
হেগের পারমানেন্ট কোর্ট অব আর্বিট্রেশন (পিসিএ) যে দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে ফিলিপাইনের মামলায় বাদীপক্ষের সব যুক্তির পক্ষে সায় দিয়েছেন, তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। ইউনাইটেড নেশন্স কনভেনশন অন দ্য ল অব সির আলোকে ফিলিপাইন এ মামলা করেছিল। আদালত খুব কঠোর ভাষায় দক্ষিণ চীন সাগরের ওপর চীনের দাবির বৈধতা নাকচ করে দিয়েছেন।
পিসিএ বলেছেন, চীনের ১৯৪০ সালের ‘নাইন ড্যাশ লাইন’-এর আইনি ভিত্তি নেই, যার মাধ্যমে চীন এই সাগরের ৮০ শতাংশের মালিকানা দাবি করেছিল। আদালত এটাও বলেছেন, চীন যে সম্প্রতি এই সাগরে ডুবন্ত প্রবালকে জাগিয়ে কৃত্রিম দ্বীপ বানানোর চেষ্টা করছে, তাতেও সে নতুন করে মালিকানা দাবি করতে পারে না বা এর মাধ্যমে সে কাউকে ওই এলাকায় বিমান ওড়াতে বা জাহাজ চালাতে বাধা দিতে পারে না। পিসিএর সিদ্ধান্তে এ ধারণা একদম মার খেয়ে যায় যে আন্তর্জাতিক আইন সমুদ্রসীমার ওপর ‘ঐতিহাসিক’ ও ‘প্রথাগত’ দাবি স্বীকার করে, যেটা আসলে প্রাসঙ্গিক ভূমির ওপর সার্বভৌমত্বের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত নয়। বাসযোগ্য দ্বীপের ওপর মালিকানার স্বীকৃতির (মূল ভূমিসহ) মধ্যে আছে ১২ নটিক্যাল মাইল টেরিটোরিয়াল সমুদ্র, ২০০ নটিক্যাল মাইল এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন ও সংযুক্ত কোনো কন্টিনেন্টাল শেলফ বা মহীসোপান (যেখানে অন্যদেরও অধিকার থাকে)। আর বসবাস অযোগ্য পাথরের শিলাখণ্ডের ওপর মালিকানার মধ্যে রয়েছে আশপাশের ১২ নটিক্যাল মাইল টেরিটোরিয়াল সমুদ্রের ওপর মালিকানা, এর বেশি কিছু নয়। অর্থাৎ ভূমি ছাড়া কোনো রাষ্ট্র সমুদ্রের ওপর অধিকার দাবি করতে পারে না।
কিন্তু এসব সত্ত্বেও চীন কার্যকর দখলি স্বত্ব বা মৌন সম্মতির মতো স্বীকৃত আইনি শর্তের কথা বলতে পারে। এর সঙ্গে তার উপকূলের দাবি যুক্ত হলে চীন হয়তো শেষমেশ দক্ষিণ চীন সাগরের বড় অংশের ওপর মালিকানা পেতে পারে। কিন্তু সেটা নাইন ড্যাশ লাইনের সমান হবে না। চীন দাবি করেছিল, তারা সাগরে যে ভূমিপুনরুদ্ধার করেছে তার ওপর যাতে কেউ নজরদারি করতে না পারে। কিন্তু পিসিএ তাদের সেই দাবিও নাকচ করে দিয়েছেন।
ইউনাইটেড নেশন্স কনভেনশন অন দ্য ল অব সি অনুসারে একটি রাষ্ট্র সমুদ্রে নিজেদের এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোনের মধ্যে কৃত্রিম দ্বীপ নির্মাণ করতে পারে বা উন্মুক্ত মালিকানাহীন সমুদ্রেও তা করতে পারে, তবে সেটা শুধু শান্তির জন্য। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, আগের ডুবন্ত কোনো প্রবালকে শিলাখণ্ডে রূপান্তরিত করা যাবে অথবা বসবাস অযোগ্য শিলাখণ্ডকে ‘দ্বীপে’ রূপান্তরিত করা যাবে। ফিলিপাইনের মামলায় এই মৌল নীতিগুলো নিশ্চিত হয়েছে। আর পিসিএ এটাও পরিষ্কার করেছেন, ডুবন্ত মিসচিফ রিফে চীনের কোনো দাবি নেই। কারণ, সেটা ফিলিপাইনের এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোনের মধ্যে পড়ে। মনে হচ্ছে না, চীন যেসব প্রবাল ও শিলাখণ্ডে পা রেখেছে, তার দখল ছেড়ে দেবে। কিন্তু যারা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে চায়, তাদের উচিত হবে চীনকে কিছু পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করা, যাতে সে অন্তত নিজের মুখ রক্ষা করতে পারে।
তাদের উচিত হবে চীনকে বলা, এই সাতটি দ্বীপে যেন সামরিক স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ রাখা হয়, বিতর্কিত অঞ্চলে ভূমি পুনরুদ্ধারের কর্মসূচি বন্ধ রাখা হয়, আর তারা যেন ‘নাইন ড্যাশ লাইনকে’ স্রেফ খসড়া গাইডলাইন ছাড়া অন্য কিছু হিসেবে বিবেচনা না করে। তারা যেন এসব দাবি নিয়ে আলোচনার টেবিলে বসে। তারা যেন দক্ষিণ চীন সাগরের ব্যাপারে সব দেশের জন্য প্রযোজ্য আচরণবিধি নিয়ে আসিয়ানের সঙ্গে আলোচনায় বসে। আর চীনের উচিত হবে, আসিয়ানের দুর্বল দেশ কম্বোডিয়া ও লাওসকে চাপ প্রয়োগ করে আসিয়ানকে অস্থিতিশীল না করা।
এর বিকল্প পথও আছে, যে পথে পিপলস লিবারেশন আর্মির মাথা গরম জেনারেলরা ইতিমধ্যে হাঁটতে শুরু করেছেন। তাঁরা হয়তো নাটকীয়ভাবে কঠিন পথ নিতে পারেন, যেমন তাঁরা ইউনাইটেড নেশন্স কনভেনশন অন দ্য ল অব সিকে অগ্রাহ্য করে দক্ষিণ চীন সাগরের বেশির ভাগ এলাকাকে এয়ার ডিফেন্স আইডেন্টিফিকেশন জোন (এডিআইজেড) ঘোষণা করতে পারেন। এতে সামরিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা বেড়ে যেতে পারে, যার পরিণাম কী হবে আমরা জানি না।
ইউনাইটেড নেশন্স কনভেনশন অন দ্য ল অব সিকে অগ্রাহ্য করা ভুল হবে। সে যদি এটা অগ্রাহ্য করার মতো জায়গায় যায় তাহলে তার ভাবমূর্তি ও ভৌগোলিক স্বার্থ ক্ষুণ্ন হবে, বিশেষ করে পূর্ব চীন সাগরে জাপানের সঙ্গে বিরোধের ক্ষেত্রে তার দাবি দুর্বল হবে, যেটা ইউনাইটেড নেশন্স কনভেনশন অন দ্য ল অব সির মহাদেশীয় শিলাখণ্ড-বিষয়ক বিধানের ওপর নির্ভরশীল।
চীন যদি কঠোর অবস্থানে যায় বা নিজের আচরণ না শোধরায় তাহলে অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলো মিসচিফ রিফের ১২ নটিক্যাল মাইলের মধ্যে জাহাজ চালনার জন্য চাপ দিলে তাদের দাবি জোরালো হবে। কিন্তু এখন আমাদের সবার উচিত হবে চীনকে সময় দেওয়া, যাতে সে সঠিক পথে আসতে পারে আর আঞ্চলিক উত্তেজনা প্রশমিত করতে পারে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট।
গ্যারেথ ইভান্স: অস্ট্রেলিয়ার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী।