ডাকঘর-বৃত্তান্ত

গেল শতাব্দীর আশির দশকে জাইরো রেমিট্যান্স বাড়ানোর লক্ষ্যে যখন আমাকে লন্ডনে আমাদের হাইকমিশনে পোস্টাল অ্যাটাচি পদে পদায়ন করা হলো, তখন সপরিবারে লন্ডনে পৌঁছানোর স্বল্পদিনের মধ্যেই হাইকমিশন আমাকে ব্যাকইয়ার্ড-সংবলিত যে বাসাটা ভাড়া করে দিল, সেটা ছিল আমারই এক আত্মীয়ের। আমার ওই আত্মীয় তাঁর বাসাটি হাইকমিশনকে ভাড়া দিয়ে দেশে ফিরে পোশাক তৈরির ব্যবসায় নিয়োজিত হয়ে অচিরেই কোটিপতি হয়ে যান। বর্তমানে তিনি প্রায়ই পাঁচতারা হোটেলে দুপুরের খাবার খান। ওদিকে আমি বাসায় ওঠার দিন কয়েক পরেই এক ইংরেজ যুবক একটি সুন্দর মোটরগাড়ি, ততোধিক সুন্দরী স্ত্রী, একটা অ্যালসেশিয়ান কুকুরসহ আমার দোরগোড়ায় এসে দোরঘণ্টি চাপলেন। আমি বেরিয়ে এসে জিজ্ঞাসু নেত্রে তাকালে তিনি বললেন, ‘আই কাট গ্রাস।’ অর্থাৎ তিনি পয়সার বিনিময়ে বাড়ির উঠানের ঘাস কাটেন।
তা ইউকে একটি ওয়েলফেয়ার স্টেট তথা কল্যাণমূলক রাষ্ট্র বিধায় ওখানে কেউ ‘রেইনি ডে’ অর্থাৎ দুর্যোগপূর্ণ দিনের জন্য টাকাপয়সা সঞ্চয় করে রাখেন না; কেননা সে দেশে কেউ জন্মগ্রহণের পরেই মায়ের কোল থেকে কবর পর্যন্ত সব সরকারের দায়দায়িত্ব। কিন্তু আমি গেছি গরিব দেশ থেকে; মনে মনে প্রত্যাশা, বেতন ও ভাতা থেকে যতটা সম্ভব বাঁচিয়ে দেশে ফেরার পর আয়েশে অবশিষ্ট জীবন কাটাব। আমি দোটানায় পড়ে গেলাম। আমার ইতস্তত ভাব লক্ষ করে যুবকটি অতঃপর বললেন যে আমাকে কোনো পেমেন্ট করতে হবে না, বাড়ির মালিকের সঙ্গে তাঁর বার্ষিক চুক্তি আছে। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। আমার মনে হলো, মন থেকে এক বিরাট বোঝা নেমে গেল।

>অতএব ফিনল্যান্ডে ডাক বিভাগ তাদের নতুন কাজে লাগানোর পরিকল্পনা করছে। সরকারের আয় বাড়াতে ডাকপিয়নরা এখন বাড়ি বাড়ি গিয়ে উঠানের ঘাস পরিষ্কার করবেন এবং সপ্তাহে এক ঘণ্টা ঘাস কাটার বিনিময়ে ডাক বিভাগ গ্রাহকদের কাছ থেকে মাসিক ১৩০ মার্কিন ডলার নেবে

তো ঘটনাটা আমার মনে পড়ে গেল সম্প্রতি পত্রিকার পাতায় একটি ছোট্ট সংবাদ পাঠ করে। সংবাদটি হচ্ছে এই: আগের মতো বেশি বেশি চিঠি এখন বিলি করতে হয় না; তাই ডাকপিয়নের ব্যস্ততা নেই বললেই চলে। অতএব ফিনল্যান্ডে ডাক বিভাগ তাদের নতুন কাজে লাগানোর পরিকল্পনা করছে। সরকারের আয় বাড়াতে ডাকপিয়নরা এখন বাড়ি বাড়ি গিয়ে উঠানের ঘাস পরিষ্কার করবেন এবং সপ্তাহে এক ঘণ্টা ঘাস কাটার বিনিময়ে ডাক বিভাগ গ্রাহকদের কাছ থেকে মাসিক ১৩০ মার্কিন ডলার নেবে। বলা বাহুল্য, বাংলাদেশ ডাক বিভাগের একজন সাবেক মহাপরিচালক হওয়ার সুবাদে সংবাদটা আমার কাছে যথেষ্ট কৌতূহলোদ্দীপক; কেননা আমাদের এখানকার ডাক বিভাগের অবস্থাও তথৈবচ।
সে যা হোক, ডাক বিভাগ সরকারের একটি সুবৃহৎ ও সুপ্রাচীন সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। ১০ হাজার ডাকঘর-সংবলিত এই বিভাগের কর্মকর্তা ও কর্মচারী মিলিয়ে বর্তমান লোকসংখ্যা ৪০ হাজার। যার মধ্যে অর্ধেক এক্সট্রা ডিপার্টমেন্টাল তথা অ-বিভাগীয়। আর পাকিস্তান আমলে গোটা পাকিস্তানে যেখানে ডাক বিভাগের বার্ষিক চার কোটি টাকা বাজেটের অর্ধেক অর্থাৎ দুই কোটি টাকাই ভর্তুকি দিত সরকার, সে স্থলে বাংলাদেশ ডাক বিভাগের বর্তমান আয় ও ভর্তুকি, বিশেষত সরকারি কর্মচারীদের এবারের অভাবনীয় বর্ধিত বেতন স্কেলের পর কত, সেটা যৎকিঞ্চিৎ আমার জানা থাকলেও ব্যক্ত করা থেকে বিরত রইলাম; পাছে দুর্বল হার্টের দেশদরদি পাঠকদের হার্টের সমস্যা না আবার বেড়ে যায়।
আর হ্যাঁ, ১৮৪০ সালে ইংল্যান্ডের স্যার রোল্যান্ড হিল কর্তৃক ‘পেনি পোস্ট’ প্রবর্তিত হওয়ার পর থেকে দীর্ঘ পথপরিক্রমায় বিশ্ব ডাকব্যবস্থা অনেক পথ অতিক্রম করেছে। একসময়ের ‘মনোপলি’ তথা ডাক পরিবহনে সরকারের একচেটিয়া অধিকার থেকে হালের ই-মেইল ও প্রাইভেট কুরিয়ারতক। ভারতবর্ষে শেরশাহের আমলে তিনি ঘোড়ার গাড়িতে করে ডাকের আদান-প্রদান প্রবর্তন করেন। এ জন্য আমাদের দেশের এক ছেলে স্কুলে পরীক্ষার খাতায় নাকি লিখেছিল, ‘শেরশাহ প্রথম ঘোড়ার ডাকের প্রচলন করেন। তৎপূর্বে ঘোড়ায় ডাকিত না।’
একসময়ে বলা হতো—ডাকঘর, পাকঘর, থানা আর সরাইখানা—এই চার জায়গা বন্ধ হয় না। ওটা ছিল কম্বাইন্ড তথা সংযুক্ত সাব-পোস্ট অফিসের যুগ, যখন গভীর রাতে ‘টরে-টক্কা’ আওয়াজ শুনে ঘুম থেকে উঠে টেলিগ্রাম গ্রহণ করতে হতো বিধায় পোস্টমাস্টারকে রেন্ট-ফ্রি কোয়ার্টার দেওয়া হতো। তবে ২০০৮ সালে এ দেশের সরকার টেলিগ্রাফের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দেয়। আর ওই সময়েরই একটি মুখরোচক গল্প হচ্ছে: গ্রামের সহজ-সরল লোকটি মাটির ভাঁড়ে করে দই নিয়ে এসে তাঁর শহরে পড়ুয়া পুত্রের কাছে টেলিগ্রাফ মারফত পাঠাতে চাইলে পোস্টমাস্টার সেটা রেখে দিয়ে উদরসাৎ করে ফেললেন এবং অতঃপর লোকটি দই না পৌঁছার অভিযোগ নিয়ে এলে ডাকমাশুল ফেরত দিয়ে বললেন, ‘আমি তো ঠিকই দইয়ের ভাঁড় টেলিগ্রাফের তারের মাধ্যমে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু বিপরীত দিক থেকে আরেকটি দইয়ের ভাঁড় প্রেরণের ফলে মাঝপথে টক্কর লেগে ভাঁড় ভেঙে সব দই পড়ে গেছে।’ বোধ করি সেই পোস্টমাস্টারই স্ত্রীর উদ্দেশে প্রেরিত বিদেশে ভ্রমণরত স্বামীর টেলিগ্রাম ‘হ্যাভিং এ ওয়ান্ডারফুল টাইম। উইশ ইউ ওয়্যার হেয়ার’ গ্রহণ করতে গিয়ে সবশেষের ‘ই’ অক্ষরটি বাদ দেওয়ায় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যে মনোমালিন্য সৃষ্টি হয়েছিল, সেটার জের বহুদিন যাবৎ বহাল ছিল।
একসময় টাকা স্থানান্তরের মাধ্যমও ছিল প্রধানত ডাক বিভাগই; বর্তমানে সেটার স্থলাভিষিক্ত হয়েছে ‘বিকাশ’। তো সে সময় একজন হিন্দু বাচ্চা ছেলে ভগবানের কাছে চিঠি লিখেছিল, ‘ভগবান, আমাকে মনি অর্ডার করে ২০০ টাকা পাঠাও; নতুবা আমি গাড়ির নিচে পড়ে আত্মহত্যা করব।’ চিঠিটা যথারীতি ডাক বিভাগের ‘রিটার্নড লেটার অফিস’-এ পৌঁছালে ছোট্ট সেই অফিসের কর্মচারীরা ওটা পড়ে দয়াপরবশ হয়ে ছেলেটির কাছে ১০০ টাকা মনি অর্ডার করে পাঠালেন। ছেলেটি টাকাটা পেয়ে ভগবানকে পুনঃ লিখে পাঠাল, ‘ভগবান, তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। কিন্তু আমি তো ২০০ টাকা চেয়েছিলাম। তুমি ১০০ টাকা পাঠালে কেন? আমার বিশ্বাস, তুমি ২০০ টাকাই পাঠিয়েছিলে, ডাক বিভাগের লোকেরা আমার ১০০ টাকা মেরে দিয়েছে।’
আরবের সেই সহজ-সরল লোকটির প্রাসঙ্গিক গল্পটিও কম চিত্তাকর্ষক নয়। লোকটি বাগদাদ থেকে কাজবিন নামক স্থানে গিয়েছিল কার্যোপলক্ষে। প্রোগ্রাম ছিল সেখানে এক সপ্তাহ থাকার, কিন্তু কাজ শেষ না হওয়ায় আরও কয়েক দিন থেকে যেতে হচ্ছিল। এক্ষণে পরিবারকে খবর পাঠানো দরকার। সে স্ত্রীকে পত্র লিখল, কিন্তু ডাকব্যবস্থার অবর্তমানে নিজেই ঘোড়ায় চড়ে বাড়িতে পৌঁছে বাড়ির বাইরে থেকে পত্রটি ছুড়ে মেরে চলে যাচ্ছিল এবং স্ত্রীর জিজ্ঞাসার জবাবে জানাল, ‘আমার আসার উদ্দেশ্য পত্রটি পৌঁছানো; অতএব আমি বাড়ির ভেতরে ঢুকব না।’
ফিরে আসি ফিনল্যান্ড ডাক বিভাগ কর্তৃক ডাকপিয়নদের দিয়ে ঘাস কাটানোর ব্যাপারটায়। ওই সব দেশে কোনো কাজকেই হেয়জ্ঞান করা হয় না। কিন্তু আমাদের দেশে পরিপ্রেক্ষিত সম্পূর্ণ ভিন্ন। কিন্তু সরকার কাঁহাতক ডাক বিভাগের এই ক্রমবর্ধমান ভর্তুকি তথা লোকসানের বোঝা বয়ে বেড়াবে? কদ্দিন পর্যন্ত এই এত অধিকসংখ্যক লোককে প্রায়-বসিয়ে খাওয়াবে? দেশে কিছু প্রবীণ নিষ্ঠাবান ডাক-বিশেষজ্ঞ এখনো বেঁচেবর্তে আছেন। এসব ক্ষেত্রে সচরাচর যেটা করার নিয়ম সরকার তাঁদের সম্পৃক্ত করে একটা কমিশন নিয়োগপূর্বক এ অবস্থা থেকে উত্তরণের চেষ্টা করা উচিত। বিশ্বের অন্য অনেক দেশও তা-ই করছে।
আতাউর রহমান: রম্যলেখক৷ ডাক বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক৷