নারীর মেধা ও শিক্ষা কাজে লাগছে কি?

৮ নভেম্বর প্রথম আলোর খবর, ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশে নারীর আয় বেশি। ক্রয়সক্ষমতা অনুসারে বাংলাদেশের নারীদের গড় আয় বছরে এখন ২ হাজার ৩৭৯ ডলার বা ১ লাখ ৯২ হাজার ৬৯৯ টাকা। তৈরি পোশাক খাতে বিপুলসংখ্যক নারীর কর্মসংস্থান বাংলাদেশের নারীদের আয়ের দিক থেকে এগিয়ে রেখেছে। এটা জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) ২০১৬ সালের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনের তথ্য।

 সত্যি, কী ভালোই না লাগল খবরটি পড়ে। গর্ববোধ করলাম পোশাককর্মী নারীদের জন্য। কিন্তু ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে আয়ের দিক দিয়ে এগিয়ে থাকলেও আসলে আমাদের দেশের কত শতাংশ নারী কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে পারেন, তার খবর কি আমরা রাখি? আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেও অনেক নারী কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করার সুযোগ পান না। দেশের অর্থনীতিতে তাঁরা কোনো অবদান রাখতে পারেন না।

তানজিলা রহমানের (ছদ্মনাম) জীবনের লক্ষ্য ছিল চিকিৎসক হবেন। সরকারি মেডিকেল কলেজে সুযোগ না পাওয়ায় ভর্তি হন একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে। আর সবাই জানেন বেসরকারি মেডিকেল কলেজে পড়া মানে বিশাল একটা খরচ। তাঁর বাবা-মা শত অসুবিধার মধ্যেও মেয়ের পড়ালেখার খরচ চালিয়ে যান। এরপর যথারীতি ডাক্তারি পাস করলেন। বেসরকারি একটি ক্লিনিকে চাকরি করতে করতেই বসতে হলো বিয়ের পিঁড়িতে। তারপর আর চাকরি করা হলো না তানজিলার। কারণ, তাঁর স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন চাননি তিনি চাকরি করেন।

অথচ কত–কী ভেবেছিলেন তানজিলা। বড় ডিগ্রি নিয়ে বড় ডাক্তার হবেন। মানুষের সেবা করবেন। সেসব স্বপ্ন অধরাই থেকে গেল তাঁর। এখন তানজিলা শুধুই একজন গৃহবধূ। বাচ্চার দেখাশোনা আর সংসার সামলানোই তাঁর একমাত্র কাজ। মেডিকেলের পড়াগুলো ইতিমধ্যেই ভুলতে শুরু করেছেন।

শুধু তানজিলা নন, বাংলাদেশের বহু শিক্ষিত মেয়ের জীবনে এমন ঘটনা ঘটছে। কষ্ট করে পড়ালেখা করার পরও তাঁদের পরিচয়, তাঁরা আজ শুধু গৃহবধূ। তাঁদের পড়াশোনা, মেধা তাঁদের নিজেদের এবং দেশের কোনো কাজেই লাগল না। কতজন নারীর ক্ষেত্রে এমনটি ঘটেছে, তার কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও চোখ বুজে বলে দেওয়া যায়, এই সংখ্যা অনেক। প্রতিবছর আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে যত মেয়ে পাস করেন, তাঁদের কতজন কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে পারেন?

হিসাব না করেও বলে দেওয়া যায়, অর্ধেকের কম মেয়ে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করেন। আর এর পেছনে রয়েছে নানাবিধ কারণ। এর মধ্যে পারিবারিক বাধা অন্যতম একটি কারণ। বাংলাদেশে বহু বাবা-মা ও শ্বশুর-শাশুড়ি আছেন, যাঁরা মনে করেন না যে বাড়ির মেয়েটির বা বউটির চাকরি করার প্রয়োজন আছে।

রূঢ় হলেও এ কথা সত্যি যে অনেক বাবা-মা মেয়েকে উচ্চশিক্ষিত বানান, যাতে তাঁর একটি ভালো বিয়ে হয়। অনেকে ছেলের জন্য উচ্চশিক্ষিত বউ আনেন শুধু সামাজিক মর্যাদা বাড়ানোর জন্য। অনেক স্বামীও চান না স্ত্রী চাকরি করুন। স্ত্রী চাকরি করলে তার দুই কাঁধে দুটি ডানা গজাবে। সেই ডানা দিয়ে সে স্বাধীনভাবে উড়বে। তাকে আর পায় কে? আমার তখন আর কোনো দামই থাকবে না—এমনটাই মনে করেন অনেক স্বামী। আসলে নারীকে তাঁরা দমিয়ে রাখতে চান।

আমার এক আত্মীয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে খুব ভালো একটি বিষয়ে প্রথম শ্রেণিতে স্নাতকোত্তর পাস করলেও স্বামীর বাধায় কখনো কোনো চাকরি করতে পারেননি। তাঁর স্বামী সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। সেই স্বামীর মন্তব্য হচ্ছে, ‘চাকরি করা মেয়েরা যৌনকর্মীর সমপর্যায়ের। ভালো মেয়েরা কখনো চাকরি করে না।’ এই যদি স্বামীদের মনোভাব হয়, তাহলে স্ত্রীরা ঘরের বাইরে গিয়ে কাজ করবেন কীভাবে?

এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের উক্তিটি, ‘উড়তে শেখার আগেই পিঞ্জরাবদ্ধ এই নারীদের ডানা কেটে দেওয়া হয় এবং তারপর সামাজিক রীতিনীতির জালে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখা হয় তাদের।…নারীর দাসত্বের প্রধান কারণ, পুরুষশাসিত সমাজ ধর্মের নাম করে নারীর দাসত্বকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ এবং অলৌকিক মহিমা দিয়েছে।’

সেই কোন ছোটবেলা থেকে শুরু হয় মানবশিশুর শিক্ষা গ্রহণের পর্ব। সাতসকালে ঘুম থেকে উঠে স্কুলে যাওয়া, পরীক্ষার আগে রাত জেগে পড়া, কোচিংয়ে ছোটা। কত কষ্টই না হয় তাদের। কত কাঁড়ি কাঁড়ি টাকাই না খরচ হয় বাবা-মায়ের। আর মেয়েদের ক্ষেত্রে এত সব কষ্টের ফলাফল হচ্ছে শূন্য। কোনো কাজেই লাগে না তাদের এত দিনের কষ্টার্জিত শিক্ষা। অনেক মেধাবী মেয়ে বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে বিদেশে পাড়ি জমান। তাঁদের অনেকে অবশ্য কাজ নেন। কিন্তু সে না হয় রেস্তোরাঁ বা দোকানে, যাকে আমরা বলি ‘অড জব’। সবাই জানেন, এসব কাজ করতে মেধা বা শিক্ষা কোনোটারই প্রয়োজন হয় না। খুব কম নারীই আছেন, যাঁরা বিদেশে গিয়ে নিজের শিক্ষা ও যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ পান বা করেন।

তবে নারীদের কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের পথে পরিবারই একমাত্র বাধা নয়। অনেক মেয়ে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করার পর নানা পরিস্থিতির কারণে চাকরি ছেড়ে দেন। কাজের অনুকূল পরিবেশ না থাকা, যথাযথ মূল্যায়ন না হওয়া এবং পুরুষ সহকর্মীদের যৌন হয়রানির কারণে অনেক নারী চাকরি ছেড়ে দেন। আমার এক আত্মীয় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। কিন্তু সেখানে তিনি সহকর্মী ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার যৌন হয়রানির শিকার হন। তাঁদের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে ছেড়ে দেন চাকরি। আর কখনো চাকরির চেষ্টা করেননি। এ ছাড়া কর্মস্থল দূরে হওয়া, যাতায়াতের সুব্যবস্থা না থাকা, গণপরিবহনে নিরাপত্তা না থাকা, অফিসে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র না থাকা ইত্যাদি কারণেও নারীরা চাকরি ছেড়ে দেন।

কিন্তু এমনটাই কি চলতে থাকবে? এ সমস্যার সমাধান কী? আমাদের দেশে নারীর অধিকার, নারীর শিক্ষা নিয়ে অনেক কথা হয়, সভা-সেমিনারে নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠা নিয়ে অনেক আলোচনা হয়। কিন্তু নারীর এ সমস্যাটা কখনোই কোনো গুরুত্ব পায়নি। এখন এ বিষয়ে ভাবার সময় হয়েছে। এ ক্ষেত্রে পরিবারকেই সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে। বাড়ির মেয়েটি বা বউটিকে চাকরি করতে বাধা দেওয়া যাবে না।

সারা বিশ্বের দিকে তাকালে দেখা যাবে নারীরা কিনা করছেন। আমাদের দেশেও উদাহরণের অভাব নেই। বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক নারী তাঁদের মেধা ও যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখেছেন। অনেক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে নারীরা রয়েছেন। এমন নয় যে তাঁরা তাঁদের সংসার-সন্তান জলাঞ্জলি দিয়ে এসব করছেন। পরিবারের সহযোগিতা পেলে নারীরা যেতে পারেন অনেক দূর।

তবে শুধু পরিবার নয়, শ্রমবাজারে নারীদের আসার পথ সুগম করতে এবং সেখানে তাঁদের ধরে রাখার জন্য সরকারকেও কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। কর্মজীবী নারীর আবাসন, যাতায়াতের সুব্যবস্থা, গণপরিবহনে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, সন্তান লালন-পালনের জন্য শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিনিয়োগ এবং নজর বাড়াতে হবে। তাহলে শুধু ভারত ও পাকিস্তানের নয়, আরও অনেক দেশের নারীদের চেয়ে বাংলাদেশের নারীদের আয় বেশি হবে।

রোকেয়া রহমান: সাংবাদিক।