তালেবান তাদের আসল চেহারা দেখাচ্ছে

আফগানিস্তানে মেয়েদের জন্য ফের বোরখা পরা বাধ্যতামূলক করেছে তালেবান সরকার
ছবি: এএফপি

আফগানিস্তানে তালেবান সরকার তাদের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিধিবিধান কার্যকর করার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করছে। তারা যেটিকে ঠিক মনে করছে, তারা সেটিই করছে। তাদের দেশ শাসনের সক্ষমতা, জননিরাপত্তার হুমকি মোকাবিলা এবং মানবাধিকার নিশ্চিত করার বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় প্রথম থেকেই যে সন্দেহ প্রকাশ করে আসছিল, তাদের জবাবদিহিহীন কঠোর শাসনপদ্ধতি এবং নারীশিক্ষা ও পর্দাসম্পর্কিত সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন সেই সন্দেহকে বৈধতা দিচ্ছে।

আফগানিস্তান দখলের ৯ মাস পরে তালেবান সম্ভবত বুঝতে পেরেছে, শিগগিরই তাদের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। যে আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য তারা বছরের পর বছর ধরে লড়াই করেছে, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য সেই আদর্শের বিষয়ে এখনো ছাড় দিচ্ছে বলে তাদের মধ্যে নিদারুণ হতাশাও কাজ করছে। স্পষ্টতই নিজ দর্শন পরিবর্তন করার এবং সাধারণ আধুনিক রাজনৈতিক নেতাদের মতো দেশ চালানোর কোনো অভিপ্রায় তালেবানের নেই। এখন তারা ধীরে ধীরে তাদের আসল অ্যাজেন্ডাগুলো বাস্তবায়ন করা শুরু করেছে। এটি তারা হয় রাজনৈতিক চাল হিসেবে, নয়তো আদর্শিক বিশ্বাস বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে করছে।

আসন্ন দিনগুলোতে এর আসল কারণ স্পষ্টতর হবে। যেমনটা ভাবা হচ্ছিল, সেভাবেই তালেবান সরকার আফগান নারীদের ওপর আগের চেয়ে বেশি বিধিনিষেধ আরোপ করতে শুরু করেছে। অনেক সরকারি চাকরিতে নারীদের নিষিদ্ধ করা হয়েছে। মেয়েদের মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা অর্জন করতে দেওয়া হচ্ছে না। নিজ শহর কিংবা দেশের বাইরে তাঁদের একা ভ্রমণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এখন তারা আরেকটি আদেশ জারি করেছে। সেটি হলো: নারীদের বাধ্যতামূলকভাবে জনসমক্ষে বোরকা পরতে হবে।

আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির শর্ত হিসেবে প্রত্যেক দেশকেই কিছু মৌলিক বাধ্যবাধকতা মানতে হয়। এটি মানবাধিকারের পাশাপাশি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সর্বজনীন আইন ও রাজনৈতিক নিয়মগুলোকে স্বীকার করার আহ্বান জানায়। এসব বাধ্যবাধকতা প্রায়ই অনেক দেশের সামাজিক এবং রাজনৈতিক নিয়মে পরিবর্তন ঘটায়।

তালেবান ভেবেছিল, তারা নারীশিক্ষা এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক কাঠামোর বিষয়ে হালকা কিছু প্রতিশ্রুতি দিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে প্রতারিত করতে পারবে। তারা হয়তো ভেবেছিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের জব্দ করা তহবিল অবমুক্ত করে দিলে এবং কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিলেই তারা তাদের আসল অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন করা শুরু করবে। তাদের ক্রিয়াকলাপকে সমর্থন করে কেউ কেউ হয়তো বলতে পারেন, রক্ষণশীল মানসিকতার তালেবান সদস্যরা বৈশ্বিক বাস্তবতার সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে সময় নেবেন। কিন্তু এখনকার বাস্তবতা হলো, তারা তাদের প্রতিবেশীদের নিরাপত্তার উদ্বেগ নিরসনেও ব্যর্থ হয়েছে।

ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদন ইঙ্গিত করে, আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক পতন পাকিস্তানকে তার আর্থিক অবস্থা পুনরুজ্জীবিত করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করছে। আশ্রয় এবং জীবিকা খুঁজতে হাজার হাজার দরিদ্র আফগান নাগরিক পাকিস্তানে গিয়েছে। এই জনগোষ্ঠী পাকিস্তানের জন্য বাড়তি বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তালেবান সরকার জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট খোরাসানের (আইএস-কে) হুমকি মোকাবিলায় ব্যর্থ হয়েছে। বিষয়টি এখন আফগানিস্তানকে তার প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করা দুরূহ করে ফেলছে। এই আইএস-কের বৃহত্তর আঞ্চলিক এবং আদর্শিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা রয়েছে এবং তারা তালেবান শাসনের জন্য অভ্যন্তরীণ সমস্যা তৈরি করছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে চীন, রাশিয়া, পাকিস্তান এবং মধ্য এশিয়ার রাষ্ট্রগুলো আশাবাদী ছিল যে তালেবান শাসন আইএস-কে গোষ্ঠীকে তাদের আঞ্চলিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণে বাধা দিতে পারবে।

তালেবান নেতৃত্ব বড় গলায় দাবি করেছিল, তারা কয়েক সপ্তাহের মধ্যে এই জঙ্গিগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করতে পারবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো গোষ্ঠীটি শুধু পাকিস্তান, তাজিকিস্তান ও উজবেকিস্তানেই তাদের তৎপরতা সম্প্রসারিত করেনি, বরং তারা তালেবানের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জকেও জটিল করেছে। আইএস-কে ক্রমাগত সারা দেশে শিয়া সম্প্রদায়কে নিশানা করছে। এতে তালেবানের বিরুদ্ধে শিয়া সম্প্রদায়ের ক্ষোভ বাড়ছে, কারণ তালেবান সব আফগান নাগরিকের পূর্ণ নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।

পাকিস্তান তার ভূখণ্ডে তৎপর তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) নিয়ে উদ্বিগ্ন। আর এই টিটিপি তালেবান শাসনের পূর্ণ সমর্থন উপভোগ করছে। টিটিপি ক্রমাগত পাকিস্তানে নিরাপত্তা বাহিনীকে নিশানা করে হামলা করছে। শুধু এপ্রিল মাসেই টিটিপি এবং এর সহযোগী জঙ্গিরা ১৯টি সন্ত্রাসী হামলা এবং একটি আন্তসীমান্ত হামলা চালায়।

পাকিস্তান আফগান সরকারকে ‘পাক-আফগান সীমান্ত অঞ্চল সুরক্ষিত করতে এবং সন্ত্রাসী কার্যকলাপে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে’ বলেছে। আফগানিস্তান থেকে টিটিপির নেতাদের বিতাড়িত করার জন্য পাকিস্তান বারবার তালেবানকে বলে আসছে। কিন্তু তালেবান টিটিপিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে বা পাকিস্তানে আক্রমণ করা থেকে টিটিপিকে বিরত রাখতে কোনো উল্লেখযোগ্য চেষ্টা করেনি। আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তালেবানের ব্যর্থতার পরিণতি নিয়েও পাকিস্তান উদ্বিগ্ন।

আরও পড়ুন

ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদন ইঙ্গিত করে, আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক পতন পাকিস্তানকে তার আর্থিক অবস্থা পুনরুজ্জীবিত করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করছে। আশ্রয় এবং জীবিকা খুঁজতে হাজার হাজার দরিদ্র আফগান নাগরিক পাকিস্তানে গিয়েছে। এই জনগোষ্ঠী পাকিস্তানের জন্য বাড়তি বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আরেকটি বিষয় হলো, পাকিস্তান ধীরে ধীরে তালেবানের ওপর তার প্রভাব হারাচ্ছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এখনো পাকিস্তানের ওপর চাপ দিচ্ছে। তারা চায় পাকিস্তান তালেবানকে আফগান নাগরিকদের মৌলিক মানবাধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে এবং সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধের প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে চাপ দিক। কিন্তু আফগান নারীদের ওপর আরোপিত বিধিনিষেধসহ সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড এ ইঙ্গিত দেয় যে তালেবান তাদের আদর্শিক বিষয়গুলোর সঙ্গে আপস করবে না এবং শিগগিরই তারা আরও অতি-রক্ষণশীল চেহারা প্রকাশ করতে থাকবে।

তালেবানের এ তৎপরতার কারণে আফগানিস্তানের সমাজ পিছিয়ে যাচ্ছে এবং তাদের জন্য পাকিস্তানও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পরিহাসের বিষয় হলো, পাকিস্তানে তালেবানের সমর্থকেরা আফগানিস্তানে কঠোর ধর্মীয় নিয়ম আরোপ করায় উল্লসিত হচ্ছে। এটি পাকিস্তানের জন্যও ভয়ের কথা।

ডন থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

মোহাম্মাদ আমির রানা পাকিস্তানের একজন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক