জেগে ওঠো বাংলাদেশ

পাহাড়ধসে দেড় শতাধিক মানুষ মারা যায়
পাহাড়ধসে দেড় শতাধিক মানুষ মারা যায়

পাহাড়ি অঞ্চলে দুঃখজনক ভূমিধসের ঘটনার মধ্য দিয়ে বন ধ্বংস এবং পরিবেশের ওপর এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবের বিষয়টি জাতির মনোযোগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। একই সঙ্গে চূড়ান্ত পরিণতি হিসেবে মানুষের ওপর এর প্রভাবের বিষয়টিও সবার নজরে এসেছে। আমাদের বুঝতে হবে, ভূমিধস যতই দুঃখজনক হোক না কেন, এটা শুধু বরফখণ্ডের চূড়ামাত্র। ব্যাপক কর্মযজ্ঞের মধ্য দিয়ে বনভূমি বাড়ানো না গেলে আরও বড় প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটতে পারে। ভূমিধস ছাড়াও কাপ্তাই বাঁধের ভাটিতে এবং চট্টগ্রামেও ঘন ঘন বিপর্যয়কর ও অনিয়ন্ত্রিত বন্যা দেখা যেতে পারে। এই দুঃখজনক ঘটনা জাতির জন্য সতর্কসংকেত। বাংলাদেশকে জেগে উঠতে হবে, সব নাগরিককে কথা বলতে হবে, কাজও করতে হবে। এখন কাজের সময়।

এ বিষয়টি জাতির মনোযোগে আনতে গণমাধ্যম যে ভূমিকা পালন করেছে, তা প্রশংসনীয়। একইভাবে ওবায়দুল কাদেরের মতো জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী এবং সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারা বন ধ্বংসকে এই ভূমিধসের প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। এ ব্যাপারে জাতীয় পর্যায়ে আলোচনা হচ্ছে, তা-ও উৎসাহব্যঞ্জক।

আমি মনে করি, বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি সম্পদ হচ্ছে মানুষ ও প্রাকৃতিক সম্পদ: ধানখেত, পাহাড়, নদী ও বন।
এগুলোর গুরুত্ব অন্য যেকোনো খাতের চেয়ে বেশি। সে কারণে জাতিকে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে এটা গুরুত্ব দিতে হবে যে গত এক দশকে দেশের ৮৫ ভাগ বনভূমি ন্যাড়া হয়ে গেছে, বিশেষ করে পাহাড়ের।

ভূমিধসের কারণ যে বন ধ্বংস, সে ব্যাপারে একরকম ঐকমত্য গড়ে উঠেছে। তবে এর টেকসই সমাধান বের করতে আমাদের আরও গভীরে যেতে হবে। সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক চাহিদার কারণে বনের ওপর স্বাভাবিকভাবেই চাপ পড়ছে। সরকার যেন সেই ব্রিটিশ রাজের যুগে চলে গেছে। তারা বুঝতে পারছে, বন বিভাগ সৃষ্টির মাধ্যমে বনসম্পদের সুনির্দিষ্ট ব্যবহার ও তার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে, যে বিভাগের কাজ হচ্ছে জাতির বৃহত্তর স্বার্থে বন সম্পদ রক্ষা। এ ছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে বন বিভাগের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করা ভুল হবে।

পাহাড়ের মূল সমস্যা হচ্ছে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় পাহাড়ে সমতল ভূমির মানুষের বসতি স্থাপন। সরকার পার্বত্য অঞ্চলে পাহাড়িদের সংখ্যালঘু বানানোর হীন উদ্দেশ্যে এ কাজ করছে। এই কারিগরিতে কাজ হয়েছে, পাহাড়িরা পার্বত্য অঞ্চলে সংখ্যালঘু হয়েছে, কিন্তু এতে বন ধ্বংসের সূত্রপাত হয়েছে। পাহাড়ের জনসংখ্যা এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে তার পক্ষে সেটা আর ধারণ করা সম্ভব নয়। কৃষি অর্থনীতিতে ভূমির উর্বরতা শক্তির নিরিখে তার জনসংখ্যার ধারণক্ষমতা নির্ধারিত হয়। কথা হচ্ছে জুমচাষের উৎপাদন সমতল ভূমিতে ধান উৎপাদনের তুলনায় একেবারেই নগণ্য। ফলে সমতল ভূমির চেয়ে পাহাড়ের জনসংখ্যা ধারণক্ষমতা খুবই কম। দ্রুত ফসল তোলা যায় এমন অর্থকরী ফসলের অভাবে বিপুল জনসংখ্যার চাপ গিয়ে পড়ে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ওপর। দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা, রাজনৈতিক ও বণিক শ্রেণির কারণে পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়। সে কারণে ভূমিধসের দীর্ঘমেয়াদি সমাধান খুঁজতে হলে এই বাস্তবতা স্বীকার করতে হবে। পাহাড়ের জনসংখ্যার চাপ কমাতে বসতি স্থাপনকারীদের সমতল ভূমিতে ফিরিয়ে আনতে হবে।

ইতিমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ মহলে এই ‘মনুষ্য সৃষ্ট’ পরিবেশগত সমস্যার ‘প্রায়োগিক কৌশলসংক্রান্ত’ সমাধান অনুসন্ধানের আলোচনা হচ্ছে, যেমন বিশেষজ্ঞদের এনে এমন বাড়ি নির্মাণ, যা ধসে পড়বে না। এটা একেবারেই ভুল মনোভঙ্গি। খুব বেশি হলে এটাকে ক্ষীণদৃষ্টিসম্পন্ন বলা যায়, আর সবেচেয়ে খারাপভাবে বললে এটা সমস্যার মূল কারণ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা। এই চিন্তা এখনই পরিহার করতে হবে।

এই দুঃখজনক ঘটনাকে আমরা সুযোগেরূপান্তরিত করতে পারি। নিচের পদক্ষেপগুলো প্রাকৃতিক বনকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনাসহ আমাদের সঠিক পথে রাখবে: ১) এই মুহূর্তে পাহাড়ে সমতলের মানুষের বসতি স্থাপন বন্ধ করতে হবে; ২) সরকারি কর্মসূচির আওতায় এই মানুষদের সমতল ভূমিতে পুনরায় বসতি স্থাপনের ব্যবস্থা করা। তবে এদের অধিকাংশই যেহেতু সরকারের ভর্তুকি পায়, তাই ব্যাপারটা অত্যন্ত ব্যয়বহুল হবে; ৩) শুধু পাহাড় নয়, সারা দেশেই সমন্বিত বনায়ন কার্যক্রম হাতে নিতে হবে; ৪) পুনর্বসতিস্থাপন ও পুনর্বনায়নের জন্য জাতিসংঘের জলবায়ু তহবিলের অধীনে বিদেশি সহায়তা চাইতে হবে।

দীর্ঘ মেয়াদে আমাদের পরিবেশ সুরক্ষা নীতি ও কার্যক্রম আরও সংহত করতে হবে। এর মাধ্যমে যেকোনো বড় কাজের আগে পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা করতে হবে। যথাযথভাবে পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন করা হলে দ্রুততার সঙ্গেই পাহাড়ে অধিক জনসংখ্যার বিপদ চিহ্নিত করা যাবে।

নিকট ভবিষ্যতে আমাদের নীতিগত সমাধান দরকার, প্রায়োগিক কৌশলগত নয়। এ বিষয়ে তর্ক করে সময় নষ্ট করার মতো বিলাসিতা আমাদের শোভা পায় না। আমাদের কাজ করতে হবে, আর সেটা এখনই। আমরা জানি, কী করতে হবে। মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সঠিকভাবেই নীতিগত বিষয়টি চিহ্নিত করেছেন। ওবায়দুল কাদেরের সুনাম আছে, তিনি ব্যবস্থা নিতে পারেন। আমরা আশা করতে পারি, তিনি সহকর্মীদের সঠিক ও সাহসী নীতিগত পদক্ষেপ নেওয়ার গুরুত্ব বোঝাতে পারবেন।

আসুন, সারা দেশেই বড় এক পুনর্বনায়ন কর্মসূচি শুরু করি, আর তা পাহাড় দিয়েই শুরু হোক।

ইংরেজি থেকে অনূদিত

অমিত চাকমা: কানাডার ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির প্রেসিডেন্ট  ভাইস চ্যান্সেলর