দুই মাস আগেই ভুট্টো জানতেন!

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান  ও জুলফিকার আলী ভুট্টো
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জুলফিকার আলী ভুট্টো

কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে এ এল খতিবের গভীর বন্ধুত্ব ছিল। খতিব কলকাতায় গেলে কিংবা সুভাষ ঢাকায় এলে একসঙ্গে সময় কাটাতেন। ঢাকায় এ এল খতিবের সঙ্গে সাক্ষাতের বর্ণনা দিতে গিয়ে সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘দীর্ঘ অদর্শনের পর খতিবের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হলো স্বাধীন বাংলাদেশে। একটা হাফহাতা বুশ শার্টের নিচে পাৎলুন আর চপ্পল—এই ছিল তার বরাবরের পোশাক।’ তিনি আরও লিখেছেন, ‘তত দিনে খতিব হয়ে গেছে মনে-প্রাণে বাঙালি। বাংলা বোঝে, কিন্তু ইংরেজি বলে। আবার একটা ভালো সময় আসবে বাংলাদেশের। খতিব তারই জন্য অপেক্ষা করছে। তাহলেই আবার ঢাকায় ফিরে যেতে পারবে। মুজিব যেদিন খুন হলেন, সেদিন আমি দিল্লিতে। খতিবের চোখ থেকে আমি সেই প্রথম আগুন বেরোতে দেখি।’

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ যেমন আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবজনক অধ্যায়, তেমনি ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডও অত্যন্ত বেদনাদায়ক ঘটনা। এ দেশের অনেক খ্যাতিমান সাংবাদিক-লেখক সে সময় মুজিব হত্যার পরিণাম আঁচ করতে না পারলেও ভারতীয় সাংবাদিক ও কবি এ এল খতিব পেরেছিলেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের প্রামাণ্য দলিল তাঁর হু কিলড মুজিব। কে মুজিবের হত্যাকারী? ১৫ আগস্ট যেসব সেনাসদস্য আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে বাংলাদেশের স্থপতির বুক বিদীর্ণ করেছেন, শুধু তাঁরাই কি ঘটনার হোতা? নাকি তাঁদের পেছনে আরও অনেকে ছিলেন? ৪১ বছর ধরেই এই প্রশ্নটি বারবার উচ্চারিত হচ্ছে। এ ব্যাপারে অনেক কিছুই এখনো অজানা। এমনকি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচারেও নেপথ্যের ঘটনাবলি তেমন আসেনি। এ এল খতিব তাঁর বইয়ে নানা ঘটনা ও চরিত্রের সমাহারে কিছু প্রশ্নের জবাব দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। ব্যাখ্যা করেছেন ১৫ আগস্টের আগের ও পরের বিভিন্ন ঘটনা।

সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন: ‘হঠাৎ হইচই করে বেরিয়ে গেল হু কিলড মুজিব। তিন মাস বেস্ট সেলারের কোঠায় থাকতে থাকতে অতর্কিতে সেই বই বেপাত্তা হয়ে গেল। পাকিস্তানে বেরিয়ে গেল তাঁর অনুমোদিত উর্দু সংস্করণ। কপাল পুড়ল খতিবের। ন্যায্য পয়সার কিছুই সে পেল না। বাংলা তরজমার অনুমতিই মিলল না।’

হু কিলড মুজিব আমাদের ইতিহাসের অসামান্য দলিল। এতে ১৫ আগস্টের নৃশংসতার বিবরণ আছে। সেদিন হত্যাকাণ্ডে যাঁরা অংশ নিয়েছিলেন, এ বইয়ে তাঁদের নীচুতা ও নিষ্ঠুরতার বর্ণনা যেমন আছে, তেমনি আছে দেশের ভেতরে ও বাইরের নেপথ্য কুশীলবদের কথাও।

স্বাধীনতার পরের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে মুজিবের রাজনৈতিক পদক্ষেপের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে খতিব লিখেছেন, ‘...শেখ মুজিবুর রহমান সমগ্র জাতির পুনরেকত্রীকরণে (রিকনসিলেশন) বিশ্বাস করতেন। তিনি সত্যিই উষ্ণতম, দয়ালু প্রকৃতির ব্যক্তিত্ব ছিলেন। ক্ষমতায় আসার আগে যারা তাঁকে সহায়তা করেছিল, তিনি তাদের কারও কথা ভোলেননি। কোনো একটি সংলাপ বলার ক্ষেত্রে ভুল হলেও কারও চেহারা চিনতে তাঁর কখনো ভুল হতো না। শুধু নাম মনে করা নয়, শেষ কবে দেখা হয়েছিল, সেটি মনে রেখে তিনি অনেককে চমকে দিতেন।’

খতিব তাঁর বইয়ে নিজে মুজিব সম্পর্কে কমই বলেছেন। বিভিন্ন লেখক ও গণমাধ্যমের মূল্যায়ন তুলে ধরেছেন। মাঝেমধ্যে তাঁর তীক্ষ্ণ মন্তব্য আছে: ‘অনেকে বলেন, মুজিব স্বাধীনতা চাননি বলেই পাকিস্তানিদের হাতে ধরা দিয়েছেন। এ কথাটি যে সত্য নয়, তার প্রমাণ ১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিলের নিউজ উইক।’ পত্রিকাটি লিখেছিল: ‘গত মাসে মুজিব যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন, তখন এর সমালোচকেরা বলেছিলেন যে তিনি এমন করেছেন কেবল তার চরমপন্থী সমর্থকদের চাপে পড়ে। তিনিই শুধু একটি বিশাল জনতার ঢেউয়ের ওপর চড়তে চাইছিলেন, যাতে তিনি এর নিচে চাপা পড়ে না যান। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বাঙালি জাতির সংগ্রামী নেতা হিসেবে মুজিবের উঠে আসাটা ছিল তাঁর সমগ্র জীবন। বাঙালি জাতীয়তাবাদের পক্ষে লড়াই করার যৌক্তিক ফলাফল।’

এই যৌক্তিক ফলাফলকে যাঁরা উল্টে দিতে চেয়েছেন, তাঁদের সম্পর্কে বারবার ইঙ্গিত করেছেন এ এল খতিব। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে তিনি লিখেছেন: ‘১৫ আগস্ট, ১৯৭৫। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর খন্দকার মোশতাক আহমদ নিজেকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করেন। এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো ‘ভ্রাতৃপ্রতিম’ মোশতাক সরকারকে স্বীকৃতি দেন। একই সঙ্গে তিনি ইসলামি সম্মেলন সংস্থার সব সদস্য এবং তৃতীয় বিশ্বের সব দেশের প্রতি অনুরূপ আহ্বান জানান। তিনি “বাংলাদেশি মুসলিম ভাইদের” জন্য ৫০ হাজার টন চাল ও ১৫ মিলিয়ন গজ কাপড় পাঠানোরও নির্দেশ দেন।’

ভুট্টোর এই পদক্ষেপ কি নিছক কূটনৈতিক কার্যক্রমের অংশ, নাকি একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ? বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে পাকিস্তান সরকার ও তার প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো যে শুধু নীরব দর্শক ছিলেন না, ১৫ আগস্টের পূর্বাপর কিছু ঘটনা তা-ই প্রমাণ করে।

১৯৭৩ সালে ভুট্টো প্রণীত পাকিস্তানের সংবিধানে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ শব্দটি বহাল রাখা হয়। সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়, ‘পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশের জনগণ যখন বিদেশি আগ্রাসন থেকে মুক্ত হতে পারবে এবং তার প্রভাব-প্রতিপত্তির বাইরে আসতে পারবে, তখন সেটি ফেডারেশনের প্রতিনিধিত্ব করবে।’

পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয় এবং মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয় ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সেনাসদস্যরাও চলে যান। এরপরও ‘বিদেশি আগ্রাসনের’ কথা বলার অর্থ স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে অস্বীকার করা। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার আগমুহূর্তে ভুট্টো তাঁকে পাকিস্তানের সঙ্গে কোনো রকম যোগসূত্র রাখার অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতিতে বলেছিলেন, ‘তোমরা সুখে থাক। পাকিস্তানের সঙ্গে আর কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে না।’ (১০ জানুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ)।

শেখ মুজিবের এই চূড়ান্ত জবাব সহজভাবে নেননি ভুট্টো। ১৫ আগস্টের রাজনৈতিক পরিবর্তনের সুযোগে তিনি ‘পাকিস্তানের দুই অংশ’কে এক করার তৎপরতা চালাতে থাকেন। বিশেষ উপদেষ্টা মাহমুদ আলীকে লন্ডনে পাঠান বাংলাদেশের সঙ্গে কনফেডারেশন করার উদ্দেশ্যে। বিশেষ উপদেষ্টা হিসেবে তাঁর দায়িত্ব ছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান’-সংক্রান্ত বিষয়াদি তদারক করা।

মাহমুদ আলী ভেবেছিলেন, লন্ডন থেকে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সমর্থন আদায় করবেন। কিন্তু সে উদ্দেশ্য সফল হয়নি।

বাংলাদেশে আগস্টের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে যখন খন্দকার মোশতাক ক্ষমতাসীন, ১৯৭৫ সালের সেপ্টেম্বরে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মেয়ে বেগম আখতার সোলায়মান (বেবী) ভুট্টোকে এক চিঠিতে লেখেন:

‘আমি সব সময় আপনাকে একজন অসীম সাহসী, অসাধারণ প্রজ্ঞা ও ব্যতিক্রমী দূরদর্শী মানুষ হিসেবেই জানি। “বাংলাদেশ” বিষয়ে আপনি সকল প্রত্যাশাকে অতিক্রম করে গেছেন। আপনি মুসলিম ভাইয়ের প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন দেখিয়ে অত্যন্ত উদারতার পরিচয় দিয়েছেন।’

 উল্লেখ্য, বেগম আখতার সোলায়মান ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন। সৌদি বাদশাহ খালেদ খন্দকার মোশতাকের কাছে পাঠানো এক বার্তায় বলেন, ‘আমার প্রিয় ভাই, নতুন ইসলামি প্রজাতন্ত্র বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করায় আপনাকে আমি নিজের ও সৌদি জাতির পক্ষ থেকে অভিনন্দন জানাচ্ছি।’

এসব চমকপ্রদ তথ্যও আমরা এ এল খতিবের হু কিলড মুজিব থেকে জানতে পারি।

বঙ্গবন্ধু হত্যার দুই মাস আগে, ১৯৭৫-এর জুনে জুলফিকার আলী ভুট্টো কাকুলের পাকিস্তান সামরিক একাডেমিতে সেনা কর্মকর্তাদের এক সমাবেশে বলেন, ‘এ অঞ্চলে শিগগিরই কিছু পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে।’ (জুলফি ভুট্টো অব পাকিস্তান, স্ট্যানলি ওলপার্ট)

এ এল খতিবের প্রশ্ন, দুই মাস আগে তিনি কীভাবে পরিবর্তনের পূর্বাভাস দিলেন?

তাঁর বই থেকে আরও জানা যায় যে মুসলিম লিগের নেতা খাজা খয়েরউদ্দিন, যিনি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতার কারণে স্বাধীনতার পর কারাগারে ছিলেন, তিনি ভুট্টোকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেছিলেন, ‘এখন থেকে শুরু হোক।’ পাকিস্তানের প্রভাবশালী সাংবাদিক জেড এ সুলেরি বলেছেন, পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক হতে পারত না, যদি মুজিব বেঁচে থাকতেন।

আগামীকাল: ‘সম্পদ ফেরত না দিলে বন্ধুত্ব হবে না’

সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক