দেশ হারানোর আতঙ্কে থাকা ৪০ লাখ বাঙালির কী হবে?

ভিটাছাড়া, দেশহারা হওয়ার ভয় নিয়ে তালিকায় নাম খুঁজতে এসেছে আসামের ভূমিপুত্র মানুষেরা। ছবি: এএফপি
ভিটাছাড়া, দেশহারা হওয়ার ভয় নিয়ে তালিকায় নাম খুঁজতে এসেছে আসামের ভূমিপুত্র মানুষেরা। ছবি: এএফপি

আসামের বারপেটা জেলার ময়নাল মোল্লার কিছুই মনে পড়ে না। কে মোদি, কে প্রধানমন্ত্রী, কে আসাম চালায়, কার হাতে কয়টা ছড়ি, তাতে তাঁর কোনো মাথাব্যথা নেই। শুধু ভুলতে পারে না ২০১৩ সালের ৫ সেপ্টেম্বরের কথা। সেদিন তাঁদের গাঁ-বুড়া (গ্রামপ্রধান)ēতাঁকে পুলিশের হাতে তুলে দেন। পুলিশের তালিকায় তাঁর নাম আছে, গাঁ-বুড়া সে কথাই তাঁকে বলেছিলেন। রাজধানী গুয়াহাটির ৯০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমের বারপেটা জেলার বড় থানায় তাঁকে নেওয়া হয়। সেখান থেকে কোর্টে চালান দিলে হাকিম তাঁকে অবৈধ অভিবাসী ঘোষণা করে ডিটেনশন সেন্টার বা নিবর্তন কেন্দ্র নামের জেলখানায় পাঠিয়ে দেন। বাড়ি থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে সে জেলখানায় ২ বছর ১০ মাস ২৯ দিন তাঁকে আটকে রাখা হয়। মা, বাবা, বউ, ছেলে, মেয়ে—সবাই বৈধ নাগরিক, কিন্তু ময়নাল অবৈধ! ময়নাল যেভাবে সাংবাদিকদের কাছে আটকের দিন-তারিখ, বছর-মাস-দিনের হিসাব দেন, তা থেকেই বোঝা যায় তাঁর মনের বোঝার ওজন। কত ভারী পাথরের নিচে চাপা পড়ে ছিলেন তিনি। প্রথম কয়েক সপ্তাহ রাত-দিন কেঁদেছেন জেলে বসে। তারপর নিজেই নিজের মনকে বুঝ দিয়েছেন, আল্লাহ যা কপালে লিখেছেন, তা-ই হবে।

আসামের ছয়টা নিবর্তন কেন্দ্রে এখনো হাজার হাজার ময়নাল, কুবের, বশির, দুলাল আটক আছেন। আটককেন্দ্রগুলোর ঘুঘু কারাকর্তারা আটক মানুষদের দুই ভাগে ভাগ করে রাখছেন: ১. বাংলাদেশি ২. সন্দেহভাজন বা ডাউটফুল ভোটার। এই মুহূর্তে প্রায় দেড় লাখ মানুষ ঝুলে আছেন সন্দেহভাজনের তালিকায়। সাংবাদিকেরা আটককেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা জেলারদের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, কিসের ভিত্তিতে তাঁরা আটক মানুষদের ভাগ করেন বাংলাদেশি আর সন্দেহভাজন ভোটার হিসেবে? উত্তর আসে, যাঁদের কেউ দেখতে আসেন না, তাঁরা বাংলাদেশি আর যাঁদের আত্মীয়স্বজন দেখতে আসেন, তাঁরা ডাউটফুল!

ময়নাল মোল্লার মতো বাড়ি থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে আটকে রাখা পরিবারের মানুষদের মধ্যে দেখতে আসার সংগতি কয়জনের থাকে?

আসামজুড়ে এখন আরও আটককেন্দ্র খোলার পাঁয়তারা চলছে। প্রধানমন্ত্রী মোদি আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং দিল্লি থেকে নতুন বরাদ্দ পাঠিয়েছেন। জলদি সবকিছু সেরে ফেলার তাগিদও কেন্দ্রেরই। এর মধ্যে আদালতের বেঁধে দেওয়া সময়সীমার শেষ দিন ৩০ জুলাই ৪০ লাখ লোকের নাম বাদ দিয়ে জাতীয় নাগরিক পঞ্জির চূড়ান্ত খসড়া তালিকা ঘোষণা করা হয়েছে। মানুষকে রাষ্ট্রহীন করার পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এই মহাযজ্ঞে প্রায় এক লাখ রাজকর্মচারী অংশ নেন। খরচ হয় শত শত কোটি রুপি। নতুন তালিকা ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে রাতারাতি রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়া মানুষদের কী হবে? কী তাদের ভবিষ্যৎ? পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী তড়িঘড়ি করে ডাকা সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘এত বড় একটা জিনিস করার আগে সরকার কি একবারও ভেবেছে, এই ৪০ লাখ লোক কোথায় যাবে?’

বিবিসির সঙ্গে কথা বলার সময় দিল্লির ইনস্টিটিউট ফর ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যানালাইসিসের ফেলো পুষ্পিতা দাসও বলেছেন, তালিকায় বাদ পড়া লোক নিয়ে মোদি সরকার আসলেই খুব একটা কিছু ভাবেনি। ভারতে তাঁরা এখন কীভাবে থাকবেন, তার কোনো স্পষ্ট উত্তর নেই।

অবশ্য তালিকা ঘোষণার সময় ১০ দফা আশ্বাস ছিল দিল্লির প্রতিনিধি সত্যেন্দ্র গার্গৈয়ের মুখে:
১. এই খসড়ার ওপর ভিত্তি করে কাউকে সরাসরি বিদেশি শনাক্তকরণ ট্রাইব্যুনাল বা আটককেন্দ্রে পাঠানো হবে না।

২. যে ৩ কোটি ২৯ লাখ মানুষ নাগরিক তালিকায় তাঁদের নাম তোলার আবেদন করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে ২ কোটি ৮৯ লাখের দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে। বাকিরা সন্তোষজনক প্রমাণ দিলে তাঁদের আবেদনও বিবেচনা করা হবে।

৩. ভারতের মহানিবন্ধক শৈলেশ জানিয়েছেন, সংক্ষুব্ধদের সব আপত্তি আন্তরিকতার সঙ্গে বিবেচনা করা হবে। আগামী ৩০ আগস্ট থেকে ২৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আপত্তি অভিযোগ গ্রহণ করা হবে। কোনো খাঁটি ভারতীয়র নাগরিকতা নিয়ে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই।

৪. আগামী সাধারণ নির্বাচনে বাদ পড়া ৪০ লাখ ভোট দিতে পারবেন কি না, তা ঠিক করবে নির্বাচন কমিশন।

৫. ১৯৭১ সালের ২১ মার্চের আগে আসামে বসবাসের প্রমাণ দেখাতে পারলেই নাগরিকতার তালিকাভুক্ত করা হবে।

৬. ১৯৫১ সালের আদমশুমারি তালিকা এবং ২৪ মার্চ পর্যন্ত হালনাগাদ করা ভোটার তালিকা নাগরিকত্ব প্রমাণের দলিল হিসেবে গৃহীত হবে।

৭. যাঁদের পরিবার আসামে ২৪ মার্চের আগে তাঁদের বসবাসের প্রমাণ দিতে পারবেন, তাঁরা নাগরিকত্বের হকদার বলে বিবেচিত হবেন। তার মানে, যাঁরা ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের আগে আসামে এসে বিদেশি নিবন্ধনের আঞ্চলিক অফিসে নিবন্ধিত হয়েছেন, তাঁরাও নাগরিকত্ব পাবেন।

৮. ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত হওয়া প্রথম খসড়া তালিকার ১ কোটি ৯০ লাখের মধ্যে ১ লাখ ৫০ হাজার নামের মধ্যে অসংগতি পাওয়া গেছে। এর তিন ভাগের এক ভাগ নাম হচ্ছে নারীদের।

৯। নাগরিক পঞ্জি নিয়ে যেকোনো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য কেন্দ্র আসাম, মেঘালয়, নাগাল্যান্ড, অরুণাচল আর মণিপুরে অতিরিক্ত ২৩ হাজার প্যারামিলিটারি মোতায়েন করেছে।

১০. ২০১৫ সালের মে মাস নিবন্ধন শুরু হওয়ার পর থেকে প্রায় ৬৮ লাখ পরিবার এ পর্যন্ত সাড়া দিয়েছে।

তারপরও কথা থেকে যায়, ময়নালের মতো ভুলের পুনরাবৃত্তি না হওয়ার নিশ্চয়তা কোথায়? ময়নাল মোল্লা না হয় গ্রামের এক বেখবর চাষা ছিলেন, কিন্তু ৩০ বছর ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কাজ করা মোহাম্মদ আজমল হককে কেন তালিকাবঞ্চিত করা হয়েছিল? এ কি শুধুই বাঙাল জবানের এক বিশেষ ধর্মবিশ্বাসের মানুষদের দিকে তাক করা একমুখী বন্দুকের খেলা?

নাগরিক তালিকা প্রকাশের পর আসামের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সেনোয়াল আশা প্রকাশ করেছেন, আসাম তার শান্তি ও সম্প্রীতির ঐতিহ্য বজায় রাখে চলবে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের বাইরে আসাম যাবে না। কিন্তু তালিকাবহির্ভূত ৪০ লাখ মানুষ সাধারণভাবে অবৈধ বাংলাদেশি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন, তাঁদের কি বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হবে? রাজনাথের সাম্প্রতিক ঢাকা সফরে কি এ নিয়ে কোনো কথা হয়েছিল? অনেকে ধারণা করছেন, অনানুষ্ঠানিক পর্যায়ে ভারত সরকার বন্ধুপ্রতিম বাংলাদেশকে নাকি আশ্বাস দিয়েছে, নাগরিক পঞ্জি নিয়ে তারা এমন কিছু করবে না, যাতে বাংলাদেশের সমস্যা হয়। তাহলে এই খেলার শেষ বাঁশি কীভাবে বাজবে?

নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়ে তারপর ধীরে ধীরে ন্যাচারালাইজেশনের মাধ্যমে জাতপাত বিচার করে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে? নাকি ধীরে ধীরে আসাম থেকে সরিয়ে অন্য সব রাজ্যে তালিকাবহির্ভূতদের নিয়ে যাওয়া হবে?

যেটাই হোক, সময় লাগবে দশ-বারো-বিশ বছর? নাকি আরও বেশি?

লেখক: দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মী