নারী স্বাস্থ্যের নীরব ঘাতক ধোয়াবিহীন তামাক

আমাদের দেশে ধোঁয়াবিহীন তামাকের যে বহুল ব্যবহার এবং শরীরের জন্য তা কতটা ক্ষতিকর সে বিষয়ে অনেকেরই অজানাছবি : প্রথম আলো

গ্রামবাংলায় অনেক আগে থেকেই অতিথি এলে বাড়িয়ে দেওয়া হয় পান। তারপর টুকটুকে রাঙা ঠোঁটে পান চিবোতে চিবোতে এগিয়ে চলে আলাপ–আলোচনা। এমনকি শহরেও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে খাবারের পর পান দেওয়া হয়। পানে সুপারির সঙ্গে থাকে সাদাপাতা, জর্দা। আর বলাই বাহুল্য, নারীরাই বেশি পানভক্ত। মুখে জ্বলা সিগারেট নিয়ে অনেক কড়াকড়ি আইন থাকলেও আপাতদৃষ্টিতে নিরীহ সাদাপাতা, গুল, জর্দা নিয়ে কথা বলার কেউ নেই। সিগারেট যে শরীরের জন্য ক্ষতিকর বিষয়টি এখন প্রায় সবার জানা। কিন্তু ধোঁয়াবিহীন তামাক যেমন গুল, সাদাপাতা, জর্দার ক্ষতিও যে মারাত্মক সে ব্যাপারে প্রচার কোথায়? অথচ ধোঁয়াবিহীন তামাকে ক্ষতির শিকার হন বেশির ভাগ নারীরাই। গর্ভবতী হলে সেই ক্ষতি বর্তায় গর্ভস্থ ভ্রূণেও।

সিগারেটের ক্ষতির সঙ্গে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত হলেও ধোঁয়াবিহীন তামাকের ক্ষতির সঙ্গে আমাদের পরিচিতি অনেক কম। আপাতদৃষ্টিতে যা ধোঁয়া সৃষ্টি করে না তা–ই ধোঁয়াবিহীন তামাক। অর্থাৎ গুল, জর্দা, সাদাপাতা, চুরুট ইত্যাদি। ধোঁয়াযুক্ত তামাকের তুলনায় এর ব্যবহারকারীর সংখ্যা যেমন বেশি, তেমনি ক্ষতির মাত্রাও অনেক বেশি।

এরই মধ্যে ২০৪০ সাল থেকে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত দেশ করার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। তামাকের যে স্বাস্থ্যঝুঁকি, মূলত সেই প্রেক্ষাপটের কথা চিