ধর্ষণের বিচারে নারীর ‘চরিত্র’

গত সপ্তাহে জাতীয় সংসদে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ধারণা করা হচ্ছে, অবশেষে ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ধারাটি দ্রুতই পরিবর্তন করা হতে পারে। নারীর প্রতি অবমাননাকর এই ধারা নিয়ে নানা মহলের আপত্তি বেশ অনেক বছর ধরেই। আইনের এই ধারা অনুযায়ী যখন কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে ধর্ষণ বা ধর্ষণের চেষ্টার অভিযোগ আনা হয়, তখন অভিযোগকারী নারীকে দুশ্চরিত্র প্রমাণ করে আসামিপক্ষ তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে। অর্থাৎ সোজা কথায়, একজন নারীকে দুশ্চরিত্র হিসেবে দেখাতে পারলে তাঁর ধর্ষণ হওয়ার আশঙ্কাও কম থাকবে, এমনটাই ধরে নেওয়া হচ্ছে। এটি অবাক করার মতো বিষয়, যে নারী অধিকার নিয়ে এত বছর ধরে বাংলাদেশে এত আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে, তারপরও এমন একটি বৈষম্যমূলক ধারা আমাদের সাক্ষ্য আইনে রয়ে গেছে।

সাক্ষ্য আইনের এই বিশেষ ধারা কিন্তু সেই ভিক্টোরিয়ান আমলের পুরুষতান্ত্রিকতা এবং নারীবিদ্বেষী ধারণাপ্রসূত, যেখানে আইনকানুনের রূপরেখা নির্ধারিত হয়েছে পুরুষের সুবিধার কথা মাথায় রেখেই। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আদালতেও তাই বিচারপ্রক্রিয়ায় ধর্ষণের শিকার নারীর ‘চরিত্র’কে গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হতো, যেন ‘দুশ্চরিত্র’ হওয়ার অর্থই হলো তিনি মিথ্যা অভিযোগ আনছেন কোনো নির্দোষ ব্যক্তিকে ফাঁসানোর উদ্দেশ্যে। আর একজন নারী কখন ‘দুশ্চরিত্র’ নারীতে পরিণত হবেন, সেই বিষয়ও নির্ধারিত হতো অবশ্যই পিতৃতান্ত্রিক ধ্যানধারণার মানদণ্ডে। ভিক্টোরিয়ান আমলের চরিত্রের ‘নৈতিকতা’ প্রমাণের বোঝা আমাদের স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও বিচারপ্রার্থী নারীকে একইভাবে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। আমরা এখনো দেখতে পাই, ধর্ষণের ক্ষেত্রে ঔপনিবেশিক আদালতের বেশ কিছু নারীবিদ্বেষী এবং বৈষম্যমূলক মতামত একবিংশ শতাব্দীর আদালতের রায়কেও প্রভাবিত করছে।

আইন পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যৌন অপরাধের শিকার নারী যখন বিচার চাইতে আসবেন, তাঁকে সহানুভূতি আর সংবেদনশীলতার সঙ্গে গ্রহণ করার দৃষ্টিভঙ্গিও তৈরি করতে হবে বিচারব্যবস্থার প্রতিটি স্তরে। নারীর প্রতি সংবেদনশীল বিচারব্যবস্থা তৈরির প্রক্রিয়াটি দীর্ঘমেয়াদি শোনালেও এখনই সময় দৃশ্যমান পরিবর্তনের সূচনা করার

ধর্ষণের অভিযোগকারীকে সর্বোচ্চ সন্দেহের সঙ্গে বিবেচনা করার যে ঔপনিবেশিক ধারণা, তার ফলস্বরূপ অভিযোগে বর্ণিত যৌন সম্পর্কে নারীর আইনত ‘সম্মতি’ ছিল কি না, সেই প্রশ্ন অনেক ক্ষেত্রেই উপেক্ষিত হয়। সম্মতির পরিবর্তে চরিত্রের সঙ্গে অভিযোগের যোগসাজশ করতে গিয়ে অনেক সময়ই ধর্ষণের শিকার নারীকে ‘নৈতিক চরিত্রের’ গৎবাঁধা ছাঁচে ফেলে বিচার করা হয়, আর যার ব্যত্যয় ঘটলে অভিযোগ মিথ্যা হওয়ার সম্ভাবনা দৃঢ় হয়। ‘সুচরিত্রের’ এই ছাঁচে যেমন নারীর স্বাভাবিক যৌনজীবন অন্তর্ভুক্ত হয়, একই সঙ্গে সে দরিদ্র না বিত্তবান, শিক্ষিত না অশিক্ষিত, বিবাহিত নাকি অবিবাহিত—এই অপ্রাসঙ্গিক বিষয়গুলোও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। ধর্ষণের সঙ্গে নারীর চরিত্রের এই যোগসাজশের গৎবাঁধা ধারণা ভাঙতে হবে, আর সেই প্রথা ভাঙার প্রক্রিয়ায় ব্রিটিশ সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ধারাটির বিলুপ্তকরণ দেরিতে হলেও একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

তবে একটি বিষয় বিবেচনা করা জরুরি। এই ধারা বিলুপ্ত করার মূল প্রেক্ষাপট হলো আমরা ধর্ষণের মতো অপরাধের শিকার ভুক্তভোগীদের বৈষম্যহীন এবং নিরাপদ বিচারপ্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করতে চাই, যেখানে তাঁর চরিত্র হননের মাধ্যমে তাঁর বিচারপ্রাপ্তির পথকে রুদ্ধ করা হবে না। সেখানেই প্রশ্ন হলো, শুধু একটি ধারাকে বিলুপ্ত করেই আসলে সেই উদ্দেশ্য সফল হবে কি না। কেননা, মামলায় প্রতিপক্ষকে জেরা করার যে সুযোগ রয়েছে, তাতে সাক্ষ্য আইনের প্রযোজ্য ধারাগুলোর অধীনে যেকোনো মামলায় একজন সাক্ষীর চরিত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করা সম্ভব। সে কারণেই ১৫৫(৪) ধারার বিলুপ্তির সঙ্গে সঙ্গে যাতে ধর্ষণের অভিযোগকারীকে তাঁর চরিত্র নিয়ে অপ্রয়োজনীয় অবমাননাকর প্রশ্ন না করা হয়, সেই বিষয়েও সুরক্ষামূলক বিধান অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন।

খোদ যুক্তরাজ্যে ১৯৯৯ সালের আইনের মাধ্যমে যৌন অপরাধের অভিযোগকারীকে তাঁর অতীত যৌন সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন বা সে–সম্পর্কিত প্রমাণ দাখিলের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। ভারতীয় সাক্ষ্য আইনেও সংশোধনের মাধ্যমে ধর্ষণের মামলায় নারীর সম্মতিক্রমে তাঁর অতীত সম্পর্ক বা চরিত্রের নৈতিকতাসংক্রান্ত প্রশ্ন করার ক্ষেত্রে বিশেষ নিষেধাজ্ঞা যুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া গত কয়েক দশকে যৌন অপরাধের ক্ষেত্রে বিচারপ্রার্থী নারীর সুরক্ষার জন্য এই রকম সুরক্ষামূলক আইনের বিধান করা হয়েছে বিশ্বের আরও বেশ কয়েকটি দেশে। ১৫৫(৪) ধারা বিলোপের সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য দেশের আইনের পরিবর্তন এবং সংযোজনগুলোকে আমাদের বিচারব্যবস্থার আলোকে বিবেচনা করে একই রকমের সুরক্ষার বিধান যুক্ত করা প্রয়োজন।

এর পাশাপাশি আরও একটি বিষয় মনে রাখা প্রয়োজন, যৌন অপরাধের শিকার একজন নারীকে যাতে অন্যায়ভাবে হেনস্তা না করা হয়, সাক্ষ্য আইনেই বিচারককে কিন্তু সেই ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। আদালতে চলমান বিচারপ্রক্রিয়াতে কোনো পক্ষকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে যাতে অবমাননা না করা হয়, তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব কিন্তু অনেকটাই থাকে সংশ্লিষ্ট আদালতের বিচারকের ওপর। সে কারণেই আইন সংশোধন বা পরিমার্জন যা-ই হোক না কেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো বিচারপ্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত সব স্তরের ব্যক্তিদের যৌন অপরাধের অভিযোগকারীর প্রতি সংবেদনশীল করে তোলা। রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে তাই এই সংবেদনশীলতা অর্জন করার প্রক্রিয়াও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। আমাদের সর্বোচ্চ আদালতও এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। নিম্ন আদালতে ধর্ষণের বিচারপ্রক্রিয়ায় একজন অভিযোগকারীর প্রতি কেমন আচরণ করা উচিত, সেই বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা উচ্চ আদালত দিতে পারেন।

একই সঙ্গে আদালতের পরিবেশও একজন ভুক্তভোগী নারীর বিশেষ পরিস্থিতির প্রতি সহায়ক হওয়া প্রয়োজন। আমাদের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে রুদ্ধদ্বার কক্ষে ধর্ষণের বিচারের বিধান থাকলেও বাস্তবে এই বিধানের ব্যবহার খুব একটা হয় না। আইন বলছে, রুদ্ধদ্বার কক্ষে বিচারের আবেদন করতে পারে যেকোনো পক্ষ, কিন্তু সেই আবেদনের প্রক্রিয়া কী হবে, বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়নি। রুদ্ধদ্বার কক্ষে মামলার শুনানি করার সুযোগটি ভুক্তভোগী জানেন কি না, সে বিষয়ে বিচারক এবং রাষ্ট্রপক্ষের উকিলদের দায়িত্ব কী হতে পারে, সে বিষয়েও স্পষ্ট নির্দেশনা থাকা প্রয়োজন।

শুধু যে নিম্ন আদালতে চরিত্রের প্রমাণ দিতে গিয়ে নারীকে হেনস্তা হতে হয়, তা কিন্তু নয়। সাম্প্রতিক গবেষণাগুলো বলছে, ধর্ষণের শিকার নারীরা যখন উচ্চ আদালতে পৌঁছান, তখনো একজন নারীর চরিত্রসম্পর্কিত ধ্যানধারণা অনেক সময়ই মামলাকে প্রভাবিত করে। সে কারণেই আইন পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যৌন অপরাধের শিকার নারী যখন বিচার চাইতে আসবেন, তাঁকে সহানুভূতি আর সংবেদনশীলতার সঙ্গে গ্রহণ করার দৃষ্টিভঙ্গিও তৈরি করতে হবে বিচারব্যবস্থার প্রতিটি স্তরে। নারীর প্রতি সংবেদনশীল বিচারব্যবস্থা তৈরির প্রক্রিয়াটি দীর্ঘমেয়াদি শোনালেও এখনই সময় দৃশ্যমান পরিবর্তনের সূচনা করার।

তাসলিমা ইয়াসমীন সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]