় পাচ্ছেন না একদম।
মেঘের ধাক্কায় প্লেন থরথর করে কাঁপছে এখনো। আমার আশেপাশে যাঁরা আছেন, এই টার্বুলেন্স তাঁদের মধ্যে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। তাঁরা হইহই করে উঠছেন, ‘ভয় পাইছস নাকি রে’ বলে নিজেরা হাসাহাসি করছেন। আমি তাঁদের দেড় দিনব্যাপী সফরের প্রাণচাঞ্চল্য দেখে অবাক হই। মালয়েশিয়া এয়ারলাইনসের কেবিন ক্রুরা বিরক্ত হন কি না, ভয়ে ভয়ে ভাবি।
একটু আগে কথা বলে জেনেছি, এঁরা অধিকাংশ মরিশাস থেকে ফিরছেন দেশে। মরিশাস থেকে সিঙ্গাপুরে নয় ঘণ্টা ফ্লাইট, সিঙ্গাপুর থেকে মালয়েশিয়া সাড়ে তিন ঘণ্টা, মালয়েশিয়া থেকে এখন তাঁরা ফিরছেন ঢাকায়।
ঢাকাগামী প্লেন মানেই বিমানভর্তি বাংলাদেশি প্যাসেঞ্জার। সবচেয়ে পুরোনো, সবচেয়ে ধ্যারধ্যারে একটা প্লেন হবে সেটা, বিমানবালারা হবেন নির্দয়, খাবার থাকবে শুধু এক রকম, না চাইলে হার্ড ড্রিংকস দেওয়াই হবে না, সিটের পেছনে থাকবে না কোনো হেডরেস্ট ইত্যাদি ইত্যাদি। এ ছাড়া আছে এয়ারপোর্টে, প্লেনে ওঠার সময় এবং ওঠার পরে এয়ারলাইনস-কর্মীদের তাচ্ছিল্যপূর্ণ ব্যবহার। মধ্যপ্রাচ্যের এয়ারলাইনগুলোর তুলনায় মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনে কম তা। কিন্তু মরিশাস থেকে আগতরা যেভাবে হইহুল্লোড় করছেন, তাতে না খেপে যায় এঁরা!
২.
আমার এসব খেয়াল করার কথা না তখন। প্লেনে উঠলে আমি সিনেমা দেখব। দেখবই। তরুণ বয়সে মেঘ আর অপার্থিব আলো দেখে কাটত সময়। এখন সিনেমা। যাত্রাপথে থিব নামে জর্ডানিয়ন একটি ছবি দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। মাত্র কিছুদিন আগে উলফ টোটেম নামে একটি ফ্রেঞ্চ-চায়নিজ ছবিতে মঙ্গোলিয়ার মালভূমি, মানুষ আর নেকড়ে দেখে মঙ্গোলিয়া যাওয়ার প্রতিজ্ঞা করেছি; থিব দেখে মরুভূমি দেখার। প্লেনের খাবার খেয়েদেয়ে মুগ্ধ হওয়ার মতো এমনই কোনো ছবি খোঁজার কথা আমার! কিন্তু আমি অবাক হয়ে হাজার হাজার মাইল দূরে আফ্রিকার অনেক নিচের মরিশাস দ্বীপপুঞ্জ থেকে আসা তরুণদের দেখি। এত দূরে যায়, এত মানুষ; বাংলাদেশ থেকে!
আমি একবার মাসকাট এয়ারপোর্টে বিশাল পলিথিনের পোঁটলা কোমরে ঠেকিয়ে কুণ্ঠিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক দীনহীন নারীকে দেখে কেঁদে ফেলেছিলাম। এঁদের অবস্থা অবশ্য কেঁদে ফেলার মতো নয়। কিন্তু তবু খারাপ লাগে আমার। শুকনো চোয়ালভাঙা অল্পবয়সী এই তরুণেরা কাজ করেন মরিশাসের বিভিন্ন কনস্ট্রাকশন সাইটে; সেখানে সুউচ্চ ভবন নির্মাণের জন্য শ্রমিক হিসেবে। কেউ দুই বছর, কেউ তিন বছর পর দেশে আসার সুযোগ পেয়েছেন। বিমানভ্রমণ নিয়ে কোনো টেনশন বা চিন্তা নেই তাঁদের। টেনশন শুধু ঢাকা এয়ারপোর্ট নিয়ে। ‘মাল’ কি পৌঁছাবে ঠিকমতো ঢাকায়? কাস্টমস কি আটকে রাখবে কিছু? সবচেয়ে বড় টেনশন প্লেন যদি ঠিক সময়ে না পৌঁছায়; বাস না পেলে গভীর রাতে কোথায় থাকবেন তাঁরা?
আমি একটা জাপানি ছবি দেখি কয়েক মিনিট। ট্রাভেল শো কয়েক মিনিট। কিছুই ভালো লাগে না। এমনকি ডি-ক্যাপ্রিওর বহুলপ্রশংসিত ছবি দ্য রেভেন্যান্ট-এও মন বসাতে পারি না। মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনের ক্রু দুপ্রস্থ কাগজ ধরিয়ে দিয়ে গেছেন সবাইকে। একটা ঢাকায় এয়ারপোর্টে ইমিগ্রেশনের জন্য, একটা কাস্টমসের জন্য। আমার পাশের যাত্রী কাস্টমসের চার পাতার ফরম উল্টেপাল্টে অশ্লীল গালি দেন একটা। বলেন, ‘এক পোঁটলা জিনিস, বিবরণ দিতি হবি ১০ পাতা!’
তাঁর পেছনের একজন আরও বিপাকে পড়েছেন এসব ফরম নিয়ে। তাঁকে উদ্ধার করছেন আমার পাশের যাত্রী। তিনি পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে বলছেন, ‘পিতার নাম কী রে, হিলাল?’ হিলাল পেছন থেকে কিছু একটা বলেন। সেটি কি ‘কবীর উদ্দিন’ না ‘খবিরুদ্দিন’ তা নিয়ে কিছুক্ষণ হাস্যরস চলে। কিছু একটা লিখে পার্শ্বযাত্রী আরও জোরে প্রশ্ন করেন, ‘মাতার নাম কী রে, হিলাল!’
কাস্টমসের ফরমের মায়ের নামও লিখতে হয় নাকি! আমি অবাক হয়ে সামনের সিটের পেছনে অবহেলায় গুঁজে রাখা কাগজ বের করে দেখি, ঠিক তাই! সেখানে এমনকি গত পাঁচ বছরে কোন কোন দেশ ভ্রমণ করেছেন, তারও বিবরণ চাওয়া হয়েছে! পার্শ্বযাত্রীটি হিলালকে বলেন, ‘তুই গেলি কেবল মইরশাস! তোরও আবার বিবরণ!’
>ভারতের শ্রমিকের জন্য দূতাবাস আছে; পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা—সবারই তাই আছে। বিদেশবিভুঁইতে বাংলাদেশের মানুষের জন্য কেবল নাই কেউ। তমিজুদ্দিনের কথা সত্যি হলে সেখানে দূতাবাস নামে কিছু একটা আছে বটে, কিন্তু তারাও বাংলাদেশের মানুষের সাথে খারাপভাবে ছাড়া কথা বলে না
এ বছর আমি যে দেশগুলোতে গেছি (জার্মানি, কোরিয়া, ফিলিপাইন, শ্রীলঙ্কা) কোথাও কি কাস্টমসে এমন বিশদ বিবরণ দিতে হয়? ভেবে আমি অবাক হই; ম্যানিলায় নামার সময় তো এমনকি ইমিগ্রেশনের কোনো ফরমও পূরণ করতে হয়নি। মেশিন রিডেবল পাসপোর্টেই তো থাকার কথা সবকিছু। তাহলে আমাদের এত বৃত্তান্তের বালাই কেন! বিদেশে আমাদের শ্রমিক ভাইদের একটা বিরাট অংশ অল্পশিক্ষিত, কেউ কেউ হয়তো অশিক্ষিতও। তাঁদের জন্য কি যে আতঙ্ক আর ভোগান্তি সৃষ্টি করে এসব নিয়মকানুন! আমার চট করে মনে পড়ে, আমাদের বিমানমন্ত্রী না শ্রমিকদের রাজনীতি করতেন, তাঁদের কখনো মনে হয় না এসব!
৩.
আমাদের ফ্লাইট পৌঁছাবে গভীর রাতে। রোজার সময়ের গভীর রাত! তার ওপর ম্যানিলায় আমার হ্যান্ড লাগেজের ওজন দুই কেজি বেশি হওয়ায় বিমানের কার্গোতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন ঢাকায় লাগেজ পাওয়ার দুঃসহ প্রতীক্ষা আমাকেও করতে হবে! আমি বিরসমুখে ইমিগ্রেশন ফরম পূরণ করতে গিয়ে কলম চাই পার্শ্বযাত্রীর কাছ থেকে। তিনি কলম দেন। আমার ফরম পূরণ হওয়ামাত্র তাঁরটাও বাড়িয়ে দিয়ে বলেন, ‘ইটাও করি দ্যান।’ আমি অবাক হয়ে বলি, ‘আপনি না পারেন!’ ‘আরি!’ তিনি তাঁর মাথার পাশে অর্ধচন্দ্রাকারে আঙুল ঘুরিয়ে বলেন, ‘মাথা ধরি যায়!’
আমি তাঁর পাসপোর্ট দেখে নাম লিখি, ‘তমিজুদ্দিন!’ জন্মসাল ১৯৭৭। হতবাক হয়ে দেখি তাঁকে আরেকবার, ‘এই বৃদ্ধ-ভাঙচুরের বয়স ৩৯!’
তমিজুদ্দিন মা-বাপ তুলে গালিগালাজ করেন এসব প্রসঙ্গ তুললে। তাঁকে মরিশাসে নেওয়া হয়েছিল ১০ ঘণ্টা খাটানোর কথা বলে। খাটানো হয়েছে ১৪ ঘণ্টা করে। কোনো ওভারটাইম দেওয়া হয়নি। কোনো দিনই বেতন বাড়ানো হয়নি। তিনি গেছেন নির্মাণশ্রমিক হিসেবে। সেখানে মরিশাসের মালিক মেশিনের খরচ বাঁচান বাঙালি শ্রমিককে দিয়ে ভারী মালামাল বহন করিয়ে। তমিজুদ্দিন কোমরে হাত রেখে মোচড় খান একটু, তাঁর কোমরে তীব্র ব্যথা। এই ব্যথা নিয়ে কাজ করতে পারেন না আর ঠিকমতো। ১৩ মাস কাজ করে ‘৫০’ বছর বয়স বেড়ে গেছে তাঁর!
তমিজুদ্দিন ও আশেপাশের আরও কয়েকজন আমাকে শ্রোতা পেয়ে উগরে দেন নিজেদের। বাঙালি শ্রমিক হলে কম বেতন, বিনা টাকায় ওভারটাইম, লাত্থি-জুতো! অন্য দেশের শ্রমিকদের সঙ্গেও এ রকম ব্যবহার করা হয় না কেন? তমিজুদ্দিন অবাক, ‘কিবা করবে? ইন্ডিয়ান এম্বাসি আছে না! এমন ঠ্যালা দেবে না!’
ভারতের শ্রমিকের জন্য দূতাবাস আছে; পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা—সবারই তাই আছে। বিদেশবিভুঁইতে বাংলাদেশের মানুষের জন্য কেবল নেই কেউ। তমিজুদ্দিনের কথা সত্যি হলে সেখানে দূতাবাস নামে কিছু একটা আছে বটে, কিন্তু তারাও বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে খারাপভাবে ছাড়া কথা বলে না। কখনো কখনো টাকা ছাড়া কাজ করে না, কখনো তো আবার কোনো কাজই করে না। মরিশাসের মালিককে ঠ্যালা দেবে বাংলাদেশের এম্বাসি! ‘ওরে, ওরে!’ বলে তমিজুদ্দিনরা আরও এক পশলা হাসেন।
তমিজুদ্দিন দুবাই গিয়েছিলেন আগে। সেখানে মালিক এত খারাপ ছিলেন না। আট বছর কাজ করে তাঁর কিছু পয়সাপাতি হয়েছিল। তাহলে আবার তিনি মরিশাস গেলেন কেন? তমিজুদ্দিন আমার পীড়াপীড়িতে হঠাৎ লাজুক হয়ে যান। জানান, তাঁর মেয়ের বিয়ের বয়স হয়েছিল। বাপ বিদেশে চাকরি করে শুনলে ভালো ছেলে পাওয়া যায়। তমিজুদ্দিনের মেয়ের তাই হয়েছে। জামাই সিটি করপোরেশনের পিয়ন। ভালো ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে হয়েছে, আর বিদেশে পড়ে থাকা কেন! তমিজুদ্দিন মধুরভাবে হাসেন, ‘কিছু একটা নিয়ে দেশেই বসি পড়ব এখন!’
আমি মুগ্ধ হয়ে দেখি তাঁকে! এই না বাংলাদেশের মানুষ; বাংলাদেশের বাবা! মেয়ের বিয়ে হওয়ামাত্র তমিজুদ্দিন মালিকের নামে মরিশাসে কি একটা অফিসে অভিযোগ করেছেন। মালিক তাঁকে বকেয়া পরিশোধ না করে শুধু প্লেনের টিকিট ধরিয়ে বিদায় করে দিয়েছেন। তাঁর পকেটে এখন ২৬ ডলার মাত্র! সেটা নিয়ে তিনি বাস পেলে মাগুরা যাবেন। না পেলে তাঁর কিছু একটা উপায় করতে হবে! কিন্তু তাঁর প্রধান টেনশন এখন লাগেজ নিয়ে। মেয়ের জন্য কী কী সব কিনেছেন। সেগুলো যদি ‘মারি’ দেয় এখন!
৪.
গভীর রাতে ঢাকা এয়ারপোর্টে বসে আছি। লাগেজ আর আসে না, আসে না! শূন্য কনভেয়ার বেল্টের দিকে আরও শূন্য চোখে তাকিয়ে আছেন লোকজন। কী কী সব ব্যাজ লাগানো লোকজন ঘোরাঘুরি করছেন আশেপাশে! আসল লোক আর আসেন না।
একটু দূরে চেয়ারে বসে অপেক্ষা করছি। বিবিসি স্পোর্টস ওয়েবলিংকে চোখ বোলাচ্ছি। হঠাৎ শুনি উল্লাসধ্বনি। কনভেয়ার বেল্ট অবশেষে ঘুরতে শুরু করেছে। আমাদের ‘মুখ্য-সুখ্য’ শ্রমিকেরা তাতেই খুশি। তাঁদের টাকা লুটপাট করে আমরা তাঁদেরই দিই অনিশ্চিত মধ্যরাত। তবু তাঁরা খুশি!
আমি দূরেই বসে থাকি। তমিজুদ্দিনের মতো মহামূল্যবান কিছু নেই আমার লাগেজে। তাঁর লাগেজ এসেছে। দুই হাত ওপরে তুলে এখন আনন্দ করছেন তিনি।
এই নোংরা শহরে এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য আর কী হতে পারে!
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।