তাজউদ্দীন আহমদ পরিবারের ক্ষোভ যথার্থ

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দীন আহমদ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দীন আহমদ

বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের পুত্র ও সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তানজিম আহমদ সোহেল তাজ গত শনিবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তার (উপসচিব পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী) ব্যক্তিগত ফেসবুকে দেওয়া বক্তব্যের প্রতিবাদ করেছেন। ওই কর্মকর্তা আওয়ামী লীগ করেন। তাঁর নাম শাহ আলী ফরহাদ। ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহচর তাজউদ্দীন আহমদের (বঙ্গতাজ) নেতৃত্ব বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন’ নিয়ে এই তর্ক-বিতর্কের সূত্রপাত।

২৩ জুলাই তাজউদ্দীন আহমদের জন্মদিনে প্রয়াত নেতার কন্যা শারমিন আহমদ, আইনজীবী তানিয়া আমীর এবং প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের ভ্রাম্যমাণ রাষ্ট্রদূত হিসেবে পরিচিত মুহাম্মদ নুরুল কাদের একটি অনলাইন জুম সভায় অংশ নেন। ফরহাদের ফেসবুকে দেওয়া বেশ কয়েকটি পোস্টের স্ক্রিনশট পেলাম সোহেল তাজের ফেসবুকে। ফরহাদ বঙ্গতাজ সম্পর্কে ‘আপত্তিকর’ যা বলেছেন, সেই পোস্টগুলো তাঁর কি একান্ত ব্যক্তিগত বলে গণ্য হতে পারে? একজন সরকারি কর্মকর্তার বক্তব্য হিসেবে চলার তো প্রশ্নই ওঠে না। তাজউদ্দীন আহমদের পরিবারকে প্রকাশ্যে কটাক্ষ করার বিষয়টি আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক শিষ্টাচার সমর্থন করতে পারে না। এখানে শুধু কটাক্ষ নয়, ওই কর্মকর্তা রীতিমতো তাজউদ্দীন আহমদ পরিবারকে আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলেছেন। ফরহাদ লিখেছেন, ‘জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষক বানানোর অপচেষ্টা আর তাজউদ্দীনকে শেখ মুজিবের থেকে দক্ষ প্রশাসক বা নীতিনির্ধারক দেখানোর কৌশল একই সূত্রে গাঁথা।’ 

একটি জাতির জীবনে শত শত বীরত্বগাথা থাকবে। সেখানে সব সময় তুলনামূলক গুণাগুণ বিশ্লেষণে যাওয়া এবং তুলনা করে কারও প্রশংসা বা সমালোচনা অপ্রয়োজনীয় ও ভুল। তাজউদ্দীন পরিবারকে খোঁচা দিতে জিয়াকে টেনে আনা হয়েছে এবং ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ করা হয়েছে। বিশেষ করে ইতিহাস বিকৃতি যখন দণ্ডনীয় অপরাধ? এটা কি কোনো কৌশল? কার কৌশল? 

এর চেয়েও গুরুতর বিষয় হলো, ফরহাদ আরেকটি পোস্টের শুরুতে লিখেছেন, ‘তাজউদ্দীন আহমদ আমৃত্যু নীতির প্রতি আপসহীন ছিলেন, কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর নীতি বিচ্যুতি ঘটেছিল’, ‘২৫শে মার্চ তাজউদ্দীন সাহেব বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীনতার ঘোষণার কথা বললে বঙ্গবন্ধু তাকে নাকে তেল দিয়ে ঘুমাতে বলেছিলেন’, ‘বঙ্গবন্ধু ইমোশনাল ছিলেন, দক্ষ নেগোশিয়েটর ছিলেন না এর জন্য পাকিস্তান, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক কেউই তাকে ভয় পেতেন না, পেতেন তাজউদ্দীনকে’—এ ধরনের কথা শুধু আপত্তিকরই নয়, ইতিহাস বিকৃতিরও শামিল। এরপর তিনি এনেছেন ভয়াবহ অভিযোগ।

ফরহাদের ভাষায়, ‘তাজউদ্দীন আহমদের কন্যা শারমিন আহমদ ও তার সহকারী মঈদুল হাসানের দুইটি ইতিহাস বিকৃতকারী বই থেকেই ওই বিকল্প ইতিহাস পাওয়া যায়।’ কারও মনে খটকা জাগাতে তাঁরা যৌথভাবে বই লিখলেন কি না? মঈদুল হাসানের পাণ্ডিত্য অগাধ, তিনি প্রবাসী সরকারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাঁর মতো একজন প্রবীণ ব্যক্তিত্বকে শারমিনের ‘সহকারী’ বলার ভঙ্গিতেও একটা তাচ্ছিল্যের ইঙ্গিত আছে।

‘নাকে তেল দিয়ে ঘুমানোর’ উদ্ধৃতিটি আমরা শারমিন আহমদের লেখা তাজউদ্দীন আহমদ: নেতা ও পিতা বইয়ে পেলাম। কারও কোনো উদ্ধৃতি দিলে সেটা কোন প্রেক্ষাপটে ব্যবহার করা হয়েছে, তার উল্লেখ দরকার পড়ে। না হলে বিকৃতি ঘটার ঝুঁকি থাকে। ফরহাদ দুটি বই থেকে তিনটি বাক্য এক জায়গায় এনে জড়ো করেছেন। লক্ষ্য বঙ্গবন্ধুর অনুসারীদের ক্ষুব্ধ বা বিভ্রান্ত করা। বঙ্গবন্ধু কেন ২৫ মার্চে ৩২ নম্বরে থেকে গিয়েছিলেন, কেন তাজউদ্দীন আহমদের পরিকল্পনায় স্বাধীনতার ঘোষণার রেকর্ড করেননি, তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা শারমিনের বইয়ে আছে। অথচ ফরহাদ সেখান থেকে শুধু একটি বাক্য বিচ্ছিন্নভাবে তুলে নিয়েছেন। তারপর অন্য দুটি প্রসঙ্গে বলা উদ্ধৃতির সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন। একে বিভ্রান্তি সৃষ্টি বা তাজউদ্দীন আহমদের পরিবারকে ঘায়েল করার চেষ্টা হিসেবে বিবেচনা করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

শারমিন তাঁর বইয়ের ১৪৭ পৃষ্ঠায় তথ্য দেন যে তাঁর আব্বুকে ‘নাকে তেল দিয়ে ঘুমাতে’ বললেও বঙ্গবন্ধু গোপনে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন, তার প্রমাণ শহীদ ইঞ্জিনিয়ার নূরুল হককে তিনি ট্রান্সমিটার জোগাড় করতে বলেছিলেন। ডেইলি টেলিগ্রাফ-এর সাংবাদিক ডেভিড লোসাক লিখেছেন, ‘২৬ মার্চে প্রচারিত মুজিব তাঁর স্বাধীনতার ঘোষণাটি আগেই রেকর্ড করেছিলেন।’ শারমিন এমনকি এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে জিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণা শুনে তাঁর আব্বুর খুশি হওয়ার কথা বলেছেন। আবার তিনি জিয়াকে ঘোষক বানানোর চেষ্টার নিন্দা করেছেন। সুতরাং সামগ্রিকভাবে বিষয়টিকে না দেখে বিচ্ছিন্নভাবে ‘নাকে তেল দিয়ে ঘুমানোর’ তথ্যটি ব্যবহার করা হলো। এটা আর তথ্য থাকল না, অস্ত্রে পরিণত হলো। একজন নবীন ব্যারিস্টার তাঁর ক্যারিয়ারের শুরুতেই এমন করবেন, এটা বিস্ময়কর। তবে তর্ক তো চলতেই পারে। কিন্তু তাজউদ্দীনের পরিবারের সদস্যদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ‘ইতিহাস বিকৃতিকারী’ বলার মতো বাস্তবতায় কি আওয়ামী লীগ পড়েছে? বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভিন্নমতের অনুশীলন কম। ভিন্নমতের নামে প্রতিপক্ষকে খাটো করা থাকে লক্ষ্য। তাজউদ্দীনের আরেক কন্যা মাহজাবিন আহমদ মিমির চার বছরের ফেসবুক ফ্রেন্ড ফরহাদ। শারমিনের ৪২৮ পৃষ্ঠার বইটি ঐতিহ্য থেকে বের হয়েছে ২০১৪ সালে। এত দিন পর ফরহাদের এভাবে জেগে ওঠার পেছনে কারও ইন্ধন রয়েছে কি?

ফরহাদ হয়তো খেয়াল করেননি, তিনি শারমিনকে আক্রমণ করতে গিয়ে আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীকেও আহত করেছেন। ১৯৮৬ সালের ১১ জুন যায়যায়দিন-এ আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী লিখেছিলেন, ‘একজন বিস্মৃত নেতার স্মৃতিকথা’। এতে তিনি ভুট্টো ও তাঁর সহকর্মীরা বঙ্গতাজকে কতটা ভয় করতেন, তা বোঝাতে একটি ঘটনার উল্লেখ করেন। তাঁর দাবি, তৎকালীন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ভুট্টো যখন তাঁর সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলছিলেন, তখন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী সেটা শুনে ফেলেন। বইটির ২০৫ পৃষ্ঠায় শারমিন তাঁর বরাতেই লিখেছেন, ‘ইমোশনাল অ্যাপ্রোচে মুজিবকে কাবু করা যায় কিন্তু তাঁর পেছনে ফাইল বগলে চুপচাপ যে নটোরিয়াস লোকটি বসে থাকে, তাকে কাবু করা শক্ত। দিস তাজউদ্দীন, আই টেল ইউ, উইল বি ইয়োর মেন প্রবলেম।’ এ প্রসঙ্গে ফরহাদ যে মন্তব্য করেছেন, তাতে তাঁর স্থূল চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। এ রকম একটা মন্তব্য ভুট্টো বলুন আর না-ই বলুন, তাতে কী এসে যায়। ভুট্টোর উক্তির নিক্তিতে দুই নেতাকে মাপতে হবে কেন?

ফরহাদ ভিন্ন একটি পোস্টে ভুট্টোর ওই মন্তব্যের বরাতে লিখেছেন, ‘যেমন পরশু দিন তাজউদ্দীন আহমদের জন্মবার্ষিকীতে দেখলাম ভুট্টোর সেই কথিত মন্তব্য অহরহ শেয়ার হতে। যেই মানুষটা পাকিস্তানের একের পর এক মিলিটারি রেজিমদের দৌড়ের ওপর রাখলেন, ভুট্টো তাকে তাচ্ছিল্য করবে, এই কথা তো ভুট্টো নিজের হাতে লিখে গেলেও বিশ্বাস করতাম না।’ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারীর জনগণের ট্যাক্সের টাকায় খেয়েদেয়ে কি আর কোনো কাজ নেই? তাজউদ্দীন সম্পর্কে তাঁর এ রকম আরও পোস্ট ও কটূক্তি আছে, যা অন্যায্য এবং অনাকাঙ্ক্ষিত। সে কারণেই অনেকের ধারণা, তাজউদ্দীন পরিবারের বিরুদ্ধে এটি একটি সুপরিকল্পিত বিরুদ্ধ প্রচারণার অংশ।

ফরহাদের বাক্‌স্বাধীনতাকে অবশ্যই শ্রদ্ধা জানাতে হবে এবং এই বাক্‌স্বাধীনতার মধ্যে ভুল করা বা ভুল বোঝার অধিকারও আছে। কিন্তু মুশকিল হলো, আলোচ্য পোস্টগুলো তাঁর বর্তমান পদমর্যাদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পেলেও তিনি এ মুহূর্তে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ যদি দলগতভাবে একটা অবস্থান নেওয়া জরুরি মনে করে, তবে সেটা বলার জন্য দলে আরও লোক আছে। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারীকে বলতে হবে কেন?

তাজউদ্দীন আহমদের পরিবারের সদস্যরা কোনো বই লিখলে বা তাঁরা কোনো মন্তব্য করলে, তার সঙ্গে ভিন্নমত করা যাবে না, বিষয়টি অবশ্যই তা নয়। ভুলভাবে কেউ ভিন্নমত করলেও ইতিহাস বদলে যায় না। কিন্তু একটা নীতিগত জায়গা থেকে প্রশ্নটা তুলছি, ফরহাদ যেসব মন্তব্য করেছেন, তার সঙ্গে একটি গুরুতর আচরণবিধি ব্যত্যয়ের বিষয় জড়িত। এটা অসদাচরণের পর্যায়ে পড়ে কি না, সেটা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় খতিয়ে দেখতে পারে। সোহেল তাজ যে বিবৃতিটি দিয়েছেন, তা ‘তাজউদ্দীন আহমদ এবং জোহরা তাজউদ্দীন আহমদের পরিবারের পক্ষ’ থেকে দেওয়া হয়েছে। বোঝা যায়, সাংসদ সিমিন হোসেন রিমিসহ সব ভাইবোন মিলেই একটি শক্ত অবস্থান নিয়েছেন। সোহেল তাজ পরিবারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে একটি বিবৃতি দাবি করেছেন। সোহেল তাজ তাঁর ভিডিও বিবৃতির শুরুতেই বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু জাতির জনক, তিনি জাতির পিতা। এ নিয়ে কোনো সন্দেহ বা বিতর্ক থাকতে পারে না, অবকাশ নেই। বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধু অবিচ্ছেদ্য, যত দিন বাংলাদেশ থাকবে, তত দিন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি ও জাতির পিতা হিসেবে স্বর্ণোজ্জ্বল আলোয় তিনি আলোকিত থাকবেন।’

ওই কর্মকর্তা একজন প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ রাজনীতিক। ব্যারিস্টার হয়েছেন বিলাতে। তিনি যে পদে আছেন, ব্রিটেনে সেটাকে বলে স্পেশাল অ্যাডভাইজার। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের অনধিক ৫০ জন এমন পদমর্যাদার কর্মকর্তা আছেন। আইন দ্বারা তাঁদের কার্যাবলি সুনিয়ন্ত্রিত। নির্দিষ্ট আচরণবিধি আছে তাঁদের। শর্তগুলো স্থায়ী পাবলিক সার্ভেন্টদের মতোই। সরকার ও সরকারি দলের কাজ কখনো ওভারল্যাপ করতেই পারে। শর্ত বলছে, এ ধরনের ক্ষেত্রেই তাঁরা মন্ত্রীদের পরামর্শ দেবেন। এর যেহেতু রাজনৈতিক মাত্রা থাকবে, তাই সিভিল সার্ভেন্টরা এর সঙ্গে জড়াবেন না। কারণ, এতে তাঁদের রাজনৈতিক নিরপেক্ষতায় বিঘ্ন ঘটতে পারে। শাহ আলী ফরহাদকে নিয়োগের শর্ত বলেছে, তিনি প্রধানমন্ত্রীর সন্তুষ্টি পর্যন্ত চাকরিতে থাকবেন। আমাদের জানামতে, এ রকম পদধারীদের জন্য নির্দিষ্ট আচরণবিধি নেই। কিন্তু থাকা দরকার।

সোহেল তাজ লিখেছেন তঁার সম্পর্কে, ‘আমরা তার বাপ–দাদা–পরিবার বা ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে ভদ্রতার খাতিরে এখানে উল্লেখ করছি না।’ তাঁর বিবৃতির এই অংশটি সাধারণভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। তবে আমরা জানি, এ রকম পূর্ব বৃত্তান্তের (স্বাধীনতাবিরোধী) অনেকের সরকারি চাকরি আটকে গেছে, যা অনুচিত। ব্যক্তিকে তাঁর জন্ম দিয়ে বিচার করা সাংবিধানিকভাবে বারণ আছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে বধ্যভূমির ভূমি দখলে তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে বিরাট অভিযোগ আছে। দেখতে হবে, তিনি সে ক্ষেত্রে নিজের প্রভাব খাটানোর কোনো চেষ্টা করছেন কি না। 

মিজানুর রহমান খান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক