চলতি বছরের উচ্চমাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফলে দেখা গেছে, ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা ভালো করেছে। মেয়েদের গড় পাসের হার ৭০.৪৩ শতাংশ। আর ছেলেদের পাসের হার ৬৮.৬১ শতাংশ। চলতি বছরের এসএসসি পরীক্ষায়ও ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা ভালো ফল করেছে। এবার পরীক্ষায় ১০ শিক্ষা বোর্ডে গড়ে পাসের হার ৮০ দশমিক ৩৫ শতাংশ। এর মধ্যে ছাত্র ৭৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ এবং ছাত্রী ৮০ দশমিক ৭৮ জন পাস করেছে। শুধু এই বছরই নয়, কয়েক বছর ধরেই দেখা যাচ্ছে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে ভালো ফল করেছে।
মেয়েদের এ সাফল্যে আমি নারী হিসেবে গর্বিত। আমাদের দেশে যেখানে কিনা প্রায় সব ক্ষেত্রে মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে, সেখানে পড়ালেখার ক্ষেত্রে মেয়েদের এই এগিয়ে যাওয়া সত্যিই আনন্দের সংবাদ। অন্তত একটা দিকে তো মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে! সুযোগ পেলে যে মেয়েরাও তাদের মেধার স্বাক্ষর রাখতে পারে, তার প্রমাণ পরীক্ষায় তাদের এই ভালো ফল।
তবে আমাদের দেশে সার্বিকভাবে নারীর অবস্থান যে খুব একটা ভালো নয়, তা তো মোটামুটি সবারই জানা। আমাদের দেশে এখনো নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। প্রায় সব ক্ষেত্রেই তারা পুরুষের তুলনায় পিছিয়ে আছে। যে দেশে নারী-পুরুষের সমতা নেই, সে দেশ কখনো এগিয়ে যেতে পারে না।
নারী-পুরুষের সমতার মানে হচ্ছে জীবনের সর্বক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অংশগ্রহণ থাকবে, সমান সুযোগ-সুবিধা থাকবে এবং সমান অধিকার ভোগ করবে। কিন্তু আমাদের দেশের নারীরা কি পুরুষের সমান অধিকার ভোগ করতে পারছে? সবখানেই পুরুষের আধিপত্য। কী ঘরে, কী বাইরে আমাদের দেশের নারীরা নানা বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। সংসারে তো বটেই বাইরেও সারা দিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেও ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন নারী শ্রমিকেরা। তাঁরা কখনো পুরুষের সমান মজুরি পান না।
সম্পদের ওপর বিশেষ করে ভূসম্পত্তির ওপর নারীর অধিকার ও নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি এখনো আমাদের দেশে গুরুত্ব পায়নি। অফিস-আদালতে উচ্চ পদগুলোর বেশির ভাগই পুরুষদের দখলে। উচ্চ পদে নারী দেখা গেলেও সেই সংখ্যা খুবই কম। সংসারে বা কর্মক্ষেত্রে নারীর কথার কোনো গুরুত্ব নেই। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নারী থাকেন না।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর করা এক জরিপে দেখা গেছে, শিল্পকারখানাগুলোতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গায় মেয়েরা ২০.০৩% এবং সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে রয়েছেন ১২.০৮%। নারী-পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলার ব্যাপারটি আমাদের দেশে একরকম অনুপস্থিত।
তবে অনেক ক্ষেত্রে নারীর পিছিয়ে থাকা হয়তো দোষের নয়, বরং গুণ হিসেবেই দেখা যেতে পারে। যেমন রাজনৈতিক সংঘাতে নারী নেই। মারামারি–লাঠালাঠিতে নারী নেই। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে নেই। ইদানীং অবশ্য নারী জঙ্গিদের কথা শোনা যায়। তবে এসব নারীর সবাই স্বেচ্ছায় জঙ্গি হয়েছে, তা নয়। স্বামীদের প্রভাবে অনেকেই ছুটছে এই পথে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে পুলিশ আজিমপুরের একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে তিন নারী জঙ্গিকে আটক করে। এঁদের সবার স্বামী ছিলেন জেএমবির জঙ্গি। চাঁদাবাজি–দখলবাজিতেও নারী নেই।
সমাজে কারও কারও পেশা হচ্ছে ছিনতাই করা। মানুষের টাকাপয়সা, মূল্যবান জিনিসপত্র ছিনতাই করে তারা জীবিকা নির্বাহ করে। এ ক্ষেত্রেও নারীরা পুরুষদের তুলনায় পিছিয়ে আছে। এ ছাড়া আরও বেশ কটি ক্ষেত্র রয়েছে, যেখানে নারীর অংশগ্রহণ নেই। যেমন নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনে নারীরা নেই। নদী দখল বা দূষণেও তাঁদের ভূমিকা খুব একটা চোখে পড়ে না। অবৈধভাবে পাহাড় বা টিলা কাটায় নারীরা নেই। অবৈধভাবে বনের গাছপালা কাটাতেও তাঁরা নেই। অন্যের জমিজমা দখল করতে নারীকে দেখা যায় না।
প্রশাসনে নারীরা অপেক্ষাকৃত কম দুর্নীতি বা অনিয়ম করেন। ২০১৫ সালে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বা বিভাগ ৯০ জন প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি কর্মচারীকে দুর্নীতি ও অনিয়মের জন্য শাস্তি দেয়। তাঁদের মধ্যে ৭৪ জনই পুরুষ। বাকি ১৬ জন নারী। শতকরা হিসাবে যা দাঁড়ায় যথাক্রমে ৮২ ও ১৮ শতাংশে।
এই যে এতগুলো ক্ষেত্রে নারী যে পুরুষের সমকক্ষ হতে পারেনি, তার জন্য এতটুকু আফসোস আমাদের হচ্ছে না। আমরা চাই না নারীরা সন্ত্রাসমূলক কর্মকাণ্ডে পুরুষের সমকক্ষ হোক। চাই না পুরুষের মতো ছিনতাই, রাহাজানি, ডাকাতিতে অংশ নিক। চাই না তাঁরা নদী-খাল দখল করুক। অন্যের জমি দখল করুক। চাই না নদী থেকে বালু তুলুক। চাই না তারাও পাহাড় কাটুক। তবে সব পুরুষই যে এসব কাজ করে তা নয়। কতিপয়ের অপকর্মের দায় নিতে হয় গোটা পুরুষ সমাজকেই।
পুরুষদের মধ্যে যঁারা সন্ত্রাসমূলক কর্মকাণ্ড, চাঁদাবাজি, বোমাবাজি, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, নদী দখল, পাহাড় কাটা ইত্যাদির সঙ্গে জড়িত, তাঁদের বলছি এসবই হলো মানবতার শত্রু ও উন্নতির পথে প্রতিবন্ধক। তাঁদের মেধা ও শ্রম ভালো কাজে লাগালে দেশটার আরও বেশি উন্নতি হতো। আসুন, আমরা একটি মানবিক সমাজ গড়ি, যেখানে দখলবাজি, জবরদস্তি ইত্যাদি থাকবে না এবং গড়ে উঠবে নারী–পুরুষের সমতা।
রোকেয়া রহমান: সাংবাদিক।