ধর্মীয় সহিংসতা রোধে নতুন শিক্ষাক্রম যে ভূমিকা রাখতে পারে

সমাজে একদিকে নৈতিক অবক্ষয় যেমন ঘুষ, দুর্নীতি, প্রতারণা, ধর্ষণ, বেহায়াপনাসহ ধর্মীয় নীতির পরিপন্থী নানা অন্যায় কাজের ছড়াছড়ি, অন্যদিকে ধর্মীয় উগ্রবাদ এবং ধর্মীয় সহিংসতার ব্যাপক উত্থান লক্ষণীয়। এর কোনোটাই কোনো ধর্মের মূলনীতির সঙ্গে কোনোভাবেই সংগতিপূর্ণ নয়। সভ্য সমাজের সঙ্গে তো নয়–ই। আর যে বাঙালির রয়েছে হাজার বছরের ধর্মীয় ও সামাজিক সম্প্রীতির ইতিহাস, তাদের জন্য তো একেবারেই বেমানান। তাহলে কেন মানুষের এ দ্বিমুখী আচরণ, তা নিয়ে বিস্তারিত বিচার-বিশ্লেষণ ও গবেষণার অবকাশ রয়েছে। এর পেছনে দেশি-বিদেশি স্বার্থান্বেষী মহলের উসকানি কিংবা ষড়যন্ত্র, যা–ই থাকুক না কেন, ধর্মীয় মূলনীতির কেউ সঠিক অনুশীলন করলে তার পক্ষে নিশ্চয়ই অন্য ধর্মের উপাসনালয় কিংবা পূজনীয় বস্তু ভাঙচুর তো দূরের কথা, অন্য ধর্মের অনুসারীদের অনুভূতিতে সামান্য আঘাত দেওয়াও সম্ভব নয়।

মানুষের সঙ্গে সদাচরণকেই ইসলামে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। হিংসা-বিদ্বেষ, রেষারেষি, পরনিন্দা, পরচর্চা, পরশ্রীকাতরতা, কুৎসা রটানো এবং সহিংসতা ছড়ানো ইসলামের দৃষ্টিতে অত্যন্ত গর্হিত কাজ। অন্য ধর্মেও এগুলোর কোনো সমর্থন নেই। এগুলোর সবই মানুষের হক নষ্টের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। আর ইসলামে মানুষের হক পালনের ওপরও সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কেউ কোনো ব্যক্তির হক নষ্ট করলে ওই ব্যক্তির জীবদ্দশায় তার নিকট থেকে ক্ষমা চেয়ে নেওয়াই বিধান, এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট নির্দেশনা আছে ইসলামের। কারোর ধর্মীয় বিধিবিধান পালনে ঘাটতি থাকলে আল্লাহ হয়তো তাকে নিজ গুনে মাফ করে দিতে পারেন। অর্থাৎ আল্লাহর হক নষ্ট করলে আল্লাহ চাইলে কাউকে মাফ করে দিতে পারেন। কিন্তু সাধারণ মানুষের হক নষ্ট করলে তাকে জবাবদিহি করতে হবে। ইসলামের মূলনীতি এটিই বলে।

দেখা যায় আমরা অনেকেই একদিকে ধর্মীয় বিধিবিধান পালন করছি, আবার অন্যদিকে অহরহ মানুষের হক নষ্ট করছি। আমরা অনেকে হয়তো মনে করছি, মন্দ কাজের পাপের তুলনায় ভালো কাজের পুণ্যের পাল্লা ভারী হলেই পার পাওয়া যাবে। কিন্তু বিষয়টা মোটেও তা নয়। মানুষের হক নষ্টের যে পাপ, তা ধর্মীয় আচার পালনের পুণ্যের সঙ্গে তুলনীয় নয়। বরং পুণ্যের ঘাটতি থাকলে যাদের হক নষ্ট করা হয়েছে, তাদের পাপ হক নষ্টকারীর ওপর বর্তাবে। ফলে অনেক ব্যক্তি যারা আল্লাহর হক ঠিকঠাক মতো পালন করেছে কিন্তু মানুষের হক নষ্ট করেছে, তাদের ছাড় পাওয়ার সুযোগ নেই। এ বিশ্বাসের ধারক কোনো ব্যক্তি অন্য ধর্মের অনুসারীদের উপাসনালয় ও পূজনীয় বস্তু ভাঙচুর এবং ঘরবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ধ্বংস করা তো দূরের কথা, কারও কোনো প্রকার ক্ষতি করার চিন্তাও মাথায় আনতে পারে না।

ইসলাম আরও বলে, প্রত্যেক মানুষের চেষ্টার ধরনের ওপর তার জন্য নির্ধারিত রিজিক নির্ভর করে। অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি যদি বৈধ উপায়ে তার রিজিকের চেষ্টা করে, তাহলে তার জন্য নির্ধারিত রিজিক বৈধ পন্থায় আসবে। আর কেউ যদি অন্যায় পন্থা বেছে নেয়, তাহলে তার জন্য নির্ধারিত রিজিক অন্যায়ভাবে আসবে।

দেশি-বিদেশি স্বার্থান্বেষী মহলের উসকানি কিংবা ষড়যন্ত্র, যা–ই থাকুক না কেন, ধর্মীয় মূলনীতির কেউ সঠিক অনুশীলন করলে তার পক্ষে নিশ্চয়ই অন্য ধর্মের উপাসনালয় কিংবা পূজনীয় বস্তু ভাঙচুর তো দূরের কথা, অন্য ধর্মের অনুসারীদের অনুভূতিতে সামান্য আঘাত দেওয়াও সম্ভব নয়।

ইসলামের এ দুই নীতি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। অন্যায় পন্থায় অর্থ উপার্জন মানে মানুষের হক নষ্ট করা। আর মানুষের হক নষ্ট করলে আল্লাহ তা ক্ষমা করবেন না। ফলে পারলৈকিক মুক্তির জন্য শুধু ধর্মীয় আচার পালনই যথেষ্ট নয়। ধর্মীয় বিধিবিধান সঠিকভাবে অনুশীলনের সঙ্গে প্রয়োজন মানুষের হক পালনের প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া। একটু ভাবুন তো, আমরা যারা রাষ্ট্রীয় কাজে ফাঁকি দিচ্ছি বা রাষ্ট্রীয় সম্পদ নষ্ট করছি তারা কি দেশের ১৮ কোটি মানুষের হক নষ্ট করছি না? আর কারোর জীবদ্দশায় ১৮ কোটি মানুষের নিকট ব্যক্তিগতভাবে ক্ষমা চাওয়া সম্ভব নয়। আর চাইলেও তা মাফ পাওয়ার নিশ্চয়তা কোথায়?

তাই যদি ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ এ দুই নীতির চর্চা করা যেত, তাহলে সমাজে অন্যায়-অবিচার, প্রতারণা, খুন-খারাবি, ধর্ষণ, উগ্রবাদ এবং রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সহিংসতা বহুলাংশে কমানো যেত। কিন্তু দেশের অধিকাংশ মুসলিম এ দুটি নীতি সম্পর্কে সঠিকভাবে অবগত নয়। কেননা, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মের এ নীতিগুলো শেখানো হয় না। স্কুলের ধর্মীয় বিষয়ের কারিকুলামে এসব নীতির কোনো স্থান নেই। মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থায় অনেক পঠনের ভিড়ে এসব নীতি শিক্ষার ওপর অনেক ক্ষেত্রেই জোর নেই। আর ওয়াজ-নসিহতেও এ দুটি বিষয়ের ওপর তেমন জোর দেওয়া হয় না। আবার পারিবারিক শিক্ষায়ও এর কোনো স্থান নেই।

এক কথায় পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিংবা ধর্মীয় প্রচার-প্রচারণায় এসব নীতির অনুপস্থিতি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। উল্লেখ্য, প্রাতিষ্ঠানিক পরিমণ্ডলে শুদ্ধ ধর্মীয় শিক্ষার উপযুক্ত ব্যবস্থা না থাকলে মানুষ অপ্রাতিষ্ঠানিক উৎস থেকে অশুদ্ধ ধর্মীয় রীতি-নীতি শেখে, যা থেকে উগ্রবাদ এবং সহিংসতা জন্ম নেয়। তাই ধর্মীয় উগ্রবাদ ও সহিংসতা রোধে প্রশাসনিক কার্যকর উদ্যোগের পাশাপাশি ধর্মীয় মূলনীতির শিখন ও তা অনুশীলনের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে পারলেই কেবল এ ধরনের সহিংসতা বন্ধের স্থায়ী ব্যবস্থা হবে।

দেশে নতুন শিক্ষাক্রমের ধর্মীয় কিংবা নৈতিক বিষয়ের কারিকুলামে অন্যান্য মৌলিক নীতির সঙ্গে এ দুটি মৌলিক নীতি অন্তর্ভুক্ত করে প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পর্যায়ক্রমে মাধ্যমিক পর্যন্ত শিখন কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারলে আশা করা যায়, ধর্মীয় উগ্রবাদ এবং ধর্মীয় সহিংসতা অনেকাংশে কমানো যাবে। তাই আমরা আশা করি, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে স্কুলের শিক্ষাক্রমে ধর্মের এ দুটি মূলনীতি অন্তর্ভুক্তকরণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। এ বিষয়ে ধর্মীয় বিশেষজ্ঞ ও ব্যক্তিত্বদের সহায়তা ও পরামর্শ নিতে পারেন তারা।

ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ অধ্যাপক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।