ধর্মঘট শুরু ও শেষের কিছু কথা

গত ২৮ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকে কোনো পূর্বঘোষণা ছাড়াই আকস্মিকভাবে দেশে শুরু হয় পরিবহন ধর্মঘট। চাকা বন্ধ হয়ে যায় যাত্রী ও মালবাহী যানের। লাখ লাখ যাত্রী আটকা পড়ে বিভিন্ন স্থানে। এদের মাঝে ছিল বৃদ্ধ, নারী, শিশুও। মালামাল আটকা পড়ায় সরবরাহ–ব্যবস্থা ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। নষ্ট হয় পচনশীল দ্রব্য। ১ মার্চে প্রকাশিত প্রথম আলোর সংবাদ শিরোনাম অনুসারে এ ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত হয় আগের রাতে জনৈক মন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে। উল্লেখ্য, তিনি বাংলাদেশ সড়ক পরিবহনের শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি। সে খবর অনুসারে সভাটিতে আরও উপস্থিত ছিলেন বাস ও ট্রাকমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির সভাপতিসহ (যিনি একজন প্রতিমন্ত্রী) প্রায় ৫০ জন মালিক ও শ্রমিকনেতা। আর তাঁদের প্রায় সবাই সরকার–সমর্থক বলেও খবরে উল্লেখ করা হয়।
মূল নেতৃত্বদানকারী মাননীয় মন্ত্রী মন্তব্য করেন, ‘সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি ক্ষোভ প্রকাশ করতেই পারেন। আপনিও করেন, আমিও করি। ঠিক একইভাবে ওরা ক্ষোভ প্রকাশ করছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘চালকেরা মনে করছেন মৃত্যুদণ্ডাদেশ বা যাবজ্জীবনের মতো রায় মাথায় নিয়ে গাড়ি চালাবেন না। তাই তাঁরা স্বেচ্ছায় গাড়ি চালাচ্ছেন না। এটা ধর্মঘট নয়, স্বেচ্ছায় অবসর।’ সাংগঠনিকভাবে কোনো ধর্মঘট ডাকা হয়নি বলে নেতৃত্বের পক্ষ থেকে দাবি করা হতে থাকে। এ ধর্মঘটের পটভূমিকায় ছিল দুজন চালককে দু-দুটি ভিন্ন ভিন্ন আদালতে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে দণ্ডিত করা। এ ধরনের আদেশে তাঁদের সহকর্মী অন্য পরিবহনশ্রমিকেরা ব্যথিত হতে পারেন। থাকতে পারে তাঁদের ক্ষোভও। কিন্তু এভাবে লাখ লাখ লোককে জিম্মি করে সে ক্ষোভ প্রকাশ ও আদালতের রায় পাল্টানোর অপচেষ্টা যেকোনো বিবেচনায় বেআইনি ও অনৈতিক। দায়রা জজ আদালতের এ রায়ে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ এবং অতঃপর আপিল বিভাগে প্রতিকার চাওয়ার সুযোগ রয়েছে। তাঁরা সেদিকে না গিয়ে আইনকে হাতে তুলে নিলেন। এটা অবশ্য পরিবহন খাতে নতুন কিছু নয়। কোথাও কোথাও ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানের প্রতিবাদেও সড়ক বন্ধ করে দেওয়া হয়।
সড়ক পরিবহন খাতের মালিক ও শ্রমিকদের দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও জনসেবায় অবদানকে আমরা খাটো করে দেখছি না। ব্যক্তি খাতে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ অর্থনীতিকে ক্রমাগত চাঙা করছে। ব্যক্তি ও মালামাল পরিবহন সহজতর হচ্ছে তাঁদেরই প্রচেষ্টায়। এর জন্য নানাবিধ শুল্ক ও কর দিচ্ছেন তাঁরা। পাশাপাশি প্রচুর কর্মসংস্থানও করেছেন এই উদ্যোক্তারা। ঠিক তেমনি সড়ক-মহাসড়কে চাঁদাবাজি, মাস্তানিসহ বহুতর সমস্যা মোকাবিলা করে এসব বাহন চালু রাখছেন পরিবহনশ্রমিকেরাই। অনেক ক্ষেত্রে তাঁরা খাটেন দিবারাত্র। সুতরাং, এ খাতে মালিক ও শ্রমিকের ভূমিকাকে উপেক্ষা করার সুযোগ কারও নেই।
তবে অন্য সব ক্ষেত্রের মতো রাষ্ট্রের আইন তাঁদের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য। একটি মোটরযানের নিবন্ধন, ফিটনেস নবায়ন, কর দেওয়া, চালকের লাইসেন্স এবং রাস্তায় চলার নিয়মনীতি—সবই আইন ও বিধি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এটা সত্য যে এর অনেক কিছু মানতে চান না মালিক ও শ্রমিকদের একটি অংশ। অবশ্য এসব ক্ষেত্রে তাঁদের সহযোগী হিসেবে থাকেন আইনগুলো প্রয়োগের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা। আবার পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের একাধিক সংগঠনের পক্ষে বেপরোয়া চাঁদাবাজিও করা হয়। সংগঠন চালাতে টাকা দরকার। তবে যে পরিমাণ টাকা তোলা হয় বলে জনশ্রুতি, এর নামমাত্র সে কাজে লাগে। ভাগ-বাঁটোয়ারার মহোৎসবে বিভিন্ন মহল জড়িত বলে ব্যাপকভাবে ধারণা করা হয়।

>শ্রমিক সংগঠনের অনেক নেতা এ উপমহাদেশে বিভিন্ন সময়ে মন্ত্রী হয়েছেন। কিন্তু মন্ত্রী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সমাজের সব পক্ষের স্বার্থ দেখার দায়িত্ব তাঁর ওপর বর্তায়। এ ক্ষেত্রে শুরু থেকে ফেডারেশনের সভাপতির পদ ছেড়ে দেওয়া তাঁর জন্য সংগত ছিল

এরপর দেখার থাকে গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়াকে ধর্মঘট না বলে ‘স্বেচ্ছায় অবসর’ বলে পার পাওয়া যায় কি না? অকারণ কথার মারপ্যাঁচে না গিয়ে সহজভাবে দেখা যায় জনজীবনে এর প্রভাব একই। কেমব্রিজ ইংলিশ ডিকশনারিতে ধর্মঘট (স্ট্রাইক)-এর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, কোনো দাবি আদায়ের লক্ষ্যে সাংগঠনিকভাবে কাজ থেকে বিরত থাকা। দাবি তো তাঁদের ছিলই। বিনা শর্তে দণ্ডিত চালকদ্বয়ের মুক্তি! আর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ছাড়াই হয়েছে ধর্মঘট। তদুপরি পরিবহন শ্রমিকেরা কাজ থেকে নিজেদের বিরত রেখেই ক্ষান্ত হননি। বিভিন্ন স্থানে অবরোধ দিয়ে অ্যাম্বুলেন্সসহ নানা ধরনের যান চলাচলে বাধা সৃষ্টি করেছিলেন। পুলিশ এ বাধা অপসারণে গেলে কয়েকটি ক্ষেত্রে সংঘর্ষ হয়। দুই পক্ষের গুলি বিনিময়ে প্রাণ হারান একজন শ্রমিক। এই মৃত্যুতে আমরাও শোকাহত। দাঙ্গাজনিত মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন অনেকে। তবে ঘটনার ইন্ধনদাতাদের নাম এজাহারে নেই। এ ক্ষেত্রে আমাদের বক্তব্য থাকবে, ঘটনাটির ইন্ধনদাতা এবং সরাসরি দাঙ্গায় অংশগ্রহণকারীদের ব্যতীত অন্য কাউকে যেন হয়রানি না করা হয়।
আলোচনা হলো ধর্মঘট শুরুর দিনটি নিয়ে। কিন্তু জনদুর্ভোগের বিষয়টি সেদিনই সরকারের বিশেষ নজরে আসে। কয়েকজন মন্ত্রী এটা অবসানের উদ্যোগ নেন। তবে তাঁদের কেউ কেউ দণ্ডিত ব্যক্তিদের উচ্চ আদালতে আইনি সহায়তা দেওয়ার কথাটি বলেছেন। এটা অনভিপ্রেত। বরং উচ্চ আদালতে সরকারের আইন কর্মকর্তাদের জোরালো মোকাবিলা করে দণ্ডাদেশ বহাল রাখতে সচেষ্ট হওয়া সংগত হবে। আমরা জেনেছি, সরকারের সর্বোচ্চ মহলও ঘটনায় বিব্রত এবং এর আশু অবসানের প্রশ্নে অনমনীয় ছিল। সুশীল সমাজসহ গণমাধ্যম সব ক্ষেত্রেই এ ধর্মঘট চরম সমালোচনার মুখে পড়ে। বিপাকে পড়ে পিছু হটার পথ খুঁজতে থাকেন আন্দোলনকারীরা। একটি উচ্চপর্যায়ের বৈঠকও হয়। তবে কার্যত নিঃশর্তভাবে কর্মবিরতি প্রত্যাহার করে দ্বিতীয় দিন বিকেলের মধ্যেই।
