
জঙ্গিরা মানুষ খুন করে সরাসরি, সরবে আতঙ্ক ছড়ায়। আর ফরমালিন ব্যবহারকারী খাদ্য ব্যবসায়ীরা আতঙ্কিত করে রাখে নীরবে। এরা নিঃশব্দ ঘাতক। এই ফরমালিন ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে গৃহপালিত বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে পরিচিত রওশন এরশাদ মুখ খুলেছেন।
খাদ্যে ভেজাল বন্ধে সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে যথার্থই প্রশ্ন তুলেছেন রওশন এরশাদ। সংসদের সমাপনী বক্তৃতায় তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী ইচ্ছা করলে খাদ্যে ভেজাল বন্ধ করতে পারতেন। সেই ইচ্ছা তিনি পোষণ করবেন কি না, জানি না।’
খাদ্যে স্বয়ম্ভরতা অর্জন সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যত বেশি গুরুত্ব পেয়েছে, সে তুলনায় খাদ্যে ভেজাল রোধে সরকারকে নির্বিকার বললে কম বলা হবে। অবশ্য রমজান মাসের পবিত্রতা বজায় রাখার ‘স্বার্থে’ কি না জানি না; ওই একটি মাসে মোবাইল কোর্ট আর টিভি ক্যামেরার কল্যাণে বেশ ঠাহর করা যায়, খাদ্যে ভেজাল রোধে বাঙালি জেগেছে!
রওশন এরশাদ বলেন, ‘ফরমালিনের কাঁচামাল কে অ্যালাউ করে? বলেই যাচ্ছি। বকা রাম বলে যায়, কোনো অ্যাকশন হয়নি। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দিলে এগুলো বন্ধ হবে না। এগুলো প্রভাবশালীরা করছে। তারা কারা? জানতে চাই। তাদের কেন ধরতে পারছেন না?’ এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদকক্ষে উপস্থিত ছিলেন। এ কথা শুনে আমার মনে পড়ছে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সেই সিন্ডিকেটের কথা, যাঁরা ছিলেন সংখ্যায় অল্প, কিন্তু নিত্যপ্রয়োজনীয় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পণ্য আমদানির চাবিকাঠি তাঁদের হাতেই থাকত। তাঁরাই পণ্যমূল্যের দাম ওঠানামার নেপথ্যের কারিগর ছিলেন। আমি ধারণা করি, রওশন ইঙ্গিত দিয়েছেন ওই রকম প্রভাবশালীরা সরকারি দলের ছত্রচ্ছায়ায় সক্রিয় আছে।
২০১৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বরে ডেইলি স্টার-এর এক রিপোর্টে বলা হয়েছিল, নতুন বোতলে পুরোনো ফরমালিন। আইনের ত্রুটির সুযোগে একশ্রেণির ব্যবসায়ী ‘প্যারাফরমালডিহাইড’ আমদানি করছেন। এই রাসায়নিক ফরমালিনের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যায়। ২০১২-১৫ সালের আমদানি নীতি শুধরে নির্দিষ্টভাবে ফরমালিন আমদানি নিষিদ্ধ করা হয়। অথচ ফরমালিনের কাজ সারে এমন ক্ষতিকর উপকরণ আমদানির পথ খোলা থাকে। ২০১২-১৩ সালে ১০ হাজার ৩৯৭ টন প্যারাফরমালডিহাইড আমদানি হয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসিউটিক্যাল টেকনোলজির অধ্যাপক এ বি এম ফারুকের সঙ্গে কথা হলো। তিনি বললেন, ফরমালিন ব্যবহারের প্রকোপ কিছুটা কমেছে।
কিন্তু ভেজাল পরিস্থিতির অবস্থা উদ্বেগজনক রয়েছে। তাঁর মতে, ২৫ ধরনের উপকরণ আমদানি হয়, যা দিয়ে ফরমালিনের কাজ সারে। আগে বৈজ্ঞানিক কাজে বছরে ১০০ টন ফরমালিন আমদানির দরকার ছিল, কিন্তু বাস্তবে আমদানি হতো আরও ৪০০ টন বেশি।
