
কোনো জাতিকে বিচার করতে হয় তার গড় মানুষের স্বভাব-চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য দিয়ে, তার শ্রেষ্ঠ মানুষ বা নিকৃষ্ট মানুষদের দিয়ে নয়। সব জার্মান ইমানুয়েল কান্ট বা অ্যাডল্ফ হিটলারের মতো নয়। সব বাঙালি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, স্বামী বিবেকানন্দ, কাজী নজরুল ইসলাম বা অমর্ত্য সেনের মতো নয়। ১০০ জনের মধ্যেও একজন বাঙালিও এরশাদ সিকদার বা কালা জাহাঙ্গীরের মতো নয়। কোনো জনগোষ্ঠীর গড় মানুষেরা, যারা সংখ্যায় অধিকাংশ, তারা যেমন অতি ভালো মানুষ বা মহা মেধাবী নয়, তেমনি নিষ্ঠুর স্বভাববিশিষ্ট বা মহা দুর্বৃত্তও নয়। যে সমাজের গড় মানুষেরও অধিকাংশের মধ্যে মানবিক গুণের পরিমাণ বেশি, সেই সমাজই ভালো সমাজ।
বাঙালি সমাজে চুরি-ডাকাতি, খুন-রাহাজানি, নারী নির্যাতন-ধর্ষণ চিরকালই ছিল, তার মাত্রা যা-ই হোক। গড়পড়তা বাঙালির মধ্যে নিষ্ঠুরতা কম ছিল, তা বলা যাবে না। অপরাধ ছিল বলেই অগ্নিপরীক্ষা, ধান-পরীক্ষা প্রভৃতি শাস্তির বিধান ছিল। অপরাধের তারতম্য অনুযায়ী বা ধরন বুঝে কারও হলো অগ্নিপরীক্ষা। অভিযুক্তকে দাউ দাউ করে জ্বলা আগুনের ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে বলা হতো। কাউকে ধান চিবিয়ে খেতে বলা হতো। কাউকে দেওয়া হতো প্রাণদণ্ড শূলে চড়িয়ে, অর্থাৎ লোহার শিকের তীক্ষ্ণ শলাকার ওপর দোষীকে এমনভাবে বসানো হতো যেন সেটি গুহ্যদ্বার দিয়ে ঢুকে মাথার চাঁদি দিয়ে বেরিয়ে যায়। শূলে চড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া ভালো না ক্রসফায়ারে দিয়ে মারা ভালো, তা অপরাধবিজ্ঞানী ও নীতিবাগীশদের পর্যবেক্ষণের বিষয়।
আদর্শ সমাজ ও রাষ্ট্রে জঘন্য অপরাধ খুবই কম। নিকৃষ্ট সমাজ ও নষ্ট রাষ্ট্রে বর্বরোচিত অপরাধ ও নিষ্ঠুরতার পরিমাণ খুব বেশি। হাইতি বা সোমালিয়ায় গড় মানুষ যে জাতীয় অপরাধ করে; জাপান, কোরিয়া বা সুইজারল্যান্ডের মানুষ তা করে না। এসব জাতির জিনে তেমন উপাদানই নেই, যার কারণে তারা বর্বরোচিত কাজ করতে পারে। নারীর ওপর যৌন নিপীড়ন ও হত্যাকাণ্ড আমেরিকার সমাজেও খুব বেশি, কিন্তু তার প্রকৃতি বাংলাদেশের চেয়ে আলাদা।
গত মাস দুইয়ের ১০টি দৈনিকে প্রকাশিত এবং কয়েকটি টিভি চ্যানেলে প্রচারিত অপরাধ ও নির্যাতনের ঘটনাগুলোর একটি হিসাব করে আমি দেখেছি প্রায় ৫৫ ধরনের অপরাধ ও নির্যাতন। পৈশাচিক উল্লাসে গণপিটুনিতে হত্যাসহ বিভিন্নভাবে খুন-জখম তো আছেই, নানা রকম নির্যাতনের ধরনও অভিনব। সাত ‘ডাকাতকে’ পিটিয়ে মারা হলো, সমাজ নির্বিকার। চোখ ওপড়ানো এখন খুবই সহজ।
দিনের পর দিন গাছের সঙ্গে শিকল দিয়ে বেঁধে নির্যাতন। গাছটির পাশ দিয়ে এলাকার মানুষ যাতায়াত করছে। কেউ নির্যাতিতকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসে না। অনেকে কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে মেয়েটি বা ছেলেটির নির্যাতন ও আর্তনাদ উপভোগ করে। সংগঠিত হয়ে কেউ প্রতিবাদ করে না। বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটের বাড়ির শিশু গৃহকর্মীর ওপর দীর্ঘদিন ধরে যে নির্যাতন চলে, তা আশপাশের কোনো বাড়ির কেউ
বা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে তদবিরের জন্য যাতায়াতকারী কারও চোখে পড়েনি, তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। ম্যাজিস্ট্রেট ও তাঁর স্ত্রী মেয়েটিকে শারীরিকভাবে মারধর করে জখম করেছেন শুধু তা-ই নয়, পত্রিকায় যে হাড়সর্বস্ব মেয়েটির ছবি দেখেছি, তাতে ওকে যে পেটভরে খেতেই দেওয়া হতো না, তা পরিষ্কার। এখন ম্যাজিস্ট্রেটকে দিন কয়েক বিচারিক কাজ থেকে ছুটি দেওয়া এবং বসিয়ে বসিয়ে জনগণের টাকায় মাইনে দেওয়া ঘোরতর অবিচার।
লম্পটদের অত্যাচারে হাজার হাজার মেয়ে শিক্ষার্থীর জীবন আজ দুর্বিষহ। অনেকে স্কুল-কলেজে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে বলে অভিযোগ পেয়েছি। মাস তিনেক আগে উপজেলা পর্যায়ের একজন নারী বিসিএস অফিসার, যাঁর বয়স তিরিশের কোঠায়, আমাকে ফোনে বলেছেন, তাঁকে পর্যন্ত বখাটে ছেলেরা উত্ত্যক্ত করে। লম্পটদের অত্যাচার সইতে না পেরে গত কয়েক মাসে আমার হিসাবে আত্মহত্যা করেছে অন্তত ১৩টি মেয়ে। তারা সবাই স্কুলের ছাত্রী। গত কয়েক মাসে জনা দশেক বখাটেকে ভ্রাম্যমাণ আদালত বিভিন্ন স্বল্প মেয়াদে সাজা দিয়েছেন। তাদের যে অপরাধ, তাতে কিছু টাকা জরিমানা ও দিন কয়েকের কারাবাস কোনো শাস্তিই নয়।
ক্ষমতাবানদের অপরাধ ধর্তব্যের মধ্যেই নয়। সাম্প্রতিক সময়ে জনা আটেক পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা সরকারি দল ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের এবং মাননীয় সাংসদদের চড়-থাপড় ও লাথি খেয়েছেন। নির্যাতিতদের মধ্যে বিসিএস কর্মকর্তা, প্রকৌশলী প্রভৃতি পদমর্যাদার অফিসার রয়েছেন। গত কয়েক দিনে ছাত্রলীগ, যুবলীগের কয়েকজন নেতা-কর্মী ‘বন্দুকযুদ্ধে’ পড়েছেন। তাঁদের ‘বন্দুকযুদ্ধে’ হত্যা করে অন্য দলের মধ্যে ভীতি সঞ্চার করা হচ্ছে দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য; কিন্তু বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারের সম্পূর্ণ বরখেলাপ।
অনাচার ও অপরাধের বৈচিত্র্যের শেষ নেই। অসুস্থ মানসিকতা সর্বত্র। এক রাতে কে বা কারা বাগানের কয়েক শ কলাগাছ, যেগুলোতে থোড় আসবে আসবে করছিল, তা কেটে ফেলে। হতে পারে শত্রুতাবশত অথবা পরশ্রীকাতরতা থেকে। পুকুরে মাছ চাষ করে কেউ তার আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন করেছে, সহ্য হচ্ছে না তার প্রতিবেশীর। পুকুরের লাখ লাখ টাকার মাছ বিষ দিয়ে মেরে ফেলছে। রাষ্ট্র বলবে আমি কারও পুকুরের মাছ পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব নিইনি। যার মাছ, পুকুরপাড়ে টং বানিয়ে সে সারা রাত জেগে পাহারা দিক। মাছচাষির প্রতিবেশী বিষের শিশি নিয়ে ঘুরে বেড়ালে রাষ্ট্র তার পিছে পিছে গোয়েন্দার মতো ঘুরতে পারে না।
গত ৪৫ বছরে গড় বাঙালির একটি চরিত্র গড়ে উঠেছে। কিছুকাল যাবৎ ঝাড়ুমিছিল প্রতিবাদের একটা উত্তম মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। কৃষক ধানের উপযুক্ত দাম পাচ্ছেন না। মহাসড়কে মাটি ফেলে ধানের চারা বুনে প্রতিবাদ। সড়কপথের লাখ লাখ যাত্রীর আটকা পড়ে দুর্ভোগের শেষ নেই। কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দাবি আদায়ে, পরীক্ষার তারিখ পেছাতে, রাজপথ অবরোধ। কোথাও পাদুকা মিছিল। যে পাদুকা পায়ে শোভা পাওয়ার জিনিস, তা প্রতিবাদকারীদের হাতে। টিভি চ্যানেলের ক্যামেরা দেখলেই সে স্যান্ডেল–জুতা ঝান্ডার মতো উঁচুতে তুলে ধরে নাড়াতে থাকে। বাঙালির প্রতিবাদ সংস্কৃতিতে থুতু ছিটানো একটি নতুন পদ্ধতি হিসেবে এরই মধ্যে গৃহীত হয়ে গেছে।
বাঙালি দুই ভাগে বিভক্ত। এক অংশের চক্ষুলজ্জার লেশমাত্র নেই। যখন যা খুশি করতে বা বলতে তারা লজ্জিত হয় না। আরেক অংশের এতই শরম যে একজন ক্ষমতাধর দুর্নীতিবাজ ও নষ্ট মানুষকে বলতে পারে না: আপনি তো খারাপ কাজ করছেন, আপনি মানুষ ভালো নন। সমাজের ভালো মানুষেরা যখন নিষ্ক্রিয় থাকে, তখন সমাজে অনাচার ও অপরাধ অপ্রতিহত থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক।
অধিকাংশ মানুষ নিজে অন্যায় করে না, অপরাধও করে না, কিন্তু অন্যায়-অপরাধের উপযুক্ত প্রতিবাদও করে না। আজ সংবাদমাধ্যমের ওপর সব দায়দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে সাধারণ মানুষ চুপচাপ বসে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে বসেও থাকে না, কিছু কিছু বিষয় তারা উপভোগ করে। এলাকার সুপরিচিত দুর্বৃত্তরা আধিপত্য বিস্তারে আগ্নেয়াস্ত্র এস্তেমাল করে। একজন অন্তঃসত্ত্বা নারী শুধু আহত হওয়া নয়, তার গর্ভের সন্তানটিও গুলিতে ঝাঁঝরা হয়। সন্ত্রাসীদের ধরে আইনের আওতায় আনতে এলাকার মানুষের ভূমিকা দেখা গেল না। ডাক্তাররা সাধ্যমতো চেষ্টা করে, মিডিয়ার নজরদারিতে, মা ও সন্তানকে সুস্থ করে তোলেন। সেই মা ও শিশুকে দেখার জন্য হাজারো মানুষের ভিড়। যে মুহূর্তে তাদের প্রয়োজন বিশ্রাম, তখন মানুষের কৌতূহল মেটাতেই তাদের জীবন অতিষ্ঠ। আমি দেখেছি কোথাও অগ্নিকাণ্ড বা দুর্ঘটনা হলে, সেখানে তামাশা দেখতে হাজারো মানুষের জটলা। ফায়ার সার্ভিস ও উদ্ধারকর্মীদের পক্ষে নির্বিঘ্নে কাজ করা কঠিন। কোথাও দেখেছি পুলিশ পিটিয়ে জনতাকে সরাচ্ছে।
কোনো জাতির সব ব্যাপারে স্ট্যান্ডার্ড বা মান তৈরি খুব জরুরি। তার শিক্ষা, শিল্প-সাহিত্য, পাবলিক সার্ভিস—সবকিছুরই একটা ন্যূনতম মান নির্দিষ্ট থাকতে হবে। পরাধীন ইংরেজ আমলে একটি উঁচু মান তৈরি হয়েছিল সব ক্ষেত্রে। বাহাত্তর পর্যন্তও একটি মোটের ওপর মান ছিল। বাঙালি সমাজে তদবির চিরকালই ছিল। কিন্তু যেদিন বাঙালির স্বাধীনতা ও তদবির সমার্থক হয়, সেদিন থেকে তার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। নির্বিচারে জিপিএ-৫ বা গোল্ডেন জিপিএ যদি উনিশ শতকে থাকত, তাহলে মাইকেল, বঙ্কিমচন্দ্র, জগদীশ বসু তো দূরের কথা আক্কেল আলী বেপারীর মতো লেখকও আমরা পেতাম না। বাঙালি জাতি পড়ে থাকত মধ্যযুগে। যদিও মধ্যযুগেও সংস্কৃত টোল, চতুষ্পাঠী এবং ইসলামি মাদ্রাসার শিক্ষার মান ছিল উঁচু। ১৯৪০-এর দশক পর্যন্ত মাদ্রাসা শিক্ষার মান ছিল উঁচু। বিজ্ঞানী কুদরাত-এ-খুদা মাদ্রাসারই ছাত্র ছিলেন।
কোনো সমাজে যদি মান নির্দিষ্ট করা না থাকে, সেখানে যা খুশি তা-ই হতে থাকবে। ফলে যাঁর মাধ্যমিক স্কুলে শিক্ষকতা করার যোগ্যতা, তিনি অবলীলায় পেয়ে যাবেন কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বা সহ-উপাচার্যের আসন। যাঁর হওয়ার যোগ্যতা সিনিয়র সহকারী সচিব, তিনি পাবেন সিনিয়র সচিবের পদ। যাঁর ভাষার ওপর দক্ষতা সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের দলিল লেখকের সমান, তিনি ভূষিত হবেন সেরা মননশীল লেখক হিসেবে জাতীয় পুরস্কারে। মানহীনতাই কোনো জাতির অধঃপতনের প্রধান কারণ।
মানুষের সমাজ আর মানবিক সমাজ দুই জিনিস। মানুষের সমাজকে মানবিক সমাজে পরিণত করার মধ্যেই সমাজপতিদের কৃতিত্ব। নিষ্ঠুর উপায়ে কোনো আদর্শ সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণ করা গেছে এমন একটি দৃষ্টান্তও গত আড়াই হাজার বছরে পৃথিবীর কোথাও নেই।
সক্রেটিস আদর্শ রাষ্ট্রের রূপকল্প দিয়েছিলেন। অনুসারীরা একদিন তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনার আদর্শ রাষ্ট্র যথার্থই আদর্শ ও ভালো, কিন্তু সেই রকম একটি রাষ্ট্র কোথায় আছে, বলবেন কি?
সক্রেটিস ছিলেন সরল-সোজা মানুষ, কিন্তু বেকুব নন। তিনি অপ্রস্তুত না হয়ে শিষ্যদের বললেন: আদর্শ রাষ্ট্র বর্তমানে যদি কোথাও না থেকে থাকে তাতে হলোটা কি? আদর্শ রাষ্ট্রের ধারণাটি তো মূল্যহীন নয়। আদর্শ বাস্তবের চেয়েও বেশি বাস্তব। দ্য আইডিয়াল ইজ মোর রিয়াল দ্যান দ্য রিয়াল।
সক্রেটিসের এই দার্শনিক কথাটির তাৎপর্য বোঝার জন্য খুব বেশি বড় মাথার দরকার নেই। যে বুঝতে চাইবে তার পক্ষেই বোঝা সম্ভব। যে চাইবে না তার মাথায় লাঠি দিয়ে বাড়ি মেরেও বোঝানো যাবে না।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