নদীর দূষণমুক্ত পানি চাই: উপায় ও আশু করণীয়

গত ৬ মে ২০১৭, বুয়েট অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন ও প্রথম আলোর আয়োজনে ‘নদীর দূষণমুক্ত পানি চাই: উপায় ও আশু করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত আলোচকদের বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হলো।

আলোচনায় সুপারিশ

* কঠিন বর্জ্য পদার্থ পানিতে মিশতে দেওয়ার পথ বন্ধ করতে হবে। মানববর্জ্য ব্যবস্থার জন্য আলাদাভাবে ট্রিটমেন্ট প্ল্যান করতে হবে

*   সড়ক সম্প্রসারণের নামে ইচ্ছামতো বাঁধ দিয়ে খালের ওপর সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। খালগুলো িফরিয়ে অানতে হবে

*   ঢাকার জলাশয়গুলো আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে

* ঢাকা মহানগরের জলাশয়গুলো উদ্ধারে আপস করলে এ নগরকে বাঁচানো যাবে না

* লেক চিহ্নিত করে যে যতটুকু দূষণ করছে, তাকে সেই অনুযায়ী মাশুল নির্ধারণ করে দিতে হবে

*   নদীদূষণ রোধে উৎসমুখে বঁাধ দেওয়াসহ সচেতন করতে হবে

আলোচনা

আব্দুল কাইয়ুম: মানুষের জন্য দূষণমুক্ত পানির কোনো বিকল্প নেই। ঢাকা মহানগরের চারপাশের নদীগুলো আজ ভয়ানক দূষণের শিকার হয়েছে ট্যানারিশিল্প চলে গেলেও অন্যান্য কলকারখানার বর্জ্য নিয়মিতভাবে নদীর পানি দূষিত করছে। আজকের আলোচনায় এসব বিষয় আসবে। এখন আলোচনা করবেন জামিলুর রেজা চৌধুরী।

জামিলুর রেজা চৌধুরী
জামিলুর রেজা চৌধুরী

জামিলুর রেজা চৌধুরী: প্রায় দুই দশক থেকেই আমরা বাংলাদেশের নদী ও জলাভূমিগুলো যথাযথ সংরক্ষণ এবং দূষণমুক্ত রাখার ব্যাপারে আন্দোলন করে আসছি। 

১৯৯৬ সালে ঢাকা মহানগরের চারপাশে বুড়িগঙ্গা, বালু, তুরাগ ও শীতলক্ষ্যা—এই চারটি নদ–নদী যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের সুপারিশ করেছিলাম। ২০০০ সালে বাংলাদেশ পরিবেশবিষয়ক প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলনেও সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের সুপারিশ করেছিলাম। 

এই সুপারিশের আলোকে তখন সরকার কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। এ ছাড়া বাপার উদ্যোগে নদী বাঁচাও আন্দোলনের মাধ্যমে সারা দেশে গণসচেতনতা তৈরি করা হয়।

উল্লেখ্য, ১৮৫০ সালের দিকে টেমস নদীর পানি ব্যবহারের অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছিল। তখন একটা মহামারি আকারের কলেরাও হয়েছিল লন্ডনে। এরপর থেকে তাদের নানা উদ্যোগে নদীটির পানি দূষণমুক্ত করে সংরক্ষণ করা হয়। এই পানির গুণগত মান এত ভালো যে, যেকোনো কাজে ব্যবহার করা যায়।

আমাদেরও নদীর পানি ব্যবহারের উপযোগী করার উদ্যোগ নিতে হবে। হাজারীবাগ থেকে ট্যানারিগুলো সরানোর ফলে বুড়িগঙ্গা নদীতে কিছুটা হলেও দূষণ কমবে। 

আশুলিয়া থেকে সদরঘাট পর্যন্ত নদী সংরক্ষণের একটা প্রকল্প নেওয়া হলেও সেটা ফলপ্রসূ হয়নি।

নদী বাঁচিয়ে রাখতে না পারলে আমাদের সামনে মহাবিপর্যয় আসন্ন। আমি মনে করি, নদীগুলো রক্ষায় রাজনৈতিক সদিচ্ছা এখনো তৈরি হয়নি। অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও জলাভূমি রক্ষার আইন আছে কিন্তু প্রয়োগ নেই।

আমি আশাবাদী, এই দূষণ থেকে আমরা পরিত্রাণ পাব। আমাদের উদ্দেশ্য সরকারের নীতিনির্ধারকদের স্মরণ করিয়ে দেওয়া এবং জনগণকে সচেতন করা।

মো. আবদুল মতিন
মো. আবদুল মতিন

মো. আবদুল মতিন: সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, ঢাকার জনসংখ্যা বর্তমানে প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ। ২০২০ সাল নাগাদ ২ কোটিতে গিয়ে ঠেকবে। ঢাকা শহরের ওপর এই জনসংখ্যার চাপ কমাতে হবে।

আমি এখানে কিছু খালের কথা উল্লেখ করছি, যেগুলোর মধ্যে অনেকগুলো বর্তমানে নেই। আমাদের এগুলো উদ্ধার করতে হবে। ঢাকার পশ্চিম ও পূর্ব দিকে অনেক খাল ছিল। পশ্চিমের খালগুলো হলো আবদুল্লাহপুর, দিয়াবাড়ি, দেবুর, কল্যাণপুর ইত্যাদি খাল ও ধানমন্ডি লেক।

অন্যদিকে আগের খালগুলো হলো গোবিন্দপুর, রামপুরা, বাড্ডা ইত্যাদি। গুলশান-বনানী লেক, হাতিরঝিলসহ আমাদের খাল ও নদীগুলোর পানির উৎস নিয়ে ভাবতে হবে। শিল্পবর্জ্যে নদীগুলোর দূষণ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। 

সাম্প্রতিক সময়ে শিল্পকারখানা তুরাগ নদকে গ্রাস করছে। নদীগুলো থেকে জরুরিভাবে ময়লা-আবর্জনা অপসারণ করতে হবে। মৌসুমি সময়ে যমুনা নদী থেকে এসব খাল ও নদে পানি আসে। কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে জোয়ার-ভাটার কারণে পানি থাকে সামান্য। 

আমাদের এখানে পানি আনার উৎস নিয়ে ভাবতে হবে। নদী ও খালগুলো পুনরুদ্ধার করতে পারলে বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার ভেনিস হিসেবে আখ্যা দিতে পারব। 

মো. মুজিবুর রহমান
মো. মুজিবুর রহমান

মো. মুজিবুর রহমান: ঢাকার চারপাশের নদীদূষণ ও দখল বিষয়ে আমরা সবাই অবগত। ধনী-গরিব সবাই মিলে নির্বিচারে খাল ও নদী দূষণ করে চলেছি। দূষণের উৎসগুলো বেশ আগেই চিহ্নিত হয়েছে। এখন প্রয়োজন জরুরি ভিত্তিতে নদীগুলো দূষণমুক্তকরণের কার্যক্রম গ্রহণ করা।

স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে নদীদূষণ রোধ কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ, স্বল্পমেয়াদি কার্যক্রম গ্রহণের প্রস্তাব করছি, যা আগামী এক থেকে তিন বছরের মধ্যে বাস্তবায়ন করা সম্ভব এবং তাহলে নদীর পানির গুণগত মান উল্লেখযোগ্যভাবে ভালো হবে।

প্রথমত, বুড়িগঙ্গার উত্তর পাড় দিয়ে সব ধরনের পয়োবর্জ্য ও শিল্পবর্জ্য ডাইভারশন সুয়ারেজ লাইনের মাধ্যমে (হাতিরঝিলের অনুকরণে) নদীতে নিক্ষেপ না করে পাগলা সুয়েজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টে নিয়ে যেতে হবে।

দ্বিতীয়ত, কামরাঙ্গীরচর, কেরানীগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জের পয়োবর্জ্য ব্যবস্থাপনা (এফএসএম) যথাযথভাবে প্রয়োগের মাধ্যমে নদীদূষণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।

তৃতীয়ত, খাল, জলাভূমি ও নদীতে কঠিন বর্জ্য (গৃহস্থালি, শিল্প ও মেডিকেল) নিক্ষেপ নিষিদ্ধ করতে হবে। এবং

চতুর্থত, দাশেরকান্দি সুয়েজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট নির্মাণ দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন করতে হবে এবং ডিএনডি এলাকাসহ কয়েকটি স্থানে ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট নির্মাণ করতে হবে।

এ ছাড়া কিছু দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে; যার আওতায় শিল্পবর্জ্য দ্বারা দূষণের ক্ষেত্রে নীতিগত পরিবর্তন, স্যানিটারি সুয়ারেজ-ব্যবস্থার উন্নয়ন, খাল ও নদীর মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালীকরণের ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি।

ইকবাল হাবিব
ইকবাল হাবিব

ইকবাল হাবিব: ঢাকায় অসংখ্য প্রাকৃতিক খাল ছিল। আমরা সড়ক সম্প্রসারণের নামে ইচ্ছামতো বাঁধ দিয়ে খালের ওপর সড়ক নির্মাণ করেছি। ফলে খালগুলো মেরে ফেলার চূড়ান্ত উপায় বের করা হচ্ছে। যার যেভাবে ইচ্ছা, সেভাবে ভরাট করে আবাসন নির্মাণ করছে।

বর্ষায় ওয়াটার বাসগুলো চলার সময় বিভিন্ন ব্রিজের তলায় আটকে যাচ্ছে। বিভিন্ন নৌ-স্টেশন মূল সড়কের সঙ্গে সংযুক্ত নয়। এসব কারণে এ ধরনের প্রকল্প ব্যর্থ হয়েছে। হাতিরঝিলের মতো ভবিষ্যতে যখন গুলশান-বনানী লেক পরিপূর্ণতা পাবে, তখন আমরা হয়তো ভেনিসের কিছুটা স্বাদ পাব। 

আমরা স্বপ্ন দেখতে পারি। হাতিরঝিল ও ধানমন্ডি লেককে সংযুক্ত করার জন্য পান্থপথ ব্যবহার করতে পারি। সড়কে পার্কিং বন্ধ করে মাঝখান দিয়ে খালের মতো কেটে হাতিরঝিলের সঙ্গে সংযুক্ত করতে পারি। 

ধোলাই খালকে উদ্ধার করে পুরান ঢাকায়ও একটা হাতিরঝিল তৈরি করা সম্ভব। কল্যাণপুরের খালগুলো পুনরুদ্ধার করে দৃষ্টিনন্দন করা সম্ভব। বোটানিকাল গার্ডেনের উত্তরে দ্বিগুণ খালটাকেও সংরক্ষণ করার প্রকল্প গ্রহণ করা উচিত। 

সরকারের একটু ইশারা পেলেই আমরা বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীরা বিনা পারিশ্রমিকে সহযোগিতা করতে রাজি আছি।

এম বজলুল করিম চৌধুরী
এম বজলুল করিম চৌধুরী

এম বজলুল করিম চৌধুরী: রাজউকের দায়িত্ব হলো পরিকল্পনা, উন্নয়ন ও উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ করা। ড্যাপের (ঢাকা ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান) সঙ্গে মূলত আমরা সম্পৃক্ত। ২০১০-২০১৫ সাল পর্যন্ত যে ড্যাপ প্রণয়ন করা হয়েছিল, এর আলোকে ভূমি ব্যবহারের ছাড়পত্র ও উন্নয়নমূলক কাজের অনুমোদন দিয়ে থাকি।

আমাদের আলোচনায় নদীদূষণের যে কারণগুলো আমরা বুঝতে পারছি, সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টগুলো সেভাবে করা হয়নি। ড্যাপে বেশ কয়েকটি সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট দেখানো হয়েছে। 

সম্প্রতি জেনেছি, ঢাকা মহানগরকে কেন্দ্র করে ঢাকা ওয়াসার পাঁচটি সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের পরিকল্পনা রয়েছে। ড্যাপ পরিকল্পনার মধ্যে সাধারণ ও ভারী শিল্প জোন চিহ্নিত করা আছে। 

সঠিকভাবে ভূমি ব্যবহার করলে দূষণ অনেক কমে আসবে। ভূমি ব্যবহার বিধিমালা এবং পরিবেশ আইনে কঠোরভাবে অপরিশোধিত পানি শোধন (ইটিপি) করার বিধান আছে। অথচ আমরা মেনে চলি না। 

বেসরকারি আবাসিক প্রকল্পের ভূমি উন্নয়ন বিধিমালায়ও ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। পুরোনো ড্যাপের মেয়াদ শেষ হয়েছে। এখন নতুন ড্যাপের কাজ চলছে। এর মেয়াদ ২০৩৫ সাল পর্যন্ত হবে।

আলোচ্য ড্যাপে বিস্তারিতভাবে বলা থাকবে কোন প্রকল্প কোথায় করলে দূষণ কম হবে। হয়তো লক্ষ করবেন, আমরা প্রতিটি কমিউনিটিতে গিয়ে বৈঠক করছি, যাতে সবার আলোচনার ভিত্তিতে ত্রুটিমুক্ত একটি পরিকল্পনা করতে পারি। 

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হলে মামলা করতে পারে। ভারতে নদীকে ক্ষতিগ্রস্ত করলে নদীর পক্ষে সরকার মামলা করতে পারে। এ ক্ষেত্রে নদীকে মানুষের সম্মান দেওয়া হয়। বিভিন্ন আলোচনায় প্রায় সময় শুনি, নদীর একজন অভিভাবক লাগবে। একজন অভিভাবক থাকলেই সব সমস্যার সমাধান হবে না।

সরকারকে বিভিন্ন বিষয় সমন্বয় করতে শিখতে হবে। ঢাকার জলাশয়গুলোকে লিগ্যাল পারসন বিবেচনা করতে হবে। একটি অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ সরকারকে দেওয়া উচিত। নদীগুলো বাঁচলে অর্থনৈতিক সুবিধা কী হবে, সেটা দেখা উচিত।

আজকের প্রেজেনটেশনের (উপস্থাপনা) খাল ও নদী রক্ষার দিকনির্দেশনা সরকারকে দেওয়া যায়। প্রেজেনটেশনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নদীর পানিতে মানুষের কী কী ক্ষতি হচ্ছে, সে সম্পর্কে জানানো।

পরিবেশ অধিদপ্তরের এ ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা পালন করা উচিত। এখন চতুর্দিকে পানির মধ্যে সাইনবোর্ড। বিশেষ করে, আশুলিয়ার পাশ দিয়ে সাইনবোর্ড দেখতে আর সহ্য হয় না। অন্তত আশুলিয়ার দিকের সাইনবোর্ডগুলো যদি সরিয়ে ফেলা যায়, তাহলে তো বুঝতাম রাজউক এখনো আছে। 

বলা হয়েছে, ড্যাপ অনুযায়ী ভূমির ব্যবহার হবে। এখন ড্যাপই সঠিক হবে কি না, সেটা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কারণ ২০১০-১৫-এর ড্যাপটা মেরে ফেলার চেষ্টা হয়েছে। নতুন ড্যাপ দিয়ে সেটাকে আরও মেরে ফেলার চেষ্টা করা হবে। নতুন ড্যাপ বিদ্যমান জলাশয় আইনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। নতুন ড্যাপ দিয়ে পুরোনো জলাশয়গুলো হাউজিং দেখিয়ে দিলে হবে না। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী বলেছেন, ওই ড্যাপ যাঁরা করেছেন, তাঁরা বাসায় বসে বসে করেছেন। 

তাঁরা মাঠে গিয়ে দেখেন, কোনো জলাশয় নেই। সব নাকি ভরাট করা জায়গা। তাহলে জলাশয় আইন অনুযায়ী গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের ম্যান্ডেট হচ্ছে জলাশয় ফেরত আনা। নগরকে বাঁচানোর জন্য ড্যাপ গুরুত্বপূর্ণ। জলাশয়কে উদ্ধারে আপস করলে এ নগরকে বাঁচানো যাবে না। 

ড্যাপ করার একজন পরামর্শক হচ্ছে একটি গ্রুপ। এরা নিজেরাই আবাসন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। এমন একটি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে ড্যাপ করানো হলে তা বৃহত্তর কল্যাণে আসবে না। আমরা স্বপ্ন যা দেখি, পরিকল্পনা করি তার উল্টো।

মো. আবুল কাশেম
মো. আবুল কাশেম

মো. আবুল কাশেম: বুড়িগঙ্গাকে পরিষ্কার করতে ড্রেজিংয়ের মতো কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তবে কোনো সমন্বিত পরিকল্পনা না থাকায় এসব কার্যকর হয়নি। 

কিছুদিন আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পরিকল্পিত উদ্যোগ নেওয়া ও নদীদূষণের আসল কারণ খুঁজে বের করার কথা বলেছেন। নদী রক্ষায় একটি মহাপরিকল্পনার কথাও বলেছেন। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে ইতিমধ্যে একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি করা হয়েছে। 

কমিটির পক্ষ থেকে ওয়াসাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ঢাকা ওয়াসা ইতিমধ্যে কিছু কাজ করেছে। নদীদূষণের জন্য নয়টি উৎস দায়ী। এগুলো শনাক্ত করে কার কী করণীয়, টাইম লাইনসহ একটি প্রকল্প প্রণয়নের চেষ্টা করছি। 

আমরা আশা করছি, চলতি বছরেই কাজটি শেষ হয়ে যাবে। এর মধ্যে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে বৈঠক করব। তাদের সঙ্গে আলোচনা করেই সবকিছু চূড়ান্ত করব।

ঢাকা ওয়াসার একটি প্রধান কাজ পয়োবর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা। আমরা এর জন্য একটি মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করেছি। এর বাস্তবায়ন শুরু করেছি। এই প্ল্যানের মধ্যে ঢাকার চারপাশে পাঁচটি ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট করার বিষয় রয়েছে। এই মাস্টারপ্ল্যান ২০৩০ সাল নাগাদ পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা যাবে। 

আমরা একটি প্রাথমিক পরিকল্পনা নিয়েছি ২০২৫ সাল নাগাদ কাজগুলো করার। আমরা বলেছি, ২০২১ সাল নাগাদ পরিবেশবান্ধব গণমুখী পানির ব্যবস্থা করব। এ জন্য আমরা কাজও করছি পদ্মা ও মেঘনা থেকে পানি আনার।

বর্তমানে আমরা ৭৮ শতাংশ ভূগর্ভস্থ পানি আর ২২ শতাংশ ভূমির উপরিভাগের পানি ব্যবহার করি। আমরা চিন্তা করছি, ২০২১ সাল নাগাদ সেটা উল্টো হবে। তখন ৭০ শতাংশ পানি আমরা ভূ–উপরিস্থ থেকে নেব এবং ৩০ শতাংশ ভূগর্ভস্থ থেকে নেব।

সুলতান আহমেদ
সুলতান আহমেদ

সুলতান আহমেদ: ঢাকার চারপাশের চারটি খাল ও অন্যান্য জলাশয়কে যদি আমরা সমন্বিতভাবে না দেখি, তাহলে সমস্যার সমাধান হবে না। পরিদপ্তরের এনফোর্সমেন্ট আইন খুবই কঠোর, কিন্তু আমাদের সেই প্রাতিষ্ঠানিক সামর্থ্য বা সক্ষমতা নেই।

হাতিরঝিল উদ্ধারের পর আমাদের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়েছে যে আমরা পারি। পরিবেশ অধিদপ্তরও বিষয়টি গুরুত্বসহকারে চিন্তা করে। একসময় আমাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, অভ্যন্তরীণ খাল কীভাবে পুনরুদ্ধার করা যায় তার জন্য একটি প্রকল্প তৈরির।

ওই প্রকল্পে আমাদের সঙ্গে বিআইডব্লিউটিএ, দুই সিটি করপোরেশন, পাঁচটি জেলা প্রশাসন ও ওয়াসা ছিল। রাজউককে নিয়েও আমরা আরেকটি বড় প্রকল্প করেছিলাম। ওই প্রকল্পে বলেছিলাম, মূল কাজগুলো সবাই মিলে করবে। 

নদী পরিষ্কার করবে বিআইডব্লিউটিএ। টোটাল সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট করবে সিটি করপোরেশন। পরিবেশ অধিদপ্তর এনফোর্সমেন্ট কার্যক্রম চালাবে এবং সবকিছু অনলাইনে মনিটর করবে।

মো. শহীদুল ইসলাম
মো. শহীদুল ইসলাম

মো. শহীদুল ইসলাম: নদী ও খাল সরকারি জায়গা। সরকারের পক্ষে সেগুলো জেলা প্রশাসন দেখভাল করে। আমরা জানি, চারটি নদী ঢাকা শহরকে ঘিরে রেখেছে। এই নদীগুলোর দূষণ বা দখল নিয়ে বিভিন্ন সময় আলোচনা হয়েছে। 

এটা নিয়ে হাইকোর্টে মামলাও হয়েছে। এ ক্ষেত্রে মহামান্য আদালত কিছু সুনির্দিষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন। সেই পরিপ্রেক্ষিতে এই চারটি নদীর সীমানা নির্ধারণ করা হয়েছে এবং সেখানে পূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে সীমানা পিলারও দেওয়া হয়েছে। খালগুলোও উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। রেকর্ডে ৫২টি খাল আছে।

সিটি করপোরেশনের মেয়রের নেতৃত্বে আমরা ও ওয়াসা মিলে খালগুলো পরিমাপ করে এর আকার-আকৃতি চিহ্নিত করেছি এবং কোথায় অবৈধ স্থাপনা আছে, সেগুলোর তালিকা করে মেয়রের নির্দেশনা মোতাবেক দিয়েছি।

সবশেষে একটি বিষয় বলব, পানিদূষণের ক্ষেত্রে উৎসমুখে বাধা দিতে হবে এবং গণসচেতনতা তৈরি করতে হবে। এখানে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত না করলে দূষণ-দখল বন্ধ করা সত্যিই কঠিন হবে।

ইশরাত ইসলাম
ইশরাত ইসলাম

ইশরাত ইসলাম: নদী ও খাল মানবদেহের মতোই। ধমনি ও শিরা না থাকলে মানুষের বাঁচার সম্ভাবনা নেই। 

নদী-খাল ছাড়া মানবসভ্যতাও বাঁচে না। ঢাকায় ৫২টি খাল ছিল। বর্তমানে সেগুলো দৃশ্যমান নয়।

আমার প্রথম প্রস্তাব হচ্ছে, আমাদের এই খালগুলোর সীমানা নির্দিষ্ট করতে হবে। ড্যাপের পুরোনো গল্প আমরা অনেক শুনেছি। বোধ হয় একটা পর্যালোচনা হওয়া দরকার। ড্যাপে যে প্লাবনভূমি ছিল, সেটা এখন নেই কেন?

আমাদের ঢাকা শহরকে বাঁচানোর ভিশনটা কী? ঢাকা হবে একটি ওয়াটারগার্ডেন।

সেই ভিশনের মধ্যে যদি বেঁচে থাকার বিষয়টি থাকে, সে ক্ষেত্রে ৫২টি খালকে সম্পূর্ণভাবে উদ্ধার করতে হবে।

সবশেষে বলতে চাই, আমাদের একটি ওয়াটার বডি কনজারভেশন কাউন্সিল করা প্রয়োজন। সব ক্ষেত্রে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন একটি ওয়াটার বডি কনজারভেশন থাকলে সমন্বয়ের সুবিধা থাকবে এবং অনেক কিছু করা যাবে।

খন্দকার মনজুর মোর্শেদ
খন্দকার মনজুর মোর্শেদ

খন্দকার মনজুর মোর্শেদ: আজকের গোলটেবিল বৈঠকের মতো আমরাও অনেক সেমিনার করি। আমরা যখন বিভিন্ন সেমিনার করি, তখন বিভিন্ন সংস্থার প্রধান ও মাননীয় মন্ত্রীরাও থাকেন। তাঁদের সামনে অনেক সুপারিশ করি।

তাঁদের আশ্বাসে সুপারিশমালা পাঠিয়েও দিই। পরে সেগুলো কোথায় যে যায়, আমরা আর খুঁজে পাই না। ফলে আমাদের জানতে হবে, সুপারিশমালাগুলো কোথায় যাচ্ছে। আমার বক্তব্য হলো, আমরা এভাবে বলতে থাকব। হয়তো একদিন সেগুলোর বাস্তবায়ন হবে, এই আশা রাখি।

আকতার মাহমুদ
আকতার মাহমুদ

আকতার মাহমুদ: আমরা পরিবেশদূষণ থেকে বেরিয়ে আসা শুরু করছি বলে মনে করি। এর মধ্যে অনেক গণসচেতনতা তৈরি হয়েছে, অনেক প্রকল্প নেওয়াও হয়েছে। এসব প্রকল্প আমাদের আশান্বিত করে। 

সুতরাং, নদী, খাল, ঝিল, হ্রদগুলো সংরক্ষণ করা এবং সেগুলো ব্যবহার করার ব্যাপারে মানুষের মধ্যে একধরনের ইতিবাচক সাড়া এসেছে। গত কয়েক বছরে অনেক সিটি করপোরেশন-পৌরসভায় গিয়েছি। সেখানে তাদের দেখানোর চেষ্টা করেছি যে সব খাল ও নদী দূষিত হয়েছে, বেদখল হয়েছে, সেগুলো কীভাবে মানুষের ব্যবহারের উপযোগী করা যায়। 

স্টকহোম যেভাবে হ্রদ, খাল ও নদী নিয়ে পরিকল্পনা করেছিল এবং পরবর্তী সময়ে বাস্তবায়ন করেছিল, তার সুফল তারা এখনো পাচ্ছে। আজকে স্টকহোমের প্রতিটি জলাশয়ের পানির গুণাগুণ এমনভাবে সংরক্ষণ করা হয়, যাতে সেখান থেকে সরাসরি সুপেয় পানি ঘরে দেওয়া যায়।

সবশেষে আমি এটুকু বলতে চাই, আমরা যে প্রকল্পই প্রণয়ন করি না কেন, সেখানে যেন পরিবেশ সংবেদনশীলতার বিষয়টি থাকে।

কাজী এম আরিফ
কাজী এম আরিফ

কাজী এম আরিফ: আমরা পেশাজীবী সংগঠনগুলো সরকার, সরকারি প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে দোষারোপ করি। কিন্তু পেশাজীবী সংগঠন হিসেবে আমাদেরও যথেষ্ট দায় আছে। 

সরকারি-বেসরকারি আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলোতে পেশাজীবী সদস্যরা আছেন, প্রকৌশলীরা আছেন, পরিকল্পনাবিদ আছেন। ফলে পেশাজীবীরা এসব ক্ষেত্রে অনেক ভূমিকা রাখতে পারেন। পেশাজীবী সদস্যদের সুস্থ ও সচেতন পেশাচর্চার প্রতি বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট অনেক বেশি অঙ্গীকারবদ্ধ।

সত্য প্রসাদ মজুমদার
সত্য প্রসাদ মজুমদার

সত্য প্রসাদ মজুমদার: ঢাকা শহরের প্রত্যেক প্রকৌশলী, স্থপতি ও প্ল্যানারদের যে কর্তব্য, সেটা পরিষ্কার বুঝতে পারছি। এ ক্ষেত্রে রাজনীতিবিদের উদ্বুদ্ধ করতে না পারলে আমাদের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবে। 

রাজনীতিবিদদের বোঝাতে হবে, কী কী বিষয় জরুরি ভিত্তিতে করা উচিত। অনেক বেশি স্বপ্ন দেখা যায়। কিন্তু রাজনীতিবিদদের সহযোগিতা ছাড়া সেগুলো বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়।

মাহ্তাব উদ্দিন
মাহ্তাব উদ্দিন

মাহ্তাব উদ্দিন: ঢাকা শহরের সবচেয়ে ভালো জায়গা হওয়া দরকার নদীর পার্শ্ববর্তী জায়গাগুলো। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, ওই নদীগুলোর পাশে আমরা যেতে পারছি না। 

অনেক সময় আমরা অনেক পরিকল্পনা করি, কিন্তু সেগুলো সেভাবে বাস্তবায়িত হয় না। ফলে দূষণ অব্যাহত থাকে। আসুন, সবাই একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছাই, আমাদের নিজেদের জন্য এই ঢাকা শহর রক্ষা করা দরকার। 

শহরের চারপাশের নদীগুলোর পানি দূষণমুক্ত করতে না পারলে শুধু নদীগুলোই বিপর্যয়ের মুখে পড়বে না, সঙ্গে সঙ্গে শহরে বসবাসরত মানুষের জীবনেও বিপর্যয় নেমে আসবে।

সাদিকুল ইসলাম ভুঁইয়া
সাদিকুল ইসলাম ভুঁইয়া

সাদিকুল ইসলাম ভুঁইয়া: কোনো শহরের ভেতর বা পাশ দিয়ে বহমান একটি নদী সেই শহরের সৌন্দর্য ও গুণগত মান অনেক বাড়িয়ে দেয়। শহরকে আভিজাত্য এনে দেয়। 

দুর্ভাগ্য আমাদের, চারটি নদী বুকে ধারণ করা সত্ত্বেও পানিদূষণ আজ ঢাকা শহরের পরিবেশকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। দূষণের সব কারণ আমাদের ভালো জানা আছে। আমরা এ-ও জানি, অচিরেই নদীগুলো দূষণমুক্ত করতে ব্যর্থ হলে জাতীয় জীবনে বিপর্যয় নেমে আসবে। অভিজ্ঞ গবেষকেরা বলেছেন, ‘এখনো সব শেষ হয়ে যায়নি, এখনো এই করুণ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় আছে।’ এটি আশার কথা। ইদানীং কালে বুড়িগঙ্গার তলদেশের বর্জ্য পরিষ্কারের মতো সাময়িক প্রকল্প কোনো সুফল দেবে না। নদীগুলো বঁাচাতে হলে দ্রুত দীর্ঘমেয়াদি কার্যকর পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। পেশাজীবীরা নির্মাণে পারদর্শী। 

সব ক্ষেত্রে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারলেই নদীর পানি দূষণমুক্ত হবে। পেশাজীবীদের টেকসই প্রকল্প ব্যবস্থাপনায় পারদর্শী হতে হবে।

আব্দুল কাইয়ুম: নদীর পানি দূষণমুক্ত না হলে আমাদের জীবন ও পরিবেশ হুমকির মুখে পড়বে। ঢাকাসহ দেশের যেসব নদীর পানি দূষিত হয়েছে, সেগুলো দূষণমুক্ত করার কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। 

প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সবাইকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ।

যাঁরা অংশ নিলেন 

জামিলুর রেজা চৌধুরী     :  সভাপতি, বুয়েট অ্যালামনাই

সাদিকুল ইসলাম ভুঁইয়া    :  মহাসচিব, বুয়েট অ্যালামনাই

এম বজলুল করিম চৌধুরী :  চেয়ারম্যান, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)

মো. শহীদুল ইসলাম       :  যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত উপকমিশনার, রেভিনিউ

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান  :  প্রধান নির্বাহী, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)

খন্দকার মনজুর মোর্শেদ   :  ভাইস প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ প্রকৌশল ইনস্টিটিউশন (আইইবি)

মো. আবুল কাশেম        :  উপদেষ্টা, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ওয়াসা

মো. মুজিবুর রহমান       :  অধ্যাপক, পুরকৌশল বিভাগ, বুয়েট

ইকবাল হাবিব            :  সদস্যসচিব, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন

কাজী এম আরিফ         :  সাধারণ সম্পাদক, স্থপতি ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ

মো. আবদুল মতিন        :  অধ্যাপক, পানিসম্পদ বিভাগ, বুয়েট

ইশরাত ইসলাম           :  অধ্যাপক, নগর ও আঞ্চলিক পরিকল্পনা বিভাগ, বুয়েট

সুলতান আহমেদ          :  পরিচালক, পরিবেশ অধিদপ্তর, পরিবেশ মন্ত্রণালয়

আকতার মাহমুদ           :  সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানিং

মাহ্তাব উদ্দিন            :  সচিব, মেম্বার সার্ভিসেস, বুয়েট অ্যালামনাই

সত্য প্রসাদ মজুমদার      :  পরিচালক, ছাত্রকল্যাণ, বুয়েট

সঞ্চালক

জামিলুর রেজা চৌধুরী     :  সভাপতি, বুয়েট অ্যালামনাই

আব্দুল কাইয়ুম              :  সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো