ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও রীতা দেওয়ানের কান্না

৩ মে মুক্ত সাংবাদিকতা দিবস উপলক্ষে ‘নাগরিক’ নামের একটি সংগঠনের উদ্যোগে বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। এ ধরনের সেমিনারে সাধারণত সংশ্লিষ্ট বিষয়ের অংশীজনের পাশাপাশি বিশেষজ্ঞরা আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে আসেন এবং নিজেদের অভিমত তুলে ধরেন। অনেক সময় বিশেষজ্ঞ বক্তারা বক্তৃতা দিয়েই চলে যান। অন্যদের কথা শোনার সময় তাঁদের হয় না।

কিন্তু ওই দিন নাগরিকের সেমিনারে মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার কয়েক ব্যক্তি তাঁদের যে করুণ অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন, তা শুনলে মন বিষাদে ভরে যায়। হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। তাঁদের মধ্যে ছিলেন লোকশিল্পী রীতা দেওয়ান, চট্টগ্রামের সাংবাদিক গোলাম সারওয়ার, ঢাকার আলোকচিত্র সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মইদুল ইসলাম। এ অনুষ্ঠানে উদ্যোক্তা ও অংশীজনের মধ্যে ছিলেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকারকর্মী সি আর আবরার, আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া ও রেজাউর রহমান, লেখক ফিরোজ আহমদ প্রমুখ।

এই কলামে তাঁদের বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি না করে বরং ভুক্তভোগীদের অভিজ্ঞতার ওপর আলোকপাত করছি। রীতা দেওয়ান একজন বাউলশিল্পী। গ্রামে গ্রামে ঘুরে পালাগান করেন। এই গান তাঁর জীবন, তাঁর জীবিকা। বিভিন্ন স্থানে পালাগান গেয়ে তিনি যা পেতেন, তা দিয়েই তাঁর সংসার চলত। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগ এনে গত বছরের ২ ফেব্রুয়ারি এক আইনজীবী বাংলাদেশ সাইবার ট্রাইব্যুনালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৮(১) ধারায় মামলা করেন। আদালত সরাসরি মামলাটি আমলে না নিয়ে পিবিআইকে তদন্তের দায়িত্ব দেন। তাদের তদন্তের ভিত্তিতে ২ ডিসেম্বর আদালত রীতা দেওয়ানের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। এরপর তিনি আদালতে আত্মসমর্পণ করলে বাংলাদেশ সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক আসসামছ জগলুল হোসেন তাঁর জামিন মঞ্জুর করেন। কিন্তু জামিনে মুক্ত হওয়ার পরও রীতা স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারছেন না। তাঁর গান গাওয়া বন্ধ। ভয়ে কেউ তাঁকে পালাগানের জন্য ডাকেন না।

আলাপ প্রসঙ্গে রীতা দেওয়ানের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেছেন, তিনি একজন প্রতিষ্ঠিত বাউলশিল্পী। তাঁর একটি অনুষ্ঠানের খণ্ডিত বক্তব্য উপস্থাপন করে তাঁর বিরুদ্ধে আইসিটি আইনের ২৮ ধারায় মামলা হয়। সাত মিনিটের একটি ভিডিও উপস্থাপন করা হয়। ২৮ ধারার মূল বক্তব্য হলো তাঁকে ভিডিওটি ওয়েবসাইট বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে প্রকাশ বা প্রচার করতে হবে। তিনি সে রকম কোনো কাজ করেননি। তা ছাড়া সাড়ে চার ঘণ্টার গানের অনুষ্ঠান ছিল; মানুষ এবং সৃষ্টিকর্তার যে সম্পর্ক, তা নিয়ে পালাগানের খণ্ডিত অংশ বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করা হয়। এই বক্তব্যগুলো আমরা উপস্থাপন করেছি, আদালত সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে জামিন দিয়েছেন।

রীতা দেওয়ান সেমিনারে তাঁর দুঃখ–দুর্দশার কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন। তিনি বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে গান করেছি। গান ছাড়া কিছু শিখিনি। গানের মাধ্যমেই আমি আল্লাহ-রাসুলের কথা বলি। ধর্মের কথা বলি।’ একশ্রেণির মানুষ সেই গানের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করে গানও গাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন।

আমরা কোন সমাজে বাস করছি? এ দেশে লোকশিল্পী ও বাউলশিল্পীরা শত শত বছর ধরে গান গেয়ে মানুষকে আনন্দ দিয়েছেন। যেমন দিয়েছেন লালন সাঁই। যেমন দিয়েছেন হাসন রাজা। যেমন দিয়েছেন শাহ আবদুল করিমসহ আরও অনেক বাউলশিল্পী। এই শিল্পীরা গানের মাধ্যমে যে ধর্মতত্ত্ব প্রচার করেছেন, যে জীবন-দর্শন ব্যাখ্যা করেছেন, তার সঙ্গে কেউ একমত হতেও পারেন, না-ও হতে পারেন। কিন্তু গান বন্ধ করে দিতে হবে কেন? শিল্পীর ওপর সন্ত্রাসী হামলা হবে কেন? গত বছর শাহ আবদুল করিমের শিষ্য বাউল গণেশ ঠাকুরের বাড়ির বাউলগানের আসরঘর পুড়িয়ে দিয়েছিল দুর্বৃত্তরা। সেই ঘরে থাকা তাঁর ও শিষ্যদের বাদ্যযন্ত্র, গীতিগ্রন্থসহ প্রায় ৪০ বছরের সংগৃহীত বাউলগানের মূল্যবান উপকরণও পুড়ে যায়। পরে অবশ্য জেলা প্রশাসন থেকে তাঁকে ঘর ও বাদ্যযন্ত্র কেনার জন্য সহায়তা দেওয়া হয়েছিল।

কিন্তু রীতা দেওয়ানের মতো অনেক বাউলশিল্পীর জীবন যারা দুর্বিষহ করে তুলেছে, যারা বাউলশিল্পীদের মারধর করেছে, তাদের দাড়ি কেটে দিয়েছে, আস্তানা গুঁড়িয়ে দিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। শাস্তি হয় না। এতে আক্রমণকারীরা আশকারা পেয়ে যায়। কেবল বাউলশিল্পী নয়, আক্রমণ হয়েছে যাত্রাপালার উদ্যোক্তা ও শিল্পীদের ওপর। ভিন্নমতের লেখকদের ওপর।

ওই সেমিনারের বিষয় ছিল, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও মানবাধিকার। অস্বীকার করা যাবে না করোনাকালে সব শ্রেণির মানুষই কঠিন অবস্থার মুখোমুখি। অনেকে কাজ হারিয়েছেন। কিন্তু যাঁরা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের শিকার, ক্ষমতা যাঁদের নিয়ত হুমকি-হয়রানির মধ্যে ঠেলে দিয়েছে, তাঁদের জীবন হয়ে উঠেছে আরও দুর্বিষহ। সমাজের কাছে তারা নিগৃহীত, পরিবারের কাছে উপেক্ষিত।

ওই সেমিনারে ভুক্তভোগী লোকজনের মধ্যে ছিলেন আলোকচিত্র সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল, যাঁর বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন দলের সাংসদসহ একাধিক নেতা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেছিলেন। এরপরই তিনি হাতিরপুলে নিজ বাড়ি থেকে বের হয়ে অফিসে যাওয়ার পথে অপহৃত হন। এর পাঁচ মাস পরে নিজেকে আবিষ্কার করেন যশোরের বেনাপোলে। এই পাঁচ মাস কাজল কোথায় ছিলেন, এই প্রশ্নের উত্তর নেই। চট্টগ্রামের সাংবাদিক গোলাম সারওয়ার, যিনি স্থানীয় এক প্রভাবশালী ব্যক্তির দুর্নীতি নিয়ে অনলাইনে প্রতিবেদন তৈরি করেছিলেন। এরপর কে বা কারা তঁাকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। তাঁকে মারধর করে। সাংবাদিকতা করবেন না, এই মুচলেকা দেওয়ার পর ওই অপহরণকারীরা তাঁকে ছেড়ে দেয়। আবার তাঁর বিরুদ্ধেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়ের করা হয়।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মইদুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ডরমিটরির দুরবস্থা নিয়ে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। তাঁকেও একই আইনে মামলায় কারাগারে যেতে হয়েছে। তিনি যাঁর সম্পর্কে ফেসবুকে লিখেছিলেন, তিনি মামলা করেননি। সরকারেরও কেউ মামলা করেননি। মামলা করেছেন ছাত্রলীগের এক নেতা। তাঁর মামলাটি বিচারাধীন। তিনি বিদেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃত্তি পেয়েছিলেন উচ্চতর লেখাপড়ার জন্য। কিন্তু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁর সেই বিদেশযাত্রা আটকে দিয়েছে মামলার দোহাই দিয়ে। এই হলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও ক্ষমতার মাহাত্ম্য।

সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও হাটহাজারী-কাণ্ডের পর হেফাজতে ইসলামের অনেক নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিন্তু ২০১৩ সাল থেকে হেফাজতের অনুসারীরা কথিত ব্লগার, লেখক-শিল্পীদের বিরুদ্ধে যে উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে আসছিলেন, তা বন্ধ হয়নি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম খুললেই দেখা যাবে তাঁদের হুমকি, ‘একে কতল করো। ওকে গ্রেপ্তার করো।’

সরকারের শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা এসব প্রচারণাকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে স্বাধীন চিন্তার লেখক-শিল্পীদের কী লেখা উচিত, কী গাওয়া উচিত, সে সম্পর্কে সদুপদেশ দিয়ে যাচ্ছেন। এতে সেই ব্যক্তিরাই আশকারা পেয়েছেন, যাঁরা ভিন্নমতকে দমন করতে চান।

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

[email protected]