টানবাজার থেকে টাঙ্গাইল

টাঙ্গাইল যৌনপিল্লটি মাটির সঙ্গে মেশানোর কাজ প্রায় শেষ l ছবি: কামনাশীষ শেখর
টাঙ্গাইল যৌনপিল্লটি মাটির সঙ্গে মেশানোর কাজ প্রায় শেষ l ছবি: কামনাশীষ শেখর

তাঁরা তিনজনই সোফার একেবারে কিনারায় শরীর ঠেকিয়ে টান টান হয়ে বসে ছিলেন। হাতগুলো কোলের কাছে জড়সড়। ভঙ্গিতে অনিশ্চয়তা, উৎকণ্ঠা। যেন এখনই তাঁদের ছুটে পালাতে হতে পারে।
তাঁরা তিনজনই এত রোগা! যেন কত দিন খেতে পান না। তাঁদের মুখে হতবিহ্বল অসহায়তা লেপ্টে রয়েছে। টাঙ্গাইল শহরের কান্দাপাড়া যৌনপল্লি উচ্ছেদের দিন দশেক পর সে শহরেই এক অফিসে তাঁদের মুখোমুখি হই। বুকের মধ্যে মোচড় দেয়। চেহারাগুলো মনের মধ্যে গেঁথে যায়।
তাঁদের বয়স ২০ থেকে ৩০-এর মধ্যে। পল্লিটিতে ঘর ভাড়া করে থেকে যৌনসেবা বিক্রি করতেন তাঁরা। চলতি মাসের গোড়ায় শুরু হওয়া উচ্ছেদ আন্দোলনের চূড়ান্ত দিনে ১২ জুলাই হুড়োহুড়ি করে পাড়া ছেড়েছিলেন৷ গাঢ় নীল জামা পরা মেয়েটি বলেন, ‘জানের মায়ায় বের হয়ে আসছি।’
সাদা-নীল ছাপা শাড়ি পরা মেয়েটি জানান, বিকেলে একদল লোক দুই ঘণ্টার মধ্যে পাড়া না ছাড়লে পেট্রল ঢেলে পুড়িয়ে মারার হুমকি দেয়। বিদ্যুতের সংযোগ কেটে দেওয়া হয়। তাঁর সম্পদ একটি জাজিম, তিনটি তোশক, দুটি বৈদ্যুতিক পাখা আর কয়েকটা হাঁড়ি-পাতিলের কিছুই সঙ্গে আনতে পারেননি। তাঁর শিশুসন্তানকে এক আত্মীয়ের কাছে ছেড়ে এসে নিজে রাস্তায় রাস্তায় তাড়া খেয়ে বেড়াচ্ছেন। তারই মধ্যে ‘লোকজন করে’ পেট বাঁচানোর ধান্দা। রাস্তায় নাকি আরও অনেক মেয়ে উঠেছেন।
দিনে তাঁরা তিনজন একটি এনজিওর দিবা-আশ্রয়কেন্দ্রে ওঠেন। রাতে পথেই কাজ করে খোলা বারান্দায় ঘুম। তাঁরা বলেন, রাতে ছেলেরা তাড়া করে, মারধর করে। সন্তানসম্ভবা এক যৌনকর্মীকে মেরে পা ফুলিয়ে দিয়েছে। নীল-জামা জানান, সারা রাত ঘুরে হয়তো ৫০ থেকে ১০০ টাকা আয় হয়। গত রাতে তাঁর গলায় ছুরি ঠেকিয়ে টাকা কেড়ে নিয়ে গেছে মহল্লার মাস্তানেরা। ধর্ষণের শিকারও হতে হয়েছে। ছোটবেলায় মাকে হারিয়েছেন, এ কথা বলতে গিয়ে গলাটা তাঁর বুজে আসে।
এই তিনজনের মুখ চোখের সামনে থেকে সরছে না। অনেক দিন আগে এক বন্ধুর মুখে শোনা গানটি মাথার মধ্যে ঘুরছে—‘শরীর বেচি, শরীর বেচি, শুনেন ভদ্রজন/ রাতের নায়ক যারা, তারাই দিনের বিচারক/ জীবনটারে কোন জীবনে থুই, ভাঙাচোরা মন...।’
১৫ বছর আগের একটি দৃশ্যও চোখে ভাসছে। ২৪ জুলাই ১৯৯৯। শেষ রাতের অন্ধকারে সরকারের বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তারা আর কয়েক শ পুলিশ উচ্ছেদ করেছিল নারায়ণগঞ্জের টানবাজার ও নিমতলি যৌনপল্লি। সকালে টানবাজারে সুনসান বাড়িগুলো ঘুরে দেখছিলাম। ভেতর দিকের একটি ঘরে এক খোপে একটি মেয়ের দেখা পাই। তিনি রাতে জ্বরে বেহুঁশ ছিলেন। উচ্ছেদ ও ধরপাকড়ের তাণ্ডব টের পাননি। সকালে কবরের নীরবতায় জেগে ওঠে নিজের তছনছ হয়ে যাওয়া জগৎ দেখছিলেন। তাঁর দৃষ্টির শূন্যতা ভোলার নয়।
টানবাজার উচ্ছেদের নেপথ্যে ছিলেন নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের তৎকালীন সরকারদলীয় সাংসদ শামীম ওসমান (বর্তমানেও সাংসদ তিনি)। পুনর্বাসনের নাম করে উচ্ছেদের সেই যজ্ঞে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের আশীর্বাদ ও সক্রিয় সমর্থন ছিল। সাংসদের মূল উদ্দেশ্য ছিল, যৌনপল্লির বিএনপিপন্থী বাড়িওয়ালাদের আর্থিক কোমর ভেঙে দেওয়া।
১৫ বছর পর আরেক জুলাইয়ে টাঙ্গাইলের যৌনপল্লিটি উচ্ছেদের নেপথ্য নায়ক হিসেবে যাঁর এবং যাঁদের নাম নানা মহলে গুঞ্জরিত, তাঁরাও সপরিবারে সরকারি দল করেন। তাঁরা হচ্ছেন পৌর মেয়র সহিদুর রহমান খান ওরফে মুক্তি (শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক) এবং তাঁর ভাই জাহিদুর রহিম খান কাঁকন (জেলা ব্যবসায়ী ঐক্যজোটের সাধারণ সম্পাদক ও চেম্বারের সভাপতি)। টাঙ্গাইল-৩ আসনের সাংসদ ও জেলা আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক আমানুর রহমান খান ওরফে রানা তাঁদেরই আরেক ভাই। আরও এক ভাই সানিয়াত খান ওরফে বাপ্পা বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি৷
খান ভাইয়েদের পৈতৃক বাড়ি কান্দাপাড়া যৌনপল্লির গা ঘেঁষে। বারান্দা ও ছাদ থেকে পাড়াটি স্পষ্ট চোখে পড়ার কথা।
২৩ জুলাই সকালে গিয়ে দেখা যায়, তিন একর (৩০২ শতাংশ) আয়তনের পাড়াটি মাটির সঙ্গে মেশানোর কাজ প্রায় শেষ। বাদ পড়েনি যৌনকর্মীদের ধর্মীয় আচার–অনুষ্ঠানের কেন্দ্রস্থল ‘মা ফাতিমার মন্দিরে’র চত্বরও। উঁচু সীমানাপ্রাচীরের ভেতরে মজুরেরা ইতস্তত বাড়িঘর ভাঙছেন। কে তাঁদের কাজ করাচ্ছেন? কয়েকজন বলেন, বাড়িওয়ালা। কয়েকজন চুপ।
ইট-সুরকির ধ্বংসস্তূপে অবহেলায় পড়ে রয়েছে হাসিমুখ নায়কের সঙ্গে একটি মেয়ের কারসাজি করা ছবি—একটি স্বপ্নের অবশেষ। কয়েকটি আধভাঙা ঘরের সামনে

একপাটি হিলতোলা জুতা, বাচ্চার পায়ের জুতা আর ছেঁড়া কনডম।
শ-দেড়েক বছর বয়সী এই যৌনপল্লিতে বেসরকারি সংস্থা এইচআইভি/এইডস অ্যালায়েন্স বাংলাদেশের (হাসাব) একটি স্বাস্থ্যসেবা প্রকল্প চলত। গত জুনে করা তাদের জরিপ বলছে, এখানে ৮০৪টি কক্ষে ৬২২ জন সক্রিয় যৌনকর্মী ১২৯টি শিশুসন্তানসহ
থাকত। সাবেক যৌনকর্মী বা মাসি, নিয়মিত সঙ্গী বাবুসহ বাসিন্দার সংখ্যা ছিল হাজার খানেক। কান্দাপাড়ার যৌনকর্মীদের সংগঠন নারী মুক্তি সংঘের হিসাবে বাসিন্দার সংখ্যাটি আরও বড়।
পাড়ার জমি ব্যক্তিমালিকানার। পৌরসভার তালিকা অনুযায়ী, ৬৮টি হোল্ডিংয়ে বাড়িওয়ালার সংখ্যা ৬৩। তাঁদের প্রায় ৪০ জন সাবেক যৌনকর্মী নারী। পুরুষ বাড়িওয়ালাদেরও সংখ্যাগরিষ্ঠ যৌনকর্মীদের আত্মীয়। অনেক বাড়িওয়ালা শহর ও শহরতলিতে বাড়ি করে থাকতেন। দৈনিক ভাড়া তুলতেন; ঘর তথা যৌনকর্মীপ্রতি ২০০ থেকে ৩০০ টাকা বা আরও বেশি।
২২ জুলাই রাতে শহরের কয়েক কিলোমিটার দূরে গিয়েছিলাম কয়েকজন বাড়িওয়ালার খোঁজে। গিয়ে দেখি থমথমে আতঙ্ক। এলাকাবাসী কোনো ভাড়াটেকে আশ্রয় দিতে দিচ্ছে না, বাড়িওয়ালাদেরও কাউকে কাউকে তাড়িয়ে দিচ্ছে। শহর থেকে ‘ছেলেপিলে’ গিয়েও মানবাধিকারকর্মীদের কাছে মুখ না খুলতে শাসিয়ে এসেছে।
উচ্ছেদ-আন্দোলন শুরু হয়েছিল ১ জুলাই ‘টাঙ্গাইল অসামাজিক কার্যকলাপ প্রতিরোধ কমিটি’ গঠন করে। কমিটির সভাপতি আলহাজ মাওলানা আবদুল আজিজ হেফাজতে ইসলামের জেলা আমির। সদস্যরা মূলত বিভিন্ন মসজিদ-মাদ্রাসার আলেম-মুনসি। (টানবাজার উচ্ছেদেও এমন একটি ‘নাগরিক কমিটি’ সামনে ছিল।) এ কমিটি ৬ জুলাই পৌর মেয়রের কাছে ‘দেহব্যবসাকেন্দ্র’ অবিলম্বে বন্ধ করার দাবিতে স্মারকলিপি দেয়। ১০ জুলাই থেকে কিছু লোক যৌনকর্মীদের ভীতসন্ত্রস্ত করে রাখে। ১২ থেকে ১৩ জুলাই সকালের মধ্যে আতঙ্কিত বাসিন্দারা পল্লি ছাড়ে। পরদিন থেকে চাপের মুখে বাড়িগুলো ভাঙা শুরু হয়৷
এদিকে যৌনকর্মী, নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ, এমনকি খোদ প্রশাসনের কর্মকর্তারাও একান্তে বলছেন, এ আন্দোলনের পেছনের শক্তি পৌর মেয়র ও তাঁর ভাই-বেরাদরেরা। ঠারেঠোরে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হচ্ছে মেয়র এবং তাঁর ভাই কাঁকনের নাম। ভয়-সন্ত্রাস যাঁরা সৃষ্টি করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছানোয়ার হোসেন ওরফে ছানু (জেলা যুবলীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক) ও নাছির উদ্দিন নূরুর (জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক) নাম আসছে বেশি। তাঁরা মেয়রের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত।
প্রতিরোধ কমিটির সহসভাপতি আলহাজ মো. বাদশা মিয়ার চামড়ার আড়ত যৌনপল্লির ঘরের দুয়ারে। কথিত আছে, তোড়া বাড়িওয়ালির কবরের ওপর। মেয়রের সংশ্লিষ্টতার কথা বাদশা একবাক্যে নাকচ করে দিলেন। বললেন, ১৩ জুলাই সকালে তিনি ছানু ও নূরুকে পল্লির সামনে দেখেছিলেন। তবে তাঁরা নাকি মেয়েদের হেফাজত করার জন্য গিয়েছিলেন। বাদশার কথা, কোনো হুমকি-ধমকি হয়নি, বাড়িওয়ালারা নিজেরাই ঘর খালি করে চলে গেছেন।
এদিকে প্রশাসনের ওপরের দিকের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সাংবাদিকেরা নারায়ণগঞ্জ আর ওসমান
ভাইদের নিয়ে মাতামাতি করেন কিন্তু শামীম ওসমানও নাকি খান ভাইদের কাছে শিশু। তারপর পৌরসভার দিকে যাত্রাকালে শহরজুড়ে সাঁটা নেতা তিন ভাইয়ের পোস্টারগুলো মন দিয়ে দেখলাম।
মেয়রের সঙ্গে সাক্ষাৎকারটি হলো বড় চমৎকার। ফিনফিনে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরা মেয়র কথা বললেন গালে টোল-ফেলা মধুর হাসিমুখে। তিনি জানান, অভিযোগগুলোর কোনো সুযোগই নেই, কেননা মেয়েরা স্বেচ্ছায় পেশা বদল করতে পাড়া ছেড়েছেন। প্রশাসনের ওই কর্মকর্তাটি আর যৌনকর্মীসহ অনেকেই মনে করছেন, উচ্ছেদ আসলে হয়েছে শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত পল্লিটির দামি জমি দখলের জন্য। মেয়র এ কথা শুনেও হতবাক হলেন।
এর আগে অভিযোগগুলো উড়িয়ে দিয়েছিলেন মেয়রের ঘনিষ্ঠ এক ব্যক্তি, যিনি আবার সাবেক যৌনকর্মী এক বাড়িওয়ালির স্বামী। তিনি তাঁদের ৫৩টি ঘরের দৈনিক বাড়িভাড়া (১০ হাজার টাকার বেশি) হারিয়ে শোকে কাতর ছিলেন। তবে বললেন, সামনে অবশ্যই জমি ফেরত পাবেন। অন্য বাড়িওয়ালা যাঁদের সঙ্গে কথা বলা গেছে, তাঁরা অবশ্য ভরসা পাচ্ছেন না। বাড়িওয়ালিরা বিশেষ করে শঙ্কিত।
বাড়িওয়ালি আর সরদারনি—যাঁরা মেয়ে খাটিয়ে খেতেন—তাঁদের তবু কিছু একটা কিনারা হয়তো হবে। কিন্তু একেবারেই সাধারণ যে যৌনকর্মীরা দারিদ্র্য, অপরাধ আর নানা রকমের শোষণে পর্যুদস্ত জীবনই কাটাতেন, তাঁরা হয়তো একেবারেই ভেসে গেলেন। নীল ছাপা শাড়ি মেয়েটি যেমন বলছিলেন, ‘এইভাবে জীবন পালন করা যায় না। কুত্তার জীবনও এর চেয়ে ভালো।’
উচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার আগেও তাঁরা প্রশাসন বা এনজিও-মানবাধিকারকর্মী দরদিদের কাউকেই যে কার্যকরভাবে পাশে পাননি! পুরো প্রক্রিয়াটি নাকি জেনে-বুঝে ওঠার আগেই সম্পন্ন হয়ে গেছে!

কুররাতুল-আইন-তাহমিনা: সাংবাদিক।