অতীতেও সড়ক ও নৌপথে এ ধরনের ধর্মঘটে গেছেন পরিবহন মালিক ও শ্রমিকেরা। অনেক ক্ষেত্রে সরকার ছাড় দিয়ে আপস করেছে। কিন্তু এবার এ ধরনের কোনো ছাড় দেওয়া হয়েছে বলে আমরা মনে করছি না। আইন তার স্বাভাবিক গতিতেই চলবে এবং এর দ্বার সবার জন্য খোলা, এটা মেনে নিতে হয়েছে আন্দোলনকারীদের। তাঁদের প্রতি আমাদের সম্মান, সহমর্মিতা সবই আছে। তাঁরা সবাই বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে মানুষের প্রাণহানির কারণ ঘটান এমনও নয়। আর সব প্রাণহানি চালকের দোষে হয় না। দুর্ঘটনা, দণ্ডনীয় নরহত্যা আর খুন এক কথা নয়। পরিস্থিতি অনুসারে প্রতিটি বিষয়কে বিশ্লেষণ করা হয়। দুর্ঘটনার সাজা তেমন বেশি নয়। তবে খুন ও দণ্ডনীয় নরহত্যার সাজা তো সর্বোচ্চ হবেই। সাভার ও মানিকগঞ্জের খবর দুটো সংবাদপত্রে যেভাবে এসেছে, সে অনুসারে এ দণ্ডকে যৌক্তিক বলা যায়। তবে ঊর্ধ্বতন আদালতই বিষয়গুলো দেখবেন।
এ ঘটনা শুরুর সঙ্গে সঙ্গে সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি সম্পর্কে অনেক বিরূপ মন্তব্য এসেছে বিভিন্ন মহল থেকে। এমনকি তাঁর নিজ দলের কেউ কেউ প্রকাশ্যে করেছেন সমালোচনা। তিনি শ্রমিক সংগঠন করেন। এ রকম শ্রমিক সংগঠনের অনেক নেতা এ উপমহাদেশে বিভিন্ন সময়ে মন্ত্রী হয়েছেন। কিন্তু মন্ত্রী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সমাজের সব পক্ষের স্বার্থ দেখার দায়িত্ব তাঁর ওপর বর্তায়। এ ক্ষেত্রে শুরু থেকে ফেডারেশনের সভাপতির পদ ছেড়ে দেওয়া তাঁর জন্য সংগত ছিল। কিন্তু তিনি তা করেননি। বরং সরকারের দায়িত্বে থেকে ব্যাপক জনগোষ্ঠীর স্বার্থের পরিপন্থী এবং আদালতের আদেশের বিপরীতে আকস্মিক একটি অবস্থান নিতে তিনি পরিবহন শ্রমিকদের নেতৃত্ব দিয়েছেন। মন্ত্রী সরকারি বাসভবনে তাঁর নেতৃত্বে হওয়া বৈঠক এবং এর পরে শ্রমিকদের ধর্মঘট বা কর্মবিরতি সম্পর্কে তাঁর মন্তব্যের সুস্পষ্ট প্রমাণ। আবার দ্য ডেইলি স্টার–এর ২ মার্চের শিরোনাম হিসেবে ধর্মঘটের পরিসমাপ্তি ঘটে তাঁরই আহ্বানে। এ ক্ষেত্রে সমগ্র বিষয়টির সঙ্গে তাঁর সংশ্লিষ্টতা আড়াল করার কোনো সুযোগ নেই। এমন করে তিনি সংবিধানের শপথ লঙ্ঘন কিংবা আদালত অবমাননা করেছেন কি না, এ বিষয়ে প্রয়োজনে যথাযথ কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেবে। তবে তাঁর মন্ত্রিত্ব করার নৈতিক দিকটি গুরুতর প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে রইল, এমনটি বলা চলে।
বরাবরের মতো এবারের এ ধর্মঘটের উদ্দেশ্য ছিল চাপ দিয়ে সরকারকে তার অবস্থান পরিবর্তনে বাধ্য করা। এর মাধ্যমে দেশবাসীকে তাঁরা এ বার্তা দিতে চেয়েছিলেন যে যা কিছু ঘটুক তাঁরা দেশকে জিম্মি করার ক্ষমতা রাখেন। বিপরীতে দেশবাসীর সম্মিলিত প্রতিরোধ ও সরকারের সময়োচিত দৃঢ় ভূমিকায় এ বার্তা গেল যে তাঁরা আইনের ঊর্ধ্বে নন। আর আইন সব অবস্থাতেই তার নিজস্ব গতিতে চলবে। আশা রইল ভবিষ্যতেও এ ধরনের যেকোনো অনভিপ্রেত পরিস্থিতির মোকাবিলা এভাবেই করা হবে।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
[email protected]