দরকার ছিল একটি পূর্ণাঙ্গ নির্বাচন কমিশন আইন

নির্বাচন বিশ্বব্যাপী একটি অতি জনপ্রিয় রাজনৈতিক অনুষঙ্গ। একই কারণে প্রায়োগিক রাজনীতি এবং রাজনীতিবিজ্ঞান অধ্যয়ন ও গবেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে ‘নির্বাচন’ বহুল আলোচিত ও চর্চিত বিষয়। রাজনীতিবিজ্ঞানের নির্বাচন অধ্যয়নের শাখাটি সেপোলজি নামে পরিচিত। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে রাজনীতির প্রধান আলোচ্য বিষয় যদিও গণতন্ত্র ও নির্বাচন, শুধু নির্বাচন নিয়েই এ দেশে অশেষ বিতর্ক। কিন্তু অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মতো নির্বাচন নিয়েও ভালো অধ্যয়ন ও গবেষণা নেই।

আমাদের রাজনৈতিক গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান বিতর্কই হচ্ছে নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা এবং সংবিধানের ১১৮(১)-এর নির্দেশনা অনুযায়ী একটি আইন করে সে আইনের বিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন গঠন ও পরিচালনা। আকস্মিকভাবে বর্তমান কমিশনের মেয়াদপূর্তির ২০-২২ দিন আগে মন্ত্রিপরিষদের সভায় ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য কমিশনার নিয়োগ আইন ২০২২’ শিরোনামে একটি আইনের খসড়া অনুমোদিত হয় এবং অতি দ্রুততা ও ক্ষিপ্রতার সঙ্গে ইসির মেয়াদপূর্তির ১৮ দিন আগে জাতীয় সংসদে আইনটি পাস হলো।

বহুদিন ধরে কমিশনারদের নিয়োগসহ আনুষঙ্গিক সব বিষয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ আইন করার দাবি সর্বমহল থেকে করা হচ্ছিল। তখন সরকারকে খুব একটা আগ্রহী মনে হয়নি। সুদীর্ঘ ৫০ বছর কালক্ষেপণ করে পর্বতের মূষিক প্রসবের মতো একটি অসম্পূর্ণ আইন তৈরি হলো। লিখিত মতামত তৈরি করেও তা পাঠানোর সময় পাওয়া গেল না। তার আগেই শুনি, তিন ঘণ্টার বিতর্কে ৭২টি সংশোধনী প্রস্তাবের বিপরীতে ২২টি গ্রহণ করে বিল পাস হয়ে যায়। অথচ এ সুযোগে নির্বাচন কমিশনবিষয়ক একটি সুন্দর, কার্যকর ও পূর্ণাঙ্গ আইন হতে পারত। আইনটি পাস হয়ে গেলেও বিতর্কের শেষ হয়তো হবে না। কোনো দিন যদি এ আইন সংশোধনের প্রশ্ন আসে, তখন হয়তো নিম্নের পর্যবেক্ষণগুলো ভেবে দেখা যেতে পারে।

১. এ আইন শুধু প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্য কমিশনারদের নিয়োগ আইন নয়, শিরোনাম হওয়া উচিত ছিল ‘নির্বাচন কমিশন আইন-২০২২’। এখানে কমিশনারদের নিয়োগের স্পষ্ট বিধানের সঙ্গে সঙ্গে সংবিধানের নানা নির্দেশনা অনুসরণ করে ইসির কাজ, সংবিধান নির্দেশিত ক্ষমতার প্রয়োগ এবং স্বচ্ছতা, স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণের নানা আইনি ও আইনবহির্ভূত রাজনৈতিক বাধা দূর করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় বিধানাবলি সংযোজন হতে পারত।

২. সংবিধানের নির্বাচন কমিশনবিষয়ক অধ্যায়ের ধারা ১১৮(১) ছাড়াও ১১৮(৪), ১১৯(২) ও ১২৬-এর নির্দেশনা সঠিকভাবে প্রয়োগের জন্য এ আইনে কিছু বিধিবিধান যুক্ত হওয়ার আবশ্যকতা ছিল।

৩. ১১৮(৪)-এ বলা হয়েছে, ‘নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকিবেন এবং কেবল এই সংবিধান ও আইনের অধীন হইবেন।’ এই স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণের জন্য আইনে কিছু বিধান থাকা প্রয়োজন। যেমন কমিশনের অর্থায়ন, নিয়োগ, নির্বাচনকালে নিজ বিবেচনায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ ইত্যাদি বিষয়ে স্পষ্ট আইনি বিধান প্রয়োজন ছিল, যা নানা সংকটময় মুহূর্তে তাঁদের সাহসী সিদ্ধান্তের সহায়ক হতো।

এ আইনকে শুধু ‘নিয়োগ’-এর মধ্যে সীমিত রাখা উচিত হয়নি, দেশে একটি পূর্ণাঙ্গ নির্বাচন কমিশন আইনের প্রয়োজন ছিল। সে প্রত্যাশা পূরণ হলো না। ‘নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো’, নাকি ‘দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভালো’—কোনোটিই বলা যাচ্ছে না।

৪. অনুরূপভাবে প্রয়োজন ১১৯(২) ধারা বলে কমিশনের কর্ম ও দায়িত্ব তালিকায় কিছু সংযোজনের সুযোগ ছিল। যেমন সংবিধান অনুযায়ী ইসির প্রধান দায়িত্ব জাতীয় সংসদ ও রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠান। কিন্তু এই ইসি শুরু থেকেই স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচন করে আসছে। যদিও ‘স্থানীয় সরকার’ নির্বাচন এ কমিশনই করবে, তা সংবিধানে নেই বা নির্বাচন কমিশনের অন্য কোনো আইনেও তা যুক্ত করা হয়নি। প্রতিবার স্থানীয় সরকার বিভাগের নির্বাহী আদেশ বলে কমিশন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন করে থাকে। এ আইনে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচনের বিধানটি সংযোজিত হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মেয়াদ উত্তীর্ণের আগে কমিশন নিজ সিদ্ধান্তে স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচন সম্পন্ন করতে পারত।। তাই এ-জাতীয় একটি বিধান এ আইনে সংযোজিত হতে পারত।

৫. সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সকল নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য হইবে।’ সংবিধানের এ নির্দেশনা কার্যকর করতে হলে আইনের স্পষ্ট বিধান প্রয়োজন। কারণ, কোনো ‘কর্তৃপক্ষ’ যদি নির্বাচন কমিশনের আদেশ-নির্দেশ যথাযথভাবে পালন না করে এবং ‘কর্তব্য’ কর্মে অবহেলা প্রদর্শন করে, তখন তার বা তাদের শাস্তি কীরূপ এবং কীভাবে হবে, তা আইনের মাধ্যমে নিরূপণ করতে হবে। সদ্য পাস হওয়া আইনে এসবের স্পষ্ট প্রতিফলন থাকা দরকার ছিল।

আমাদের দেশে শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অতীতে হয়নি, তা নয়। ২০১৪ সালের পর থেকে নির্বাচন ঘিরে যেসব প্রশ্ন, তার মীমাংসা করে জাতিকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে একটি স্পষ্ট দিকনির্দেশনা প্রয়োজন।

৬. বিলের মূল কেন্দ্রবিন্দু হয়ে পড়েছে ‘অনুসন্ধান কমিটি’ এবং পূর্বের দুই কমিশনের গঠন প্রক্রিয়ার বৈধতাদান। নতুন আইন করে বৈধতা দেওয়ার প্রশ্ন এলে আগের দুই কমিশন সত্যিকার অর্থেই বৈধ ছিল কি না, তা নিয়ে নতুনভাবে প্রশ্ন ওঠে। আমার ব্যক্তিগত মত, এ বৈধতাদানের প্রশ্নটি অবান্তর ও অর্থহীন। এটি আইনের ভাষায় ‘পাস্ট অ্যান্ড ক্লোজড’। এখন ও ভবিষ্যতে সার্চ কমিটি করেই সিইসি ও কমিশনারদের নিয়োগ করতে হবে, তা-ও প্রয়োজনীয় বলে মনে হয় না।

এ ছাড়া বিলে কমিশনারদের যোগ্যতা-অযোগ্যতার যে বিধানাবলি রয়েছে, তা-ও সঠিক মনে হয় না। এগুলোর আরও বিস্তৃতি প্রয়োজন ছিল। একজনের শুধু ৫০ বছর বয়স ও ২০ বছরের সরকারি-বেসরকারি কাজের অভিজ্ঞতাই নির্বাচন কমিশনের সদস্য হওয়ার যোগ্যতা হতে পারে না। আর যোগ্যতা যাচাই প্রক্রিয়ায় গণশুনানি বা সংসদীয় কমিটি কর্তৃক বিশেষ সাক্ষাৎকার সংযোজন করা যেত। ইসির নিয়োগ অন্য দশ-পাঁচটি সাধারণ সরকারি নিয়োগ নয়, জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা যাতে এ দায়িত্ব নিয়ে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে পারেন, সেটি মুখ্য বিবেচ্য বিষয় হওয়া উচিত ছিল এবং এ বিষয়ে অনেকের ভালো সংশোধনীও ছিল, যা উপেক্ষিত হয়েছে।

৭. আমাদের দেশে শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অতীতে হয়নি, তা নয়। ২০১৪ সালের পর থেকে নির্বাচন ঘিরে যেসব প্রশ্ন, তার মীমাংসা করে জাতিকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে একটি স্পষ্ট দিকনির্দেশনা প্রয়োজন। বিশ্বের কোনো দেশই এখন একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। সর্বজনীন ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নিয়মনীতি ও নৈতিকতা মেনে একটি আধুনিক রাষ্ট্রকে এগিয়ে যেতে হয়। তার মধ্যে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও জলবায়ুবিষয়ক বিধিনিষেধ অন্যতম। তাই এখানে কোনো রকম আলো-আঁধারির খেলায় না নেমে আন্তরিকতার সঙ্গে একটা কার্যকর পূর্ণাঙ্গ আইন যা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করে, সেটাই সবার কাম্য।

উপসংহারে বলা হয়, এ আইনকে শুধু ‘নিয়োগ’-এর মধ্যে সীমিত রাখা উচিত হয়নি, দেশে একটি পূর্ণাঙ্গ নির্বাচন কমিশন আইনের প্রয়োজন ছিল। সে প্রত্যাশা পূরণ হলো না। ‘নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো’, নাকি ‘দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভালো’—কোনোটিই বলা যাচ্ছে না। আইনমন্ত্রীর ভাষায় আইনটি করে তিনি অনেকের ‘আন্দোলনের পালের বাতাস’ কেড়ে নিয়েছেন বা ‘মসলা’র জোগান বন্ধ করেছেন। কারও পালের বাতাস কেড়ে নেওয়া বা মসলা বন্ধ করার জন্য নয়, দেশে গণতন্ত্রের ভিতকে শক্তিশালী করার জন্য একটি আইনের প্রয়োজন ছিল। তা যদি না হয়, তাহলে তো এমনও হতে পারে, পালের বাতাস কেড়ে নিতে গিয়ে আন্দোলনের পালে নতুন করে হাওয়া বা বাতাস দিলেন বা অস্থিরতার নতুন ‘মসলা’ জোগান দিলেন! এসব অহেতুক ও অপ্রয়োজনীয় বিতর্কের অবসান চাই। চাই সৎ, দক্ষ ও স্বাধীন একটি নির্বাচন কমিশন। সবশেষে চাই মোটামুটি গ্রহণযোগ্য, শান্তিপূর্ণ, অন্তর্ভুক্তিমূলক, স্বচ্ছ, সাবলীল জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচন।

ড. তোফায়েল আহমেদ লোকপ্রশাসনবিষয়ক অধ্যাপক, স্থানীয় সরকার ও শাসন বিশেষজ্ঞ

[email protected]