ঠুনকো জীবন সস্তা লাইকে বন্দী

মানুষের জীবন এমনিতেই ঠুনকো। কোভিড এটিকে আরও ঠুনকো করে তুলেছে। মুহূর্তেই মানুষকে ছবিতে পরিণত করছে। কোভিড, কোভিড-পরবর্তী জটিলতা বা স্ট্রোকে হঠাৎ মৃত্যু এখন নিয়মিত ঘটনা হয়ে উঠছে। মৃত্যুর অতীত প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। অতীতে মৃত্যু মানে দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী থাকা, চিকিৎসা, আত্মীয়স্বজনের আনাগোনা, শয্যাশায়ীর পছন্দের খাবার বা আবদার পূরণ। আর এর ভেতর দিয়ে পরিবারের সদস্য, আত্মীয় ও প্রতিবেশীরা কর্তব্য পালনের সুযোগ পেতেন। আর শয্যাশায়ী ব্যক্তিও অন্যদের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের ফসল উপভোগ করার সুযোগ পেতেন। পেতেন ধর্মীয় আচার পালনের মাধ্যমে মৃত্যুর প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ। কিন্তু আমরা এখন এতটাই ব্যস্ত এবং আত্মকেন্দ্রিক যে কেউ যদি আগের মতো বেশি দিন শয্যাশায়ী থাকেন, তাহলে তাঁর কপালে অপমান ও লাঞ্ছনা আছে। সৃষ্টিকর্তা তাই হয়তো হঠাৎ মৃত্যুর মাধ্যমে আত্মীয়স্বজনের বোঝা কমিয়ে দিচ্ছেন, মৃত্যুপথযাত্রীরও অন্যের গলগ্রহের লাঞ্ছনা নিয়ে মরতে হচ্ছে না। বিষয়টা আপাতদৃষ্টিতে উভয় পক্ষের জন্য কল্যাণময় মনে হলেও আসলেই কি তাই।

জীবন ক্ষণস্থায়ী এবং ঠুনকো, আমরা ভালোভাবে জানি। কিন্তু হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করার সুযোগ অনেকেরই হয় না। মৃত্যু আমাদের কাছে অনেক দূরের বিষয় মনে হয়। কিংবা আপাতত আমার জন্য নয়, এমনটি মনে হয়। তাই ঠুনকো জীবনের প্রকৃত মর্ম ভুলে নানাবিধ তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ব্যস্ত আছি। আমরা যে ৬০, ৭০, ৮০ কিংবা ১০০ বছর বাঁচি, মহাকালের হিসাবে তা একটি মুহূর্ত মাত্র। অন্যভাবে বলা যায়, জীবন পদ্মপাতার শিশিরবিন্দুর মতো। ঘড়ির কাঁটার দিকে একটু তাকিয়ে চিন্তা করলেই বোঝা যায়, আমাদের এই ক্ষণ জীবন ঠক ঠক করে কত দ্রুত নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। জ্ঞানে, মানে, অর্থে, ক্ষমতায় বা প্রভাব-প্রতিপত্তিতে যতই গুরুত্বপূর্ণ হই না কেন, আমাদের অবর্তমানে পৃথিবী এক মুহূর্তও থেমে থাকবে না। পরিবারের সদস্যদের চোখের জলও দু-এক দিন পরে শুকিয়ে যাবে। তারপর ধীরে ধীরে আমরা স্মৃতির অতল গভীরে হারিয়ে যাব। একসময় পৃথিবীতে আমাদের কথা স্মরণ করার আর কেউ থাকবে না। এটাই বাস্তবতা।

আমাদের এই পোস্ট কতজন দু-এক সপ্তাহ পর মনে রাখছে? মৃত্যুর পরে তো দূরের কথা, দুই দিন পর কে আমাদের মনে রাখবে? তাহলে ঠুনকো এই জীবন কি সস্তা লাইকের কাছে সঁপে দেব? নাকি প্রকৃত মহৎ হওয়ার চেষ্টা করব? আর মহৎ হওয়ার জন্য তো ধনী বা জ্ঞানী হওয়ার প্রয়োজন নেই। আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্ক এবং দরিদ্র, অসহায়, এতিম, বৃদ্ধ কিংবা খেটে খাওয়া মানুষদের অসহায়ত্বের কথা চিন্তা করেও তো মহৎ হওয়া যায়। আর মুখের হাসির জন্য তো কোনো অর্থ খরচ করতে হয় না

আসুন একটু থামি। এই বাস্তবতা সম্পর্কে ভাবি, নিজেকে প্রশ্ন করি। কিসের জন্য এই মোহ, এত ব্যস্ততা? দুনিয়া আমাদের অন্ধ করে ফেলেছে। আমরা শুধু ছুটছি আর ছুটছি। কেউ সম্পদ, কেউ প্রভাব-প্রতিপত্তি আর কেউবা খ্যাতির পেছনে। কিন্তু কখনো কি ভাবার সময় পাই, যেভাবে প্রিয় দলের খেলার টিকিট ক্রয়ের জন্য লাইনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকি, সেভাবেই আসলে আমরা মৃত্যুর জন্য সবাই লাইনে আছি। চাই আর না চাই, এই লাইন থেকে বের হওয়ার সুযোগ নেই। এই লাইনে অগ্রজরাই যে সর্বদা প্রাধান্য পাবে, তা–ও কিন্তু নয়। অনেক অনুজও লাইনের সামনে আছে।

একটু ভাবুন তো আজ আমরা যে ৭০০ কোটি মানুষ পৃথিবীতে পদচারণ করছি, আগামী ৬০, ৭০, ৮০ কিংবা ১০০ বছরের মধ্যে কেউ জীবিত থাকব না। এটা জেনে-বুঝেই আমাদের ক্ষণস্থায়ী ঠুনকো জীবনকে পৃথিবীতে সার্থক করে যেতে চাই। তার জন্যই নিরন্তর ছুটে চলা। আর এই ছুটে চলা কবরের মাটি কিংবা শ্মশানের চিতায় ঠাঁই হওয়ার এক মুহূর্ত আগ পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। দেশের প্রায় অর্ধেক মানুষের তিন বেলা খাদ্যের নিশ্চয়তা নেই। তিন বেলা খাবার জোগাড়ের মধ্যেই তারা জীবনের সার্থকতা খুঁজে পায়। তাদের মহৎ হওয়ার সুযোগ কোথায়? কিন্তু কেউ তাদের মহৎ না বললেও তারাই প্রকৃত মহৎ। তাদের ঘাম ঝরানো পরিশ্রমের ফসলেই দেশের বর্তমান অগ্রগতি। বাকি অর্ধেকেরই আছে মহৎ হওয়ার নানা স্বপ্ন, যার বেশির ভাগই তাদের সাধ্যাতীত। আর এক-চতুর্থাংশ মানুষ, বিশেষত আয় অনুযায়ী ওপরের ৫-১০ ভাগের সাধ্য ও সুযোগ থাকলেও সবার মহৎ হওয়ার স্বপ্ন আছে কি না, পরিষ্কার নয়। তবে এটা পরিষ্কার যে দেশে প্রায় তিন-চতুর্থাংশ মানুষের ধনে, মানে ও প্রভাব-প্রতিপত্তিতে বড় হওয়ার স্বপ্ন আছে। এই বড় হওয়ার নিরন্তর চেষ্টাতেই আমরা সবাই ব্যস্ত। এই ব্যস্ততার একটা বড় অংশজুড়ে আছে ক্রীড়া প্রতিযোগিতার মতো অন্যকে টপকে নিজেকে জয়ী করার সর্বাত্মক চেষ্টা। অর্থাৎ স্বার্থপরভাবে অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়া। আর সেটা করতে গিয়ে আমরা হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলছি। নিজেকে ধনী, জ্ঞানী কিংবা প্রভাবশালী হিসেবে প্রতিষ্ঠা ও জাহিরের চেষ্টায় সর্বক্ষণ ব্যস্ত আছি।

সোশ্যাল মিডিয়ার এই যুগে নিজেকে জাহির করার সুযোগ তো অনেক বেশি। যে যেভাবে পারছি, নিজেকে উপস্থাপন করছি। হোক তা মৃত ব্যক্তির কফিনের সঙ্গে ছবি তুলে কিংবা দুর্ঘটনায় পতিত মুমূর্ষু ব্যক্তিকে সহায়তার পরিবর্তে তার সঙ্গে সেলফি তুলে। অথবা দান-সহায়তার প্রামাণ্যচিত্র ধারণ করে। আর রাজনৈতিক বচন তো আছেই। অন্য কিছু পোস্ট দেওয়ার না থাকলে প্রোফাইল ফটো পরিবর্তন করি। এসব বিষয়ের সাফল্য নির্ভর করে লাইক বা শেয়ারের ওপর। আর পোস্টটি ভাইরাল হলে তো মনে হয় স্বর্গ হাতে পাওয়া গেল। বেশি বেশি লাইকেই আমরা জীবনের সার্থকতা খুঁজে পাই। তাই তো সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট দিয়ে সারাক্ষণ খেয়াল রাখছি—কে লাইক বা শেয়ার দিল। কমেন্টেই বা কী লিখল।

একটু ভাবুন তো, এই আনন্দটাও কত ঠুনকো? আমাদের এই পোস্ট কতজন দু-এক সপ্তাহ পর মনে রাখছে? মৃত্যুর পরে তো দূরের কথা, দুই দিন পর কে আমাদের মনে রাখবে? তাহলে ঠুনকো এই জীবন কি সস্তা লাইকের কাছে সঁপে দেব? নাকি প্রকৃত মহৎ হওয়ার চেষ্টা করব? আর মহৎ হওয়ার জন্য তো ধনী বা জ্ঞানী হওয়ার প্রয়োজন নেই। আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্ক এবং দরিদ্র, অসহায়, এতিম, বৃদ্ধ কিংবা খেটে খাওয়া মানুষের অসহায়ত্বের কথা চিন্তা করেও তো মহৎ হওয়া যায়। আর মুখের হাসির জন্য তো কোনো অর্থ খরচ করতে হয় না।

তাই আসুন সোশ্যাল মিডিয়ার সস্তা ও তুচ্ছ লাইকের বদলে প্রকৃত মহৎ হওয়ার চেষ্টা করি। সময় থাকতে এই অনুভূতির জাগরণ না হলে শেষ বয়সে হয়তো কবি কায়কোবাদের মতো আমাদেরও আক্ষেপ করে বলতে হবে ‘হীরা ফেলে কাচ তুলে। ভিখারি সেজেছি আমি।’

সৈয়দ আব্দুল হামিদ অধ্যাপক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়