দেশে কি ধর্ষণের মৌসুম চলছে নাকি? একের পর এক ঘটে চলেছে ধর্ষণের ঘটনা। বগুড়ায় শ্রমিক লীগ নেতা তুফান সরকারের ঘটনায় দেশজুড়ে তোলপাড় হয়। এর রেশ কাটতে না কাটতে ৩ আগস্ট প্রথম আলোর শিরোনাম, ‘একের পর এক ধর্ষণের অভিযোগ চার দিনে আরও পাঁচ ঘটনা’। আর গতকালের শিরোনাম ছিল, ‘শিশু, গৃহবধূসহ চারজনকে ধর্ষণের অভিযোগ’। চলছেই। ধর্ষণ একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তারপরও কী করে প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে ধর্ষণের ঘটনা? এর পেছনের কারণ কী? অনেকে বলে থাকেন, পুরুষের বিকৃত মানসিকতা, মূল্যবোধের অবক্ষয় ধর্ষণের অন্যতম কারণ। কিন্তু সবক্ষেত্রেই কি এগুলোই মূল কারণ? বিচারহীনতার সংস্কৃতি কি ধর্ষণের ঘটনা বাড়ার জন্য দায়ী নয়?

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধনী-২০০৩)-এর ধারা ৯-তে বলা হয়েছে: ১. যদি কোনো পুরুষ কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন, তাহলে তিনি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন। ২. যদি কোনো ব্যক্তি কর্তৃক ধর্ষণ বা ওই ধর্ষণ-পরবর্তী অন্য কার্যকলাপের ফলে ধর্ষণের শিকার নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে, তাহলে ওই ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং অতিরিক্ত এক লাখ টাকা অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন। ৩. যদি একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন এবং ধর্ষণের ফলে ওই নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে বা আহত হন, তাহলে ওই দলের প্রত্যেক ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। অতিরিক্ত এক লাখ টাকা অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন। ৪. যদি কোনো ব্যক্তি কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে মৃত্যু ঘটানোর বা আহত করার চেষ্টা করেন, তাহলে ওই ব্যক্তি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন। এ ছাড়া যদি কেউ ধর্ষণের চেষ্টা করেন, তাহলে ওই ব্যক্তি অনধিক ১০ বছরের কারাদণ্ড ও পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ধর্ষণ করার জন্য এসব শাস্তি কি কাউকে দেওয়া হয়েছে? পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে দেশের বিভিন্ন থানায় ১৮ হাজার ৬৬৮টি ধর্ষণের মামলা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে ২০১৬ সালে করা হয়েছে ৩ হাজার ৭১৭টি, ২০১৫ সালে ৩ হাজার ৯২৮, ২০১৪ সালে ৩ হাজার ৬৮৯, ২০১৩ সালে ৩ হাজার ৬৫০ এবং ২০১২ সালে ৩ হাজার ৬৮৪টি মামলা হয়। এসব মামলার মধ্যে প্রতিবছর গড়ে ৪ শতাংশ আসামির সাজা হয়। বাকিদের অধিকাংশই মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছে।

আরেকটি হিসাব অনুযায়ী, ২০০১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে ধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকার হয়ে চিকিৎসা সহায়তা নিতে আসেন ২২ হাজার ৩৮৬ জন নারী। তার মধ্যে মামলা হয় ৫ হাজার ৩টি ঘটনায়। এর মধ্যে ৮০২টি ঘটনায় রায় দেওয়া হয়েছে। শাস্তি পেয়েছে ১০১ জন। রায় ঘোষণার হার ৩ দশমিক ৬৬ ভাগ। আর সাজার হার শূন্য দশমিক ৪৫ শতাংশ।

এই যদি অবস্থা হয়, তাহলে ধর্ষণ করতে কেন উৎসাহিত হবে না পুরুষেরা। তাদের সামনে তো কোনো কঠোর শাস্তির দৃষ্টান্ত নেই। আসলে ধর্ষণ বিষয়টা আমাদের দেশে এখনো জাতীয় সমস্যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হতে পারেনি। এ অপরাধকে গৌণ অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। তা না হলে কোনো নারী ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর এর জন্য ওই নারীকে কেউ দায়ী করতে পারত না। একই কারণে বোধ হয় সাজার বিষয়টিও উপেক্ষিত থাকে। কিন্তু ধর্ষণকে কোনো অবস্থাতেই লঘু অপরাধ হিসেবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। এটি জঘন্য একটি অপরাধ। কাজেই ধর্ষকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। ধর্ষণ বন্ধে এর কোনো বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র ও সরকারকে ভূমিকা পালন করতে হবে। ধর্ষকদের কোনাভাবেই প্রশ্রয় দেওয়া চলবে না। ক্ষমতাবান বা প্রভাবশালী বলে কোনো ধর্ষক যেন পার পাওয়ার সুযোগ না পায়, তা দেখতে হবে।

রোকেয়া রহমান: সাংবাদিক