নারায়ণগঞ্জের নির্বাচন নিয়ে যে আলোচনা কেউ করছে না

নারায়ণগঞ্জ দেশের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দর ও বাণিজ্যিক মহানগর। ১৯৬০-এর দশকে ঢাকা ও চট্টগ্রামের পর নারায়ণগঞ্জ ছিল দেশের তৃতীয় বৃহত্তম শিল্পনগরী এবং তারও আগে অবিভক্ত বাংলার অন্যতম প্রধান নদীবন্দর। ‘প্রাচ্যের ড্যান্ডি’ নামে একদা খ্যাত এ নগরী ছিল দেশের পাটকল ও পাট-বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র। কালক্রমে পাটশিল্পের অবক্ষয় হলেও আবার পোশাকশিল্পে নারায়ণগঞ্জ এখন পুনরুজ্জীবিত। ১৮৭৬ সালে নারায়ণগঞ্জে পৌরসভা শুরু হয় এবং ২০১১ সালে পুরোনো নারায়ণগঞ্জ ও কদমরসুল পৌরসভাকে এক করে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভা দেশের সপ্তম সিটি করপোরেশনে উন্নীত হয়। এ সিটি এখন তৃতীয় নির্বাচনের দ্বারপ্রান্তে। ১৬ জানুয়ারি এ সিটির নির্বাচন।

নারায়ণগঞ্জের ‘সিটি নির্বাচন ২০১১’ নিয়ে সারা দেশ আগ্রহভরে অপেক্ষমাণ ছিল। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী প্রদত্ত ভোটের ৬৫ শতাংশ (১ লাখ ৮০ হাজার ৪৮) পেয়ে নির্বাচিত হন। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ প্রার্থী শামীম ওসমান পান ৭৮ হাজার ৭০৫ (২৮ শতাংশ) ভোট। ২০১১ সালে শেষ মুহূর্তে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে বিএনপি একটি সিরিয়াস কৌশলগত পদক্ষেপ গ্রহণ করে। তাতে ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী আইভীর সুবিধা হয়। ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী হিসেবে আইভী ১ লাখ ৭৪ হাজার ৬০২ ভোটে আবার নির্বাচিত হন। সেবার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বিএনপির স্বল্প পরিচিত নেতা আইনজীবী সাখাওয়াত হোসেন। তিনি পান ৯৬ হাজার ৭০০ ভোট। ২০১১ সালে মোট প্রদত্ত ভোট ছিল ৭০ শতাংশ এবং ২০১৬ সালে তা ৬২ শতাংশে নেমে আসে। ২০১৪ সালের পর সারা দেশের নির্বাচনে, বিশেষত ভোটার অংশগ্রহণে বিপর্যয় দেখা দিলেও নারায়ণগঞ্জের নির্বাচন ছিল একটি উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। এবারের ২০২২ সালের নির্বাচনও সারা দেশের তুলনায় নারায়ণগঞ্জে এখন পর্যন্ত ব্যতিক্রমী ধারা অব্যাহত রেখেছে। প্রচারযুদ্ধে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হলেও প্রচার-প্রচারণা স্বাভাবিক ও শান্তিপূর্ণ।

নারায়ণগঞ্জ শহরের সব মানুষের জন্য নিরাপদ পানির সংস্থান এ শহরের একটি প্রধান চ্যালেঞ্জ। এখন ওয়াসার সরবরাহ করা পানি আর পানযোগ্য নয়। ইতিমধ্যে ওয়াসা থেকে সে দায়িত্ব নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন গ্রহণ করতে যাচ্ছে। তাদের সে চ্যালেঞ্জ সফলভাবে মোকাবিলা করতে হবে। এ অঞ্চলের সব কলকারখানার ইটিপিগুলো সচল নয় কিংবা শিল্পবর্জ্য শোধনে পরিপূর্ণভাবে সক্ষম নয়। পরিবেশ ব্যবস্থাপনার গুরুতর দুর্বলতা ও উদাসীনতা দিনে দিনে শীতলক্ষ্যাকে মৃত নদীতে রূপান্তর করছে। শীতলক্ষ্যাকে বাঁচিয়ে তোলা এ অঞ্চলের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

আওয়ামী লীগের সেলিনা হায়াৎ আইভী এবং বিএনপির সাবেক নেতা তৈমুর আলম খন্দকার এ নির্বাচনের প্রধান দুই প্রার্থী। প্রার্থী না হয়েও নির্বাচনী প্রচারণার কেন্দ্রবিন্দুতে এখনো সাংসদ শামীম ওসমান পরিপূর্ণভাবে প্রাসঙ্গিক। আইভীর প্রচারণায় তাঁর ছায়া এখনো তাড়িয়ে বেড়ায়। দুই প্রধান প্রার্থী ও শামীম ওসমানের ছায়া-প্রচ্ছায়া নিয়ে যত আলোচনা, শহরের অন্য পাঁচ মেয়র প্রার্থী, ২৭ ওয়ার্ডের সাধারণ কাউন্সিলর এবং সংরক্ষিত আসনের মহিলা কাউন্সিলরদের নিয়ে কার্যকর কোনো আলাপ-আলোচনা নেই। নেই নারায়ণগঞ্জের নিরাপদ পানি, শীতলক্ষ্যার দূষণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, যানজটে অচলপ্রায় যোগাযোগব্যবস্থা, অপরিকল্পিত নগর উন্নয়নের কোনো ইস্যু নিয়ে কোথাও কোনো অর্থবহ আলোচনা।

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের (এনসিসি) জন্য আগামী দিনে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে। এর মধ্যে প্রধান ছয়টি চ্যালেঞ্জ নিম্নরূপ: ১. নারায়ণগঞ্জ শহরের সব মানুষের জন্য নিরাপদ পানির সংস্থান এ শহরের একটি প্রধান চ্যালেঞ্জ। এখন ওয়াসার সরবরাহ করা পানি আর পানযোগ্য নয়। ইতিমধ্যে ওয়াসা থেকে সে দায়িত্ব নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন গ্রহণ করতে যাচ্ছে। তাদের সে চ্যালেঞ্জ সফলভাবে মোকাবিলা করতে হবে। ২. গাজীপুর, নরসিংদী ও নারায়ণগঞ্জ—এ তিন জেলার মানুষ ও প্রশাসনকে সঙ্গে নিয়ে ধলেশ্বরী ও শীতলক্ষ্যাকে দূষণমুক্ত করতে হবে। ধলেশ্বরী ও শীতলক্ষ্যার পানি এখন শোধন করেও পান বা ব্যবহারের যোগ্য নয়। ৩. এ অঞ্চলের সব কলকারখানার ইটিপিগুলো সচল নয় কিংবা শিল্পবর্জ্য শোধনে পরিপূর্ণভাবে সক্ষম নয়। পরিবেশ ব্যবস্থাপনার গুরুতর দুর্বলতা ও উদাসীনতা দিনে দিনে শীতলক্ষ্যাকে মৃত নদীতে রূপান্তর করছে। শীতলক্ষ্যাকে বাঁচিয়ে তোলা এ অঞ্চলের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ৪. বর্তমানের ৭২ কিলোমিটার আয়তনের খণ্ডিত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনকে তার একটি যোগ্য পরিসর দিতে হবে।

বিশেষজ্ঞদের গবেষণায় দেখা যায়, এ সিটি করপোরেশনের আয়তন বাড়িয়ে অন্তত ১৫০ কিলোমিটার করা হলে এটি সেবা প্রদান, অর্থসংস্থান, যোগাযোগ-পরিবহন—সব দিক দিয়ে একটি উপযুক্ত পরিসর পাবে। আঞ্চলিক যোগাযোগ ‘হাব’। এমআরটি, বিআরটি ও সাবওয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আঞ্চলিক যোগাযোগ হাবের অংশ হতে পারবে।

এখন পশ্চিমের অনেকগুলো ইউনিয়ন পরিষদ সিটির নানা সেবা পেলেও তারা করপোরেশনের আওতাভুক্ত নয়। এমনকি নারায়ণগঞ্জের ডেপুটি কমিশনার কার্যালয় সিটি করপোরেশনের বাইরে। এত ক্ষুদ্র পরিসরে এ সিটি করপোরেশন একটি শক্তিশালী ও কার্যকর প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হতে পারবে না। তাই সিটির পরিসরকে যৌক্তিকভাবে সম্প্রসারণ করতে হবে। ৫. সিটি করপোরেশন কর্মিস্বল্পতায় ভুগছে দীর্ঘদিন। ৬৮৩ জনের অনুমোদিত সংগঠন কাঠামো থাকলেও তারা ১৪০ জনের কম জনবল নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে এবং ৬. কাউন্সিলররা সম্পূর্ণভাবে করপোরেশনের নীতিনির্ধারণের প্রক্রিয়ায় সংযুক্ত থাকেন না বা করা হয় না। তাঁদের সঠিকভাবে সংযুক্ত করতে হবে। করপোরেশনের নিয়মিত সভাগুলোকে প্রাণবন্ত, স্থায়ী কমিটিগুলোকে সক্রিয় এবং সর্বোপরি কাউন্সিলকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে স্থাপন করতে হবে।

নারায়ণগঞ্জের সুষম উন্নয়নের জন্য নারায়ণগঞ্জের নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ, পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসকের দপ্তর, শিল্প মন্ত্রণালয়, পানি উন্নয়ন বোর্ড, ঢাকা ওয়াসা, রাজউক—এ কটি প্রতিষ্ঠানকে এনসিসির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে হবে। নদীর সীমানা এবং নদীর জমি ও পানি সুরক্ষার জন্য বিআইডব্লিউটিএ; জলাবদ্ধতার ক্ষেত্রে পানি উন্নয়ন বোর্ড; শিল্পবর্জ্যের দূষণ নিয়ন্ত্রণে পরিবেশ ও শিল্প মন্ত্রণালয়, ড্যাপসহ অন্যান্য নানা নগর-পরিকল্পনা বিষয়ে রাজউককে এনসিসির অগ্রাধিকারকে সম্মান করতে হবে। এসব ব্যাপারে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের পরিপূর্ণ সহযোগিতা প্রয়োজন। শেষ পর্যন্ত যিনিই নির্বাচিত হোন, প্রশাসন নিরপেক্ষভাবে জনস্বার্থে প্রকৃত সেবকের ভূমিকা পালন করবে।

আশা করি, আগামী দিনের মেয়র ও কাউন্সিলররা একযোগে এ ছয় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে একটি সুন্দর বাসযোগ্য নগরী গড়ায় অবদান রাখবেন।

ড. তোফায়েল আহমেদ স্থানীয় সরকার ও শাসন বিশেষজ্ঞ

tofail101@gmail .com