এনবিআরের কাস্টমস ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিরেক্টরেটের (সিআইআইডি) বরাতে ডেইলি সান পত্রিকাটি গত ২১ সেপ্টেম্বর এক রিপোর্টে তথ্য দিয়েছে, গত সাড়ে তিন বছরে একটি কোম্পানি তার আমদানি করা প্রায় দেড় হাজার প্যারাফরমালডিহাইডের মধ্যে ৬২৭ টনই খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে। তারা আরও তদন্ত করে দেখছে, ওই সময়ে অন্যান্য কোম্পানির আমদানি করা প্রায় ৩৮ হাজার টন কোথায়, কী কাজে কীভাবে খরচ হয়েছে। ফরমালিন নিষিদ্ধ করতে আমরা ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে আইন পেয়েছি। কিন্তু সেই আইনে ফরমালিন-জঙ্গিদের কতজন শাস্তি পেয়েছে, তা আমরা জানি না। আইনে আছে, অভিযুক্ত ব্যক্তির যাবজ্জীবন সাজা হবে, উপরন্তু জরিমানা দেবে ২০ লাখ টাকা। কিন্তু শুধু জানা যায় না, গত ২০ মাসের বেশি সময়ে কারও যাবজ্জীবন বা উল্লেখযোগ্য কোনো শাস্তি হয়েছে কি না। এমনকি কারও বিচার চলছে তা-ও আমরা জানি না। অধ্যাপক এ বি এম ফারুক, যিনি আশির দশকের গোড়ায় প্রথমবারের মতো দুধে ফরমালিন শনাক্ত করেছিলেন। তিনি বললেন, এখনকার মারাত্মক প্রবণতা হলো কাপড়ের রং খাদ্যে মেশানো। ফুটপাত থেকে বনেদি দোকানের কেক, পেস্ট্রি ও আইসক্রিমে এর ব্যবহার রমরমা। একই গাছে দুই ধরনের পাম অয়েল মেলে। একটি খাবারের ও অন্যটি সাবান তৈরির। সাবানের নামে আমদানি করা বিপুল পরিমাণ কম দামি পাম অয়েল দেশে সয়াবিনে মিশিয়ে বিক্রি হচ্ছে। এই স্বার্থান্বেষী মহলটিই অপপ্রচার চালিয়ে মানুষকে সরিষার তেলবিমুখ করেছে। উল্লেখ্য, ২০০০ সালে দেশে পাম তেল আমদানি ছিল ১ লাখ ৭০ হাজার টন, ২০১৩ সালের মধ্যে তা সাত গুণের বেশি বেড়েছে।
ওপরের চিত্র থেকে এটা অনুমেয়, খাদ্যে ভেজাল বন্ধে সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে যে প্রশ্ন উঠেছে, তার শক্ত ভিত্তি আছে।
আশির দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় বলা হয়েছিল, অপ্রতুল খাবার ও ভেজাল খাদ্যের কারণে ৬০ শতাংশ বাংলাদেশি অপুষ্টির শিকার। এখন খাদ্যে উদ্বৃত্ত দেশ হয়ে আমরা দিন দিন কোথায় যাচ্ছি? ১৯৯৪ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) দেখেছিল, ঢাকার ফুটপাতের ৫২ খাবার বিক্রেতার সবাই বিভিন্ন ধরনের প্যাথজনিক মাইক্রোঅর্গানিজম (এটা যুক্ত খাদ্য দেখতে টাটকা ও খেতেও সুস্বাদু লাগে, কিন্তু তা স্বাস্থ্যের জন্য ভয়াবহ) খাদ্য বেচেন। ২০০৩ সালে ডব্লিউএইচও ঢাকাতেই দেখেছে, ৯৬ শতাংশ মিষ্টি ও ৫৯ শতাংশ আইসক্রিম বিষযুক্ত। এর আগের দশকগুলোতে মহাখালীর ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেলথে (আইপিএইচ) প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা প্রায় ৫০ শতাংশ খাদ্য নমুনাতেই বিষ মিলেছিল। আবার ২০০১ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত আইপিএইচে আসা নমুনাতেও সেই প্রায় ৫০ শতাংশ বিষের ধারা বজায় ছিল বলে এই সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ২০১২ সালের এক রিপোর্টে প্রকাশ করেছে।
তার মানে দাঁড়ায়, আমরা আজও এমন এক জাতি, যাদের অর্ধেকই কমবেশি ভেজাল বা বিষযুক্ত খাবার খেতেই অভ্যস্ত। ২০০৫-০৯ সালে ৩০ লাখ লোকের ডায়রিয়া হয়েছে ভেজাল খাবার খেয়ে। শিশুরা সব থেকে অসহায় শিকার। ভেজাল খেয়ে ২০১১ সালে ১৫ শতাংশ শিশুর মৃত্যুর তথ্যও নিশ্চিত করেছে আইপিএইচ। এর তিন বছর পরে টিআইবি বলেছে, অন্তত ৪৫ লাখ লোক খাদ্যে বিষক্রিয়ায় সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত। অথচ এই দুঃসহ চিত্র বদলে ফেলার কোনো বিশ্বাসযোগ্য অঙ্গীকারও আমাদের কর্ণকুহরে প্রবেশ করে না।
গত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির চার শিক্ষকের প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, খাদ্যে ভেজালকারীদের শাস্তি দিতে আইনের কোনো কমতি নেই। তাঁরা কয়েক ডজন আইনের একটি তালিকা করেছেন, কিন্তু তাঁরা দুঃখ করে বলেছেন, ‘অনেক আইনেরই কোনো যথাযথ প্রয়োগ নেই।’ ক্যানসার সৃষ্টিকারী ফরমালিন নিয়ে খুব হইচই হলো, সুতরাং আমরা একটি কঠোর আইন পেলাম। ব্যস, এরপর দৃশ্যত সুনসান নীরবতা। ওই গবেষকেরা যুক্তরাষ্ট্রের এফডিএর (ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) আদলে আমাদের ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনকে রূপান্তরের যে পরামর্শ দিয়েছেন, তা সরকারের উচিত গ্রহণ করা। কিন্তু তা সহজে হবে বলে মনে হয় না। একটা আন্দোলন লাগবে। হরতাল-অবরোধ চাই না। বর্ধিত আয়ুষ্কাল উপভোগ্য না হলে তা ক্লেশকর বটে। সংবিধান যে জীবনের অধিকার দিয়েছে, তা আনন্দময় ও উপভোগের হতে হবে, বলেছেন ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। এটা কৌতূহলোদ্দীপক, রওশন-দেবর জি এম কাদের ২০১৩ সালে বাণিজ্যমন্ত্রী থাকতে মন্তব্য করেছিলেন, ‘খাদ্যনির্বিষ দেশ গড়তে দরকার যোগ্যতর রাজনৈতিক নেতৃত্ব!’ আমাদের মনে হয় এখন বলার সময় এসেছে, আসুন, নির্ভেজাল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আগে ভেজাল খাদ্য খাওয়া বন্ধ করি!
দেবতা শিব বিষ পান করে নীলকণ্ঠ হয়েছিলেন। তিনি সেই মহাদেব যিনি দেবাদিদেব, দুষ্টের দমনকারী, নীলকণ্ঠ। শিবের নীলকণ্ঠ হওয়া নিয়ে দ্বিমত আছে। কারও মতে, সমুদ্রমন্থনকালে উত্থিত হলাহল বিষ পান করে শিব নীলকণ্ঠ নামে পরিচিত হন। অপরপক্ষে, হরিবংশ পুরাণমতে, বিষ্ণু একবার শিবের গলা টিপে ধরেছিলেন। শিব পালাতে পারলেও তাতে তাঁর কণ্ঠ নীল হয়ে যায়। কিন্তু এ নিয়ে কোনো বিতর্ক চলে না যে, আমরা ডিজিটাল যুগের নীলকণ্ঠ। প্রতিদিন টাটকা সবুজ ফলমূলে থাকা বিষ পান করে আমরা নির্ভেজাল ‘নীলকণ্ঠ’ হই। কেনার সময় সন্দেহ, তবু কেনা থামাই না। কিনি আর খাই। খাই আর কিনি। জার্মান দার্শনিক ফয়েরবাখের একটি বিখ্যাত উক্তি—‘মানুষ তা-ই, যা সে খায়।’ আমরা সেই অর্থে নীলকণ্ঠ মানুষ। নীলকণ্ঠ পাখি দুর্লভ, আমরা সুলভ।
উল্লিখিত জরিপগুলোর ইঙ্গিতমতে, আমরা ১৬ কোটি মানুষের প্রতি দুজনে একজন কমবেশি খাদ্যে মিশ্রিত হলাহল পান করি, বিশ্বে এমন দেশ আর কটি আছে জানি না। তবে রবীন্দ্রনাথ আমাদের সার্থক বাঙালি করে গেছেন—আমি জেনেশুনে বিষ করেছি পান...। অবশ্য তিনি আমাদের সমাজের সচেতন অংশের অনেকের মতো অমরত্ব চাননি, প্রাণের আশা ছেড়েই তবে প্রাণ সঁপেছিলেন।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
[email protected]