নদী আটকে চীনের বাঁধ ও শত বছরের ধ্বংসযজ্ঞ

চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টি অব চায়না (সিপিসি) ১ জুলাই তার শততম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্‌যাপন করবে। এক শ বছরের বড় বড় অর্জনকে তুলে ধরবে। এসব অর্জনের একটি হলো তিব্বত মালভূমির দক্ষিণ–পূর্ব প্রান্তের জিনশা নদীর ওপর নির্মিত বাইহেতান জলবিদ্যুৎ বাঁধ নির্মাণ। ওই দিন বাঁধের কার্যক্রম চালু হবে।

চীনের সিপিসি সরকার বরাবরই ‘সবচেয়ে বড়’ অভিধা পছন্দ করে। তারা বিশ্বের সবচেয়ে বৃহত্তম পণ্য উৎপাদনকারী ও রপ্তানিকারক। তাদের হাতে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বৈদেশিক রিজার্ভ। তারা বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু স্থানে রেলওয়ে স্থাপন ও সবচেয়ে উঁচু ও দীর্ঘতম সেতু বানানোর রেকর্ড অর্জনকারী দেশ। চীনেই যতসংখ্যক বাঁধ আছে, তা বাকি বিশ্বের সব বাঁধের সংখ্যার চেয়ে বেশি। বিশ্বের সবচেয়ে বড় পানি সরবরাহকারী ক্যানাল সিস্টেম নিয়েও তাদের গৌরব আছে।

বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার দিক থেকে তাদের থ্রি জর্জেজ ড্যাম নামের বাঁধ প্রকল্প আগে থেকেই বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র। আর বাইহেতান ড্যাম নামের যে বাঁধটি উদ্বোধন করা হতে যাচ্ছে, সেটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় ফটকওয়ালা বাঁধ। শুধু তাই নয়, এটিই হতে যাচ্ছে বিশ্বের প্রথম কোনো বাঁধ প্রকল্প, যেখানে এক গিগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম দানবাকৃতির হাইড্রো টারবাইন ব্যবহৃত হবে। এ রকমের ১৬টি জেনারেটর থাকবে এ বাঁধে, যা এটিকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম হাইড্রোইলেকট্রিক ড্যাম হিসেবে দাঁড় করাবে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিক থেকে প্রথম স্থানে আছে থ্রি জর্জেজ ড্যাম, যার বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা সাড়ে ২২ গিগাওয়াট।

চীনের এই বড় বড় বাঁধ শুধু যে দেশটির অভ্যন্তরীণ পানি সুরক্ষা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে করা হয়েছে তা নয়, বরং ভাটির দেশগুলোর ওপর খবরদারি করার ক্ষেত্রে এ বাঁধগুলোকে যাতে ব্যবহার করা যায়, সেটিও তারা নিশ্চিত করছে। পানিসমৃদ্ধ তিব্বত মালভূমিতে সিপিসি ১৯৫১ সালে দখলদারি প্রতিষ্ঠা করার পরই এশিয়ার পানি মানচিত্রে চীন প্রবল ক্ষমতাধর হয়ে ওঠে। পানিসম্পদে চীনের প্রবল ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠার সেটিই ছিল স্টার্টিং পয়েন্ট। মেকং নদী দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ায় যে পয়েন্ট দিয়ে ঢুকেছে, ঠিক তার আগে চীন ১১টি বিশাল বিশাল বাঁধ দিয়ে পানির প্রবাহ ঘুরিয়ে দিয়েছে। তাদের এ কাজের খেসারত দিতে হয়েছে এশিয়ার বহু নদীকে। বহু নদীর প্রবাহ দুর্বল হয়ে পড়েছে। এমনকি চীনের ভেতরে থাকা ইয়েলো এবং ইয়াংজি নদীও এ প্রকল্পের কারণে পানিপ্রবাহ হারিয়েছে।

বৃহৎ বাঁধ প্রকল্প পুরো ইকোসিস্টেমের ক্ষতি করে। স্বাদুপানির জীবকে ধ্বংস করে দেয়, বদ্বীপগুলোকে ক্ষয় করে। এটি জীবাশ্ম জ্বালানির চেয়ে বেশি গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন করে। এসব বাঁধের কারণে চীনের ভেতরেই সাড়ে তিন শর বেশি হ্রদ শুকিয়ে মরে গেছে এবং বহু নদীর পানিপ্রবাহ কমে গেছে।

শুরুতে বানানো বাঁধ দুর্বল সরঞ্জাম দিয়ে বানানো হয়েছিল। নির্মাণগত ত্রুটিও ছিল। এতে বাঁধ ভেঙে পানি বন্যা হয়ে লোকালয়ে ঢুকে অগণিত মানুষের প্রাণহানি ঘটিয়েছে। ১৯৮১ সাল পর্যন্ত তাদের ৩ হাজার ২০০ বাঁধ ভেঙেছে। ১৯৭৫ সালে শুধু বানকিয়াও বাঁধ ভেঙেই ২ লাখ ৩০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। এ ধরনের বাঁধ প্রকল্প করতে গিয়ে অগণিত মানুষকে ভিটেবাড়ি থেকে সরিয়ে নিতে হয়। ২০০৭ সালে কয়েকটি বাঁধ প্রকল্পের জন্য ২ কোটি ২৯ লাখ মানুষকে তৎকালীন ওয়েন জিয়াবাও সরকার এক জায়গা থেকে সরিয়ে অন্যত্র পুনর্বাসন করেছিল। থ্রি জর্জেজ ড্যাম ১৪ লাখ লোককে বাস্তুচ্যুত করেছিল।

চীন এখন তাদের ভূখণ্ডে ইয়ারলাং জাংবো নদীতে (ভারতে পড়া এই নদীর নাম ব্রহ্মপুত্র) বিশ্বের প্রথম সুপার ড্যাম নির্মাণ করতে চাইছে। ব্রহ্মপুত্র হিমালয়ের গা বেয়ে ইউটার্ন নিয়ে প্রবাহিত হয়েছে এবং এটি এই গ্রহের দীর্ঘতম এবং গভীরতম পার্বত্য নদী। সমুদ্র সমতল থেকে ৯ হাজার ২০০ মিটার উঁচু থেকে নিচের দিকে ধেয়ে এ নদী চীনের মধ্য দিয়ে হয়ে ভারতে পড়েছে। এ নদীর গতিপথে বাঁধ দিয়ে যে সুপার ড্যাম বানানো হবে, তার বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ৬০ গিগাওয়াট, অর্থাৎ সবচেয়ে বেশি উৎপাদন সক্ষম থ্রি জর্জেজ ড্যামের চেয়ে এর উৎপাদনক্ষমতা তিন গুণ।

চীন ইতিমধ্যেই এ প্রকল্পের পরোক্ষ কাজ শুরু করে দিয়েছে। সম্প্রতি তারা বাঁধের জায়গা পর্যন্ত মহাসড়ক বানানোর কাজ শেষ করেছে। সেখানকার সামরিক নগরে দ্রুতগতির ট্রেনও চালুর কাজ চলছে। এটি শেষ হলেই বাঁধের সরঞ্জাম সেখানে পরিবহন করা শুরু হয়ে যাবে।

সিপিসি এ কাজকে উদ্‌যাপনের বিষয় হিসেবে দেখছে। কিন্তু তার ফলে বাকি বিশ্বের যে কী ক্ষতি হবে, তা তারা বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

ব্রহ্ম চেলানি নয়াদিল্লিভিত্তিক সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের অধ্যাপক