তিন কঠিন মুহূর্তে বেগম মুজিব

শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব
শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব

আজ আমি লিখতে যাচ্ছি এক নারীকে নিয়ে, বাংলাদেশের একজন শাশ্বত নারী, সাধারণের বেশে যিনি অসাধারণ, গৃহিণী হয়েও যিনি বাংলাদেশের ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে রেখেছিলেন খুব বড় ভূমিকা।
তাঁর নাম ফজিলাতুন্নেছা। শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। বঙ্গবন্ধু যাঁকে ডাকতেন রেণু বলে।
শেখ মুজিবের বয়স যখন এগারো, তখন শিশু রেণুর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। রেণু গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়েছিলেন। তিনি তাঁর মা-বাবাকে হারিয়েছিলেন শৈশবে, শাশুড়ির কাছে মানুষ হয়েছিলেন। পড়াশোনার প্রতি ঝোঁক ছিল, বাড়িতে শিক্ষক রেখে বাংলা, ইংরেজি, আরবি পড়েছেন; প্রচুর গল্পের বই পড়তেন আর গান শুনতেন।
তাঁর স্বামী কলকাতায় পড়তেন। রাজনীতি করতেন। মাঝেমধ্যে আসতেন টুঙ্গিপাড়ায়। ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তাঁদের বড় মেয়ে শেখ হাসিনার জন্ম হয়। তখন শেখ মুজিবের বয়স ২৭। বেগম মুজিবের বয়স ১৭ কি ১৮। বঙ্গবন্ধু রাজনীতি করতেন, জেলেই থাকতেন বেশির ভাগ সময়, ছেলেমেয়ে-সংসার সামলাতেন বেগম মুজিব। ছেলেমেয়েদের সুরুচিও গড়ে উঠেছে মায়ের কাছ থেকে পাওয়া শিক্ষা-দীক্ষা থেকেই।
শেখ রেহানা প্রথম আলোয় লিখেছিলেন, ‘আর আমার মা! তাঁর কথা ভাবি। কত অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছে। মাত্র ৪৪ বছর বয়সে তো তিনি আমাদের ছেড়ে চলেই গেলেন। কত অল্প বয়সে এতগুলো ছেলেমেয়ে নিয়ে তাঁকে জীবন-সংগ্রামে নেমে পড়তে হয়েছিল। আব্বা আগের দিন মন্ত্রী, পরের দিন জেলখানায়; বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে সরকারি বাসা ছেড়ে দিতে হয়েছে, কিন্তু কেউ মাকে বাসা ভাড়া দিচ্ছে না, আমার তখনো জন্ম হয়নি, কিন্তু এসব ঘটনা তো শুনেছি, পড়েছি, পরে নিজের চোখে দেখেছি। গ্রামে জন্ম হওয়া একজন সাধারণ নারী আমার মা, ক্লাস ফোর-ফাইভ পর্যন্ত পড়েছেন মিশনারি স্কুলে। কিন্তু কী যে প্রজ্ঞা, কী যে তাঁর ধৈর্য। আমার মায়ের কাছে আমাদের যে জিনিসটা সবার আগে শেখা উচিত, তা হলো ধৈর্য আর সাহস। সবাইকে এক করে রাখা। এতগুলো লোক বাড়িতে খাচ্ছে, দাচ্ছে, আমাদের গ্রামে কোন মেয়ে ম্যাট্রিক পাস করেছে, তাকে এনে ঢাকায় কলেজে ভর্তি করে দাও, কাকে বিয়ে দিতে হবে! সব সামলাচ্ছেন। এর মধ্যে আমাদের সকালে কোরআন শরিফ পড়া শেখাতে মৌলভি সাহেব আসছেন, তারপর নাচ শিখছি, সেতার শিখছি, বেহালা শিখছি—সব কিন্তু মায়ের সিদ্ধান্ত। কিন্তু তাঁর নিজের বয়স কত! আমার তো মনে হয়, আমার মা কি কোনো দিন তাঁর শৈশবে কিংবা কৈশোরে একটা ফিতা বা রঙিন চুড়ি চেয়েছেন কারও কাছে! মা-ই তো সব থেকে বঞ্চিত ছিলেন। অথচ তিনি হাসিমুখে সব সামলাচ্ছেন।’
বেগম মুজিবের ধৈর্য ছিল। আন্তরিকতা ছিল। উদারতা ছিল। সংসারের হাত শক্ত করে ধরার ক্ষমতা আর দক্ষতা ছিল। তাঁদের বাড়িতে যে–ই আসত, তাকেই খাবার টেবিলে বসানো হতো। সব সময়ই বেশি করে রান্নাবান্না করতে হতো। কামরুদ্দীন আহমদ তাঁর বইয়ে লিখেছিলেন, বঙ্গবন্ধু জাতির জনক হতে পেরেছিলেন বেগম মুজিবের সমর্থনের কারণে। বেগম মুজিব কখনো বলেননি, তুমি রাজনীতি কোরো না, তুমি জেলে গেলে আমাদের কী হবে। বরং বলেছেন উল্টোটা। তুমি দেশের জন্য কাজ করো, আমাদের কথা ভেবো না।
এ তো গেল একজন সাহসী দক্ষ গৃহবধূরই ভূমিকার কথা।
কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাসের তিনটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে বেগম মুজিব অসাধারণ প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়ে ইতিহাস-নির্ধারণী ভূমিকা পালন করেছিলেন।

এক.
১৯৬৯ সাল। শেখ মুজিবকে আটকে রাখা হয়েছে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায়। সারা পূর্ব বাংলা বিক্ষোভে ফেটে পড়ছে। ওদিকে ভুট্টোর নেতৃত্বে পশ্চিম পাকিস্তানেও হচ্ছে প্রচণ্ড আইয়ুববিরোধী আন্দোলন। আইয়ুব খান দিশেহারা। এই অবস্থায় তিনি ঠিক করলেন তিনি গোলটেবিল বৈঠক করবেন রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে। শেখ মুজিবকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে লাহোরে নিয়ে যাওয়া হবে।
এই সময় বেগম মুজিব ভেবেচিন্তে দেখলেন, প্যারোলে মুক্তি নেওয়া ঠিক হবে না। শেখ মুজিব যদি গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নিতে যান, তাঁকে অবশ্যই নিঃশর্ত মুক্তি অর্জন করে নিতে হবে। শেখ হাসিনার কিছু স্মৃতি কিছু কথা (মঞ্জুরুল ইসলাম) বইয়ে শেখ হাসিনা জানাচ্ছেন, ‘ওই সময় প্লেন রেডি—তখন তেজগাঁও এয়ারপোর্টে। আব্বাকে উঠায়ে নিয়ে যাবে...আওয়ামী লীগের নেতারাও নেমে পড়েছে এবং সব চলে গেছে ক্যান্টনমেন্টে আব্বাকে যেখানে বন্দী করে রেখেছে ওইখানে। মার কাছে খবর আসল, আমি ঢাকা ভার্সিটিতে। মা আমাকে খবর পাঠালেন, শিগগির আয়।...
বেগম মুজিব তাঁর বড় মেয়ে আর জামাতা ওয়াজেদ মিয়াকে পাঠালেন ক্যান্টনমেন্টে। চিরকুট দিলেন। শেখ হাসিনা আর ওয়াজেদ সাহেবকে শিখিয়ে দিলেন কী বলতে হবে। বেগম মুজিবের কড়া নির্দেশ, জনগণ তোমার সঙ্গে আছে। তুমি কিছুতেই প্যারোলে মুক্তি নেবে না। তোমাকে বীরের বেশে মাথা উঁচু করে বেরিয়ে আসতে হবে।
শেখ হাসিনা জানাচ্ছেন, পিতার কাছে মায়ের বার্তা পৌঁছে দিয়ে ফেরার পর নেতারা তাঁকে বলেছিলেন, তুমি কেমন মেয়ে, বাবার মুক্তি চাও না। শেখ হাসিনা অনেক কেঁদেছিলেন।
কিন্তু বেগম মুজিবের সেদিনের পরামর্শ সঠিক বলে প্রমাণিত হলো। জান্তা শেখ মুজিবকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হলো। শেখ মুজিব বেরিয়ে এলেন বঙ্গবন্ধু হিসেবে।

দুই.
৭ মার্চ। ১৯৭১। সারা বাংলা বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে। মার্চ থেকেই বাংলা কার্যত স্বাধীন। সবকিছু চলছে আওয়ামী লীগের নির্দেশে। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তৈরি করা হয়েছে। ২ মার্চ ছাত্ররা সেই পতাকা উড়িয়ে দিয়েছে, তুলে দিয়েছে বঙ্গবন্ধুর হাতে। এরই মধ্যে ‘অ্যাসেম্বলি’ স্থগিতের ইয়াহিয়া খানের ঘোষণা বারুদে অগ্নিসংযোগ ঘটিয়েছে মাত্র। সারা বাংলা জ্বলছে। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চে ভাষণ দেবেন। কী বলবেন তিনি। ছাত্ররা চায়, আজই বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করুন আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বঙ্গবন্ধু আমেরিকানদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন, তারা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, স্বাধীনতা ঘোষণা করলে তারা সমর্থন করবে না। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ফোন করে অনুরোধ করেছেন, সবকিছু বন্ধ করে দেবেন না। অপারেশন ব্লিৎসের পরিকল্পনা আঁটা হয়েছে। রেসকোর্স ময়দানে সমবেত লাখ লাখ মানুষের ওপর দিয়ে হেলিকপ্টার চক্কর দিচ্ছে। এই অবস্থায় বঙ্গবন্ধু কী করবেন। শেখ হাসিনা একই বইয়ে জানাচ্ছেন, বাসায় গিজগিজ করছে মানুষ। বেগম মুজিব সবাইকে তাঁদের ঘর থেকে বাইরে যেতে বললেন। ঘরে তখন বঙ্গবন্ধু, বেগম মুজিব আর হাসিনা। তিনি বললেন, তুমি ১০টা মিনিট শুয়ে রেস্ট নাও। শেখ হাসিনার ভাষায়—‘আমি মাথার কাছে বসা, মা মোড়াটা টেনে নিয়ে আব্বার পায়ের কাছে বসলেন। মা বললেন, মনে রেখো তোমার সামনে লক্ষ মানুষের বাঁশের লাঠি। এই মানুষগুলির নিরাপত্তা এবং তারা যেন হতাশ হয়ে ফিরে না যায় সেটা দেখা তোমার কাজ। কাজেই তোমার মনে যা আসবে তাই তুমি বলবা, আর কারও কোনো পরামর্শ দরকার নাই। তুমি মানুষের জন্য সারা জীবন কাজ করো, কাজেই কী বলতে হবে তুমি জানো। এত কথা, এত পরামর্শ কারও কথা শুনবার তোমার দরকার নেই। এই মানুষগুলির জন্য তোমার মনে যেটা আসবে, সেটা তুমি বলবা।’
বঙ্গবন্ধু ১০ মিনিট বিশ্রাম করলেন, গাড়িতে উঠলেন, শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে রবীন্দ্রনাথের মতো হেঁটে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন, এবং শোনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি—‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বললেন, ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো, তোমাদের যার যা কিছু তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো।’ একই সঙ্গে স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন, গেরিলাযুদ্ধের নির্দেশ দিলেন। অথচ আইনত কেউ তাঁকে আটকাতে পারবে না। সারা পৃথিবী দেখল, শেখ মুজিবের সংগ্রাম আইনানুগ অসহযোগ সংগ্রাম, যা কিনা মহাত্মা গান্ধীজি করেছিলেন ভারতের স্বাধীনতা অর্জনে। পৃথিবীতে এ রকম কঠিন সময়ে এর চেয়ে রাজনৈতিকভাবে সঠিক ভাষণ আর কেউ কোথাও দিয়েছেন বলে মনে হয় না।

তিন.
১৯৭১ সাল। ২৩ মার্চ। পাকিস্তানের জাতীয় দিবসে বাংলার ঘরে ঘরে উঠেছে বাংলার পতাকা। এদিকে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আলোচনা চলছে। এম এ ওয়াজেদ মিয়া তাঁর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ বইয়ে লিখেছেন, ‘ওই দিন দুপুরে বঙ্গবন্ধু কারও সঙ্গে কোনো কথা না বলে গম্ভীরভাবে খাচ্ছিলেন। একপর্যায়ে শাশুড়ি বঙ্গবন্ধুকে বললেন, “এত দিন ধরে যে আলাপ-আলোচনা করলে, তার ফলাফল কী হলো কিছু তো বলছ না। তবে বলে রাখি, তুমি যদি ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সমঝোতা করো, তবে একদিকে ইয়াহিয়া খানের সামরিক বাহিনী সুবিধামতো সময়ে তোমাকে হত্যা করবে, অন্যদিকে এ দেশের জনগণও তোমার ওপর ভীষণ ক্ষুব্ধ হবে।” এ কথা শুনে বঙ্গবন্ধু রাগান্বিত হয়ে শাশুড়িকে বলেন, “আলোচনা এখনো চলছে, এই মুহূর্তে সবকিছু খুলে বলা সম্ভব না।” এই পর্যায়ে শাশুড়ি রেগে গিয়ে নিজের খাবারে পানি ঢেলে দ্রুত ওপরতলায় চলে যান। তিনি না খেয়ে সারা দিন শুয়ে থাকলেন, কারও সঙ্গে কথা বললেন না।’
এই একটা ঘটনাই তো যথেষ্ট, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে বেগম মুজিবের ভূমিকা কত গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা বোঝার জন্য। সহজ কথা—তুমি জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে ব্যর্থ হলে জনগণ তোমার কাছ থেকে সরে যাবে, তখন জান্তা তোমাকে মেরে ফেলতে পারবে। কাজেই আপস কোরো না। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রিত্ব নয়, তোমার চাই স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধুও তা-ই বলেছেন, বারবার, এমনকি নির্বাচনের আগেও, আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, আমি বাংলার মানুষের অধিকার চাই। আর গেরিলাযুদ্ধ যে করতে হবে, এটা বঙ্গবন্ধু জানতেন, ঢাকাস্থ আমেরিকান কনস্যুলার কর্তাদের সঙ্গে দেখা করে সেটা তিনি আগেই বলে রেখেছিলেন।
বেগম মুজিব পান খেতেন। তাঁর পানের বাটায় সুন্দর করে পান-সুপারি-মসলা সাজানো থাকত। আঁচলে নিশ্চয়ই থাকত এক গোছা চাবি। বাংলার নারীর স্নিগ্ধ রূপটিই আমরা তাঁর মধ্যে দেখতে পাই। কিন্তু রাজনৈতিক প্রশ্নে কী রকম দৃঢ়তা ও দূরদর্শিতার পরিচয় তিনি দিয়েছিলেন, ভেবে ভেবে আশ্চর্য হতে হয়।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আর সবার সঙ্গে তাঁকেও হত্যা করা হলো।
শেখ রেহানা আমাকে বলেছিলেন, ‘আমি তাই আপাকে বলি, আপা, আমরা তো মায়ের চেয়ে বেশি দিন বাঁচলাম।’ মাত্র ৪৪ বছর বয়সে বেগম মুজিব পৃথিবী ছেড়ে চলে যান।
আজকে, নারী দিবসের মাসে, স্বাধীনতার মাসে, বঙ্গবন্ধুর জন্মমাসে এই অসামান্য নারীকে জানাই শ্রদ্ধা।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।