তিনি নায়ক হিসেবেই থেকে যাবেন

ফিদেল কাস্ত্রো
ফিদেল কাস্ত্রো

শেষমেশ ৯০ বছর বয়সে মারা গেলেন ফিদেল কাস্ত্রো। কিন্তু এর আগে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ ৬৩৮ বার তাঁকে হত্যার চেষ্টা করেছে। দ্য গার্ডিয়ান-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই হত্যাচেষ্টার মধ্যে যেমন সরাসরি বোমাবর্ষণের ঘটনা আছে, তেমনি গুলিবর্ষণেরও। আবার সিআইএ কিছু হাস্যকর প্রচেষ্টাও নিয়েছিল। একবার তারা ফিদেলের জন্য এক ডাইভিং স্যুট বানানোর পরিকল্পনা করেছিল। মানে এই স্যুটে এত পরিমাণে ফাঙ্গাস থাকবে যে তাতে পরিধানকারী চামড়ার মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাবে।
কিন্তু ব্যাপারটা একটু বেশি বেশি মনে হাতে পারে। কারণ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি পরাশক্তি তার পেনসিলভানিয়া রাজ্যের চেয়েও ছোট একটি দেশের নেতাকে মারতে এতবার চেষ্টা করবে, কেন? কিন্তু তার মানে এই নয় যে, যুক্তরাষ্ট্রের নেতারা স্নায়ুবৈকল্যে ভুগে এসব কাণ্ড করেছেন।
কথা হচ্ছে, ১৯৫৯ সালে কিউবার বিপ্লব সফল হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র এটা দেখানোর চেষ্টা করল যে দেশটিতে শুধু আদর্শিক বিপর্যয়ই সৃষ্টি হয়নি, তারা একদম অস্তিত্বের সংকটেও পড়েছে। ১৯৬০ সালে তৎকালীন মার্কিন সিনেটর জন এফ কেনেডি কিউবা সম্পর্কে বলেন, ‘এক কমিউনিস্ট-ভীতি পশ্চিম গোলার্ধের নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলেছে।’ ওখানেই শেষ নয়। এই তো সেদিন ২০০২ সালেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথাকথিত গণবিধ্বংসী অস্ত্র মজুতের দায়ে কিউবাকে ‘অশুভ অক্ষে’ অন্তর্ভুক্ত করে।
ফিদেলকে দানব বানানোর অনেক চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু অস্তিত্বের হুমকির মুখে পড়লে যুক্তরাষ্ট্র খুব খারাপ হয়ে যায়, সে কারণেই তাদের এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। মিসাইল-সংকটের সময় আমরা যার নগ্ন রূপ দেখেছি। মার্কিন দাপ্তরিক নথিপত্রে কিউবার মিসাইল-সংকটের সময়কে এভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে: সোভিয়েত ইউনিয়ন কিউবায় ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপন করে পৃথিবীকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, কিউবায় এই ক্ষেপণাস্ত্র বসানোর আগে যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নকে তাক করে তুরস্কে ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপন করেছিল। অন্যদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট কেনেডি যেভাবে কিউবায় সন্ত্রাসের আগুন ছড়িয়ে দিয়েছিলেন, তার পরিপ্রেক্ষিতে দেশটিতে সোভিয়েত ক্ষেপণাস্ত্র না থাকলে কাস্ত্রোকে তারা ক্ষমতাচ্যুত করে ছাড়ত। বস্তুত ওই ক্ষেপণাস্ত্র একধরনের প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করেছে।
এ ছাড়া নোম চমস্কি বলেছিলেন, রুশ নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ এই মিসাইল-সংকট নিরসনের লক্ষ্যে যে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তা প্রত্যাখ্যান করে মানবতার ভাগ্য নিয়ে জুয়া খেলেছে। অস্ত্র বা ক্ষেপণাস্ত্র-বিষয়ক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বৈত নীতির প্রসঙ্গে চমস্কি তির্যক মন্তব্য করেছেন: ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেপণাস্ত্র ভান্ডার অনেক শক্তিশালী। সোভিয়েত সেনাবাহিনী তাদের তুলনায় দুর্বল। ফলে শান্তির জন্য তাদের হুমকি ভাবা যায় না। বিষয়টা হচ্ছে, আমাদের পশ্চিম গোলার্ধসহ অন্যান্য এলাকার অনেক মানুষই এই সাক্ষ্য দেবে যে তারা কিউবার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসী যুদ্ধের ভুক্তভোগী।’
১৯৬০ সালে কেনেডির এক বক্তৃতায় আভাস পাওয়া যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেন ফিদেলকে দানব বানাতে চাইত। কেনেডি অভিযোগ করেন, ‘কাস্ত্রো কয়েক বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের মার্কিন সম্পদ আত্তীকরণ করেছেন।’ আর তিনি যে মার্কিন ধ্বজাধারী স্বৈরশাসক বাতিস্তাকে উৎখাত করেছেন। বিষয়টা হচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তো এ কথা বলতে পারত না যে, তারা কিউবায় আটকে থাকা মার্কিন সম্পদ ছাড় করাতে চায়। সে কারণে তারা এক প্রতারণামূলক সুভাষণ প্রয়োগ করল: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘কিউবার মানুষের স্বাধীনতা চায়।’
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিউবার রাজনৈতিক বন্দী ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতাহীনতা নিয়ে অনেক কচকচি করেছে। কিন্তু এই দেশটি যেভাবে ক্ষমতা-কাঠামোর বিরোধী মানুষদের হেনস্তা করেছে, তাতে তার এসব দাবি ধোপে টেকে না। এমনকি সে তো সেন্সরশিপকেও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে চায়। চেলসি ম্যানিং ও এডওয়ার্ড স্নোডেনের বেলায় আমরা যেটা দেখলাম।
কিউবায় স্বাধীনতা নেই, মার্কিনদের এসব ওজর-আপত্তি এ কারণে ধোপে টেকে না যে তারা কিউবার একটি অংশ দখল করে একটি অবৈধ কারাগার বানিয়েছে। বন্দীদের অনির্দিষ্ট সময় ধরে আটকে রাখা, নির্যাতন করা, জোর করে খাওয়ানো বা হত্যা করার উদ্দেশে্য এই কারাগারটি বানানো হয়েছে।
হ্যাঁ, এটাও আবার ঠিক যে কাস্ত্রোর কিউবা বাক্-স্বাধীনতা বা সে সম্পর্কিত অধিকারের স্বর্গভূমি নয়। ২০০৬ সালে আমি যখন এক মাস সেখানে ছিলাম, তখন দেখেছি, সরকারপক্ষ ত্যাগ করা কিছু মানুষ ফিসফিস করে কাস্ত্রোর নাম উচ্চারণ করছে। কিউবার সমাজ মুক্ত নয়। কিন্তু এটাও মনে রাখা দরকার যে কিউবার নাগরিকদের এই অধিকার হরণের ব্যাপারটা শূন্যের মধ্যে ঘটেনি। যুক্তরাষ্ট্র সব
সময়ই ফিদেলকে উৎখাত করতে চেয়েছে, যাদের সঙ্গে ছিল কিউবা থেকে পালিয়ে আসা নির্বাসিত মানুষেরা, যারা সন্ত্রাসবাদ ও অন্তর্ঘাত করত। ফলে রাষ্ট্রটি যে মানসিক বৈকল্যে আক্রান্ত হয়েছে, তা এমনি এমনি হয়নি।
এসব সত্ত্বেও ফিদেলের কিউবা অনেক বিষয়েই কার্পণ্য করেনি। দেশটির মানুষ রাষ্ট্রের কাছ থেকে অন্ন, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষা পেয়েছে। স্বাস্থ্য খাতে মাথাপিছু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে অনেক কম খরচ করলেও কিউবায় শিশুমৃত্যুর হার তার উত্তরের এই প্রতিবেশীর তুলনায় অনেক কম। দেশটিতে জনপ্রতি চিকিৎসকের সংখ্যা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি। এর বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র স্বাস্থ্যসেবার মতো মৌলিক বিষয়কে লাভজনক মুনাফায় পরিণত করে মানববিরোধী অবস্থান নিয়েছে। একই সঙ্গে দেশটিতে গৃহহীন মানুষের সংখ্যাও কম নয়। এটা এমন এক দেশ, যেখানে সাদাদের তুলনায় কালোরা অনেক বেশি নির্যাতিত হয় ও জেল খাটে, যেখানে উচ্চশিক্ষা নিতে গেলে মানুষকে ঋণে জর্জরিত হতে হয়। আর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অভিভাবকেরা শিশুদের খাবারের টাকা দিতে না পারলে তাদের দুপুরের খাবার বন্ধ করে দেওয়া হয়। কথা হচ্ছে, কিউবা যে মানুষকে বিনা মূল্যে মৌলিক সেবা দিতে পারে তাতে এটা কিঞ্চিৎ প্রমাণিত হয় যে একটি দেশ যুদ্ধের জন্য ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় না করলে এ ধরনের কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারে।
কিউবা যুদ্ধ বা বিপর্যয় রপ্তানি করেনি। এর বদলে তারা চিকিৎসক রপ্তানি করেছে। ২০০৯ সালে নিউইয়র্ক টাইমস প্রতিবেদন করে, বিপ্লবের পর কিউবা অন্তত ১০৩টি দেশে ১ লাখ ৮৫ হাজারেরও বেশি চিকিৎসাকর্মীকে পাঠিয়েছে।
কিউবা-ভীতি নিয়ে গত কয়েক দশকে অনেক হট্টগোল হয়েছে। কিন্তু কাস্ত্রো কখনোই যুক্তরাষ্ট্রের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হননি। বরং তিনি যে উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন, বিপদটা সেখানেই নিহিত। মানব অস্তিত্বের ওপর যুক্তরাষ্ট্র যে স্বঘোষিত একক আধিপত্য বিস্তার করেছিল, তার প্রতি চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন তিনি। আর তাই হৃদয়পটে তিনি নায়ক হিসেবেই থেকে যাবেন।
আল-জাজিরা থেকে নেওয়া। অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন।
বেলেন ফার্নান্দেজ: জ্যাকবিন ম্যাগাজিনের কন্ট্রিবিউটিং এডিটর।