নজরুল ইসলাম, আশি পেরিয়ে

নজরুল ইসলাম
নজরুল ইসলাম

উড়িয়ে ধ্বজা অভ্রভেদী রথে চড়ে নজরুল ইসলাম ৮০ পার হয়ে ৮১-তে পা রাখলেন। তাঁর জন্ম ১৯৩৯ সালের ১৬ এপ্রিল বর্তমান শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার চরাঞ্চলে। জন্মস্থানেই তাঁর শৈশব কেটেছে। কৈশোর কেটেছে ফরিদপুর শহরে, রাজবাড়ীর কালুখালী ও পরে (১৯৫০ সালের ডিসেম্বর থেকে) ঢাকা শহরে। হাইস্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা ঢাকায়। অসাধারণ মেধাবী নজরুল ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোলশাস্ত্রে রেকর্ড নম্বরসহ অনার্স (১৯৬১) ও মাস্টার্সে (১৯৬২) প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছিলেন। ষাটের দশকে তিনি কানাডায় ও সত্তরের দশকে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন।

নজরুল ইসলাম একজন সফল শিক্ষাবিদ, দক্ষ প্রশাসক, নগর–বিশেষজ্ঞ ও নগর–গবেষক, শিল্পসংগ্রাহক, লেখক, পরিবেশবিদ, খ্যাতিমান প্রাবন্ধিক এবং অবশ্যই একজন ভূগোলবিদ। বিপুল তাঁর কর্মযজ্ঞ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছেন (১৯৬৩-১৯৮২; ১৯৮৬-২০০৭)। আন্তর্জাতিক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্যাংককে এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে চার বছর (১৯৮২-৮৬) নগর উন্নয়ন পরিকল্পনা বিষয়ে শিক্ষকতা করেছেন। ২০০৭-১১ তিনি বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন। এর আগে (১৯৯৯-২০০২) ঢাকা ওয়াসা বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন।

নগরায়ণ বিষয়ে নজরুল ইসলামের গবেষণা ও প্রকাশনা জাতীয়ভাবে সমাদৃত ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। তিনি খ্যাতিমান নগরবিদ হিসেবে বেশি পরিচিত। তবে নজরুল ইসলামের আকাঙ্ক্ষা ছিল ভূগোলবিষয়ক এমন একটি কাজ করার, যা তাঁকে তাঁর সমস্ত কর্মকাণ্ডের ঊর্ধ্বে ভূগোলবিদ হিসেবে শীর্ষে স্থান দেবে। তাঁর সেই কাঙ্ক্ষিত কাজটি ৮০ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই ২০১৮ সালের ৯ ডিসেম্বর প্রকাশনা উৎসবের মাধ্যমে তিনি সম্পন্ন করেছেন। ভূগোলবিদ হিসেবে তাঁর দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা ও মেধার সার্থক ফসল ন্যাশনাল অ্যাটলাস অব বাংলাদেশ। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, বাংলাপিডিয়া ট্রাস্ট ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সম্মিলিত আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতায় এশিয়াটিক সোসাইটির অন্যতম বিশাল কাজ এই অ্যাটলাস, তথা মানচিত্র সংকলন। এর বাংলা সংস্করণ বাংলাদেশের জাতীয় অ্যাটলাস এ মাসে প্রকাশিত হয়েছে। অ্যাটলাসটি ভূগোলবিদদের দ্বারা প্রণীত। এর প্রধান সম্পাদক নজরুল ইসলাম ও সম্পাদক ড. নুরুল ইসলাম নাজেম। নাজেম অধ্যাপক নজরুল ইসলামের সুযোগ্য ছাত্র ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক। পঁচাত্তরোর্ধ্ব বয়সের প্রবীণ মানুষটি কী দক্ষতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে প্রায় ৩০ জনের এক কর্মী বাহিনী নিয়ে এই বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু করেন। এই বাহিনীতে সম্পৃক্ত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের কয়েকজন তরুণ শিক্ষক ও শিক্ষার্থী। তা ছাড়া, উপদেষ্টা ও অন্যান্য ভূমিকায় যুক্ত ছিলেন বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট পণ্ডিত।

লেখালেখিতে নজরুল ইসলামের ক্লান্তি নেই। শুরু সেই পঞ্চাশের দশকে, তারপর বিরামহীন লিখে চলেছেন বিভিন্ন সাময়িকী ও পত্রপত্রিকায়। শিল্পকলা ও শিল্পীদের নিয়ে যেমন লিখেছেন, তেমনি আবার বাংলাদেশের ভূগোল, নগরায়ণ, উন্নয়ন, সুপরিচালন ইত্যাদি বিষয় নিয়ে প্রবন্ধ লিখে চলেছেন নিরন্তর। দেশে ও দেশের বাইরে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর গ্রন্থ, গবেষণা প্রবন্ধ ও রচনা।

নগর গবেষণা কেন্দ্র বা সেন্টার ফর আরবান স্টাডিজ (সিইউএস) নজরুল ইসলামের প্রাণ। দেশ স্বাধীন হওয়ার এক বছর পর ১৯৭২ সালের ১৩ মে তিনি এই কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে এটি দেশে ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান। এই কেন্দ্রের স্বাধীন সত্তা ও স্বকীয়তা বজায় রেখে নজরুল ইসলাম এর প্রসারের জন্য নতুন নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন। গবেষণার মান ও গুণগত বিষয়ের ওপর নজর রেখেছেন। বলতে গেলে সারা দিনই তিনি নগর গবেষণা কেন্দ্রের অফিসে থাকতে ভালোবাসেন। সম্পূর্ণ অবৈতনিক চেয়ারম্যান হিসেবে কাজ করেন।

এত দিন নজরুল ইসলাম নগরায়ণ, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা, নগর পরিবেশ, নগর দারিদ্র্য, নগর প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা, নগর সুশাসন প্রভৃতি বিষয় নিয়ে গবেষণা করেছেন। প্রবন্ধ–নিবন্ধ লিখেছেন। এবার লিখলেন ঢাকার সংস্কৃতি নিয়ে সাংস্কৃতিক শহর ঢাকা। তিনি তাঁর প্রবন্ধে উল্লেখ করেন, ঢাকার নানা রকম সমস্যা ও অব্যবস্থাপনা ছাপিয়ে এখানে অনুষ্ঠিত সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ঢাকাবাসীর জীবনে আনন্দ ও স্বস্তি এনে দেয়। তিনি মনে করেন, ঢাকা সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে একটি অনবদ্য সমৃদ্ধ শহর। সাহিত্য ও সকল সুকুমার শিল্পকলার চর্চা, ধর্মীয় ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান, ব্রত পালন যেমন সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের সূচক, তেমনি মানুষের জীবনাচরণ তার সাংস্কৃতিক পরিচয় বহন করে। নজরুল ইসলামের আরেক পরিচয়, তিনি ছবি আঁকেন, একাধিক ‘গ্রুপ শো’তে অংশ নিয়েছেন। বেশ কিছু বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকেছেন। অ্যাটলাসের অভ্যন্তরীণ বিন্যাস মূলত তাঁরই করা।

নজরুল ইসলাম এখনো বিরামহীন কাজ করে চলেছেন। তিনি পরিকল্পনা কমিশন পরিচালিত ‘বাংলাদেশ ডেলটা প্ল্যান ২১০০ ’-এর উপদেষ্টা কমিটির সদস্য হিসেবে কাজ করছেন। সম্প্রতি তিন বছরের জন্য বিআইডিএসের সিনিয়র ফেলো নির্বাচিত হয়েছেন। ২০১৭ সালে জাতিসংঘের মানববসতি-বিষয়ক গ্লোবাল কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক ফোরামে কাজ করেছেন। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীর জাতীয় কমিটির সদস্য ছিলেন ১৯৮১-২০১৮ পর্যন্ত। রবীন্দ্রসৃজনকলা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চের ট্রাস্টি ও বঙ্গীয় গ্রন্থ জাদুঘরের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হিসেবে শিক্ষা, সাহিত্য, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখে চলেছেন।

নজরুল ইসলাম তাঁর নানামুখী কাজের স্বীকৃতি হিসেবে অর্জন করেছেন শেল্‌টেক্‌ অ্যাওয়ার্ড, বাংলা একাডেমি ফেলোশিপ, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির
ফেলোশিপ, ঢাকা আর্ট সার্কেলের আউট স্ট্যান্ডিং আর্ট ক্রিটিক অ্যাওয়ার্ড, বাংলাদেশ ভূগোল সমিতি ও বাংলাদেশ ভূগোল পরিষদ প্রদত্ত লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড, জয়নুল আবেদিন সম্মাননা, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স সম্মাননা প্রভৃতি।

নজরুল ইসলাম আপাদমস্তক একজন শিক্ষক। আর তাঁর স্ত্রী ও দুই মেয়ে, পরিবারের সবাই শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। নজরুল ইসলামের বাবা আবদুল কাদির কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট (১৯৩৫), ছিলেন সরকারি চাকুরে। মা ফাতেমা খাতুন ছিলেন প্রাথমিক বৃত্তিপ্রাপ্ত।

৮০তম জন্মবার্ষিকীতে অধ্যাপক নজরুল ইসলামের সক্রিয় সৃজনশীল জীবন কামনা করি। আমার প্রাণঢালা শুভকামনা। ভালো থাকবেন। ভালো আপনাকে থাকতেই হবে। ভেঙেছ দুয়ার এসেছ জ্যোতির্ময়/তোমারি হউক জয়।

কাজী মদিনা: ভূগোলবিদ, আবৃত্তিশিল্পী ও লেখক