
‘গেটলক, গেটলক’ বলে চিৎকার করছিল হেলপার, বাসটির খোলা দরজায় দাঁড়িয়ে। দিনাজপুর থেকে ছেড়েছে, পথ মাত্র ৪৫ কিলোমিটারের। কিন্তু ঠাকুরগাঁও পৌঁছতে পৌঁছতে পেরিয়ে গেল দেড় ঘণ্টা। কারণ ‘গেটলক’ বাসের দরজা একবারও বন্ধ হয়নি, সারাটা পথে ‘গেটলক, গেটলক’ বলে চেঁচিয়ে যাত্রী তোলা হয়েছে। বেলা সাড়ে ১১টায় ঠাকুরগাঁওয়ে নেমে রোদে চারপাশে তাকিয়ে মনে হলো, কোন অজ-মফস্বলে এসে নামলাম!
তারপর থেকে প্রথম আলোর ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি মজিবর রহমানের মোটরসাইকেলের পেছনে বসে রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত প্রায় সারা শহর ঘুরে বেড়িয়ে, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা ও বোঝার চেষ্টা করলাম, পাঁচটি উপজেলার ১ হাজার ১৬টি গ্রামের প্রায় ১৪ লাখ অধিবাসীর এই জেলার প্রশাসনিক কেন্দ্র ঠাকুরগাঁওয়ের মানুষের মনে কোনো দুঃখ-বঞ্চনার বোধ আছে কি না। কেননা, শহরটির চেহারা মলিন, জেলা শহর বলে মনে হয় না। ঠাকুরগাঁও যেন সেই কবেকার এক প্রান্তবর্তী মহকুমা শহরই রয়ে গেছে (দিনাজপুর জেলার একটি মহকুমা ছিল, জেলায় উন্নীত হয়েছে ১৯৮৪ সালে)।
এ জেলার প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষের জীবিকা কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ত। কিন্তু প্রায় ৩০ শতাংশ কৃষক ভূমিহীন; কৃষক নয়, আদতে তাঁরা কৃষিশ্রমিক, অন্যের জমিতে দিনমজুরি করে সোনার ফসল তুলে দেন বড় বড় গৃহস্থের গোলায়। এই ভূমিহীন খেতমজুরদের উদয়াস্ত পরিশ্রমেই ঠাকুরগাঁও জেলায় উৎপাদিত হয় প্রায় ৩ লাখ মেট্রিক টন উদ্বৃত্ত খাদ্য। কলকারখানা বলতে আছে গোটা তিরিশেক চালকল, অধিকাংশই হাসকিং (তুষ ছাড়ানো যন্ত্র), সাকল্যে চার-পাঁচখানা অটোরাইস মিল, আর আছে কিছু ইটের ভাটা। এখানে একবার একটা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা (ইপিজেড) গড়ে তোলার প্রকল্প শুরু হয়েছিল, জমি অধিগ্রহণের কাজও আরম্ভ করা হয়েছিল। কিন্তু লোকজন জমি দিতে রাজি না হওয়ায় ইপিজেড প্রকল্পটি স্থানান্তর করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে নীলফামারী জেলায়। গোটা জেলায় মাধ্যমিক ও তার ওপরের স্তরের শিক্ষার জন্য সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে মাত্র পাঁচটি। ঠাকুরগাঁও শহরে অবস্থিত ছেলে ও মেয়েদের জন্য পৃথক দুটি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মোটামুটি মানসম্পন্ন পড়াশোনা হয়, সে কারণে গোটা জেলার অভিভাবকেরা এ দুটি বিদ্যালয়েই সন্তানদের ভর্তি করানোর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থাকেন। ভর্তিযুদ্ধে সাড়ে চার শ আসনের জন্য প্রচণ্ড প্রতিযোগিতা চলে সাড়ে ৩ হাজার শিশু শিক্ষার্থীর মধ্যে। এ জেলায় চিকিৎসাবিজ্ঞান ও প্রকৌশলবিদ্যা শিক্ষার জন্য কোনো প্রতিষ্ঠান নেই, অবশ্য একটি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট আছে।
শনিবার সন্ধ্যায় ঠাকুরগাঁও চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মো. মোদাচ্ছের হোসেনের সঙ্গে তাঁর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের চেম্বারে আলাপের একপর্যায়ে তাঁকে জিজ্ঞাসা করি, গত দু-তিন দশকে ঠাকুরগাঁওয়ের কী উন্নতি তিনি লক্ষ করেছেন। উত্তরে প্রথমেই বললেন, আগে আশ্বিন-কার্তিক মাসে কাজের অভাবে যে মঙ্গা দেখা দিত, এখন আর তা নেই। এখন আর এমন কোনো মানুষের দেখা মেলে না যে দুবেলা খেতে পায় না। এটা একটা বড় অগ্রগতি বলে তিনি মনে করেন। তবে, মানুষের মৌলিকতম কিছু চাহিদা পূরণ ছাড়া বড় ধরনের কোনো উন্নতি এ জেলায় ঘটেনি। শিক্ষার হার বেড়েছে, কিন্তু মান বাড়েনি, বরং কমেছে। এ জেলায় ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের খুবই অভাব। কলকারখানা নেই, কর্মসংস্থান, আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগও বাড়েনি। বিপুলসংখ্যক মানুষ দিনমজুর হিসেবে খেতে কাজ করে, তাদের মজুরি বেড়েছে বটে, কিন্তু দিন আনা দিন খাওয়ার চক্র তারা পার হতে পারেনি। প্রান্তিক চাষি, যাদের দু-চার বিঘা জমি আছে, তারা ক্রমে ভূমিহীন হয়ে যাচ্ছে, কারণ মেয়ের বিয়ে দিতে কিংবা বড় কোনো অসুখ-বিসুখ হলে তাদের জমি বিক্রি করতে হয়। এ জেলায় যৌতুক প্রথা অত্যন্ত বেশি। ঠাকুরগাঁও শহরে দেখবেন প্রচুর মোটরসাইকেল, আমার জানামতে সংখ্যাটা প্রায় ৩০ হাজার; এগুলোর অধিকাংশই যৌতুক।
অবসরপ্রাপ্ত কলেজশিক্ষক কামরুল আলম চৌধুরী বললেন, ঠাকুরগাঁও সবদিক থেকেই দেশের অন্যান্য জেলার থেকে পিছিয়ে আছে। এটা একটা অবহেলিত, বঞ্চিত জেলা। জিজ্ঞেস করলাম, ঠাকুরগাঁওয়ের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন কিসের? তিনি বললেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের। একটা মেডিকেল কলেজ দরকার, দরকার একটা ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট, একটা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় হলে খুব ভালো হয়। আর দরকার ভালো ভালো বেশ কিছু কলেজ ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়।
রোববার সকালে আলাপ হলো ঠাকুরগাঁওয়ের মেয়র এস এম এ মঈনের সঙ্গে। ১২টি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত তাঁর পৌরসভার লোকসংখ্যা প্রায় দেড় লাখ বলে তিনি জানালেন। তাঁর সঙ্গে দেখা করার আগে শহরের বিভিন্ন অলিগলিতে মোটরসাইকেলে ঘুরে বেড়ানোর সময় লক্ষ করেছি, ঘরবাড়িগুলো ঘনবদ্ধ, খোলা নালা-নর্দমাগুলো নোংরা আবর্জনায় পরিপূর্ণ। কেউ কেউ বললেন, কোনো কোনো গলিতে নর্দমার নোংরা পানি উপচে রাস্তায় চলে আসে। এসব সমস্যার কথা মেয়রের সামনে তুলে ধরে জানতে চাইলাম, তিনি এগুলোর ব্যাপারে সচেতন কি না। মেয়র বললেন, তিনি সচেতন, কিন্তু এসব সমস্যার সমাধান করা খুব কঠিন। কারণ, পৌরবাসীর জীবনযাপনের অভ্যাস, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাবোধের অভাব, পৌরসভার নিয়মকানুন না মানার প্রবণতা এগুলোর জন্য দায়ী। মেয়র বললেন, ‘আমরা যেসব পরিকল্পনা করি বা সিদ্ধান্ত নিই, সেগুলোর ৫ শতাংশও বাস্তবায়ন করতে পারি না।’
‘কেন পারেন না?’
‘কারণ, আমাদের ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার নেই, পুলিশ নেই। কেউ আমাদের নির্দেশ না মানলে আমরা শুধু চিঠি দিয়ে তাকে সতর্ক করতে পারি, আর কিছু করার ক্ষমতা আমাদের নেই।’
ঠাকুরগাঁও সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মশিউর রহমানের কক্ষে বসে তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, তাঁর থানায় প্রতি মাসে কতগুলো মামলা দায়ের হয়? প্রধান অভিযোগগুলো কী? উত্তরে তিনি বললেন, মাসে গড়ে ৪০-৪২টি মামলা দায়ের হয়, অধিকাংশই ভূমিবিরোধ নিয়ে মারামারি, নারী ও শিশু নির্যাতন, মাদক ব্যবসা। এসবের বাইরে প্রচুর অপমৃত্যু মামলা নথিভুক্ত করা হয়, বেশির ভাগই আত্মহত্যা। প্রায় প্রতিদিনই এ জেলায় এক বা একাধিক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। তুচ্ছ নানা কারণে মানুষ আত্মহত্যা করে। ‘যেমন?’
‘যেমন, মোবাইল ফোন কিংবা পছন্দের জামা কিনে দেয়নি, বাপের বাড়ি যেতে দেয়নি, ব্যস, আত্মহত্যা।’
‘সন্ত্রাস, রাজনৈতিক সংঘাত—এসব কেমন?’
‘এগুলো তেমন নাই। রাজনীতি শান্ত।’
‘তাহলে কি বলা যায়, ঠাকুরগাঁওয়ের লোকজন মোটের ওপর সুখে-শান্তিতেই আছে?’
‘আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিচারে বললে, হ্যাঁ।’
ঠাকুরগাঁও অপরাধপ্রবণ জেলা নয়, বন্যা-খরা-জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগও এখানে আসে না। সাধারণ মানুষের সঙ্গে দুদণ্ড কথা বললে কিংবা রাস্তায়, বাজারে, অফিস-আদালতে তাদের পারস্পরিক কথাবার্তা ও আচার-আচরণ একটু মন দিয়ে লক্ষ করলে বোঝা যায় তাদের অধিকাংশই প্রকৃতির মতো সরল। কিন্তু দারিদ্র্য ও অশিক্ষা এ জেলায় এখনো ব্যাপক। আর একটা বোধ তাদের মনে বেশ কাজ করে বলে সাধারণভাবে মনে হলো: সেটা অবহেলা ও বঞ্চনার বোধ।
সেদিন সন্ধ্যায় অবসরপ্রাপ্ত সেই কলেজশিক্ষককে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ঠাকুরগাঁওয়ের দুঃখ কী? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ঠাকুরগাঁওয়ের সবই তো দুঃখ!
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
[email protected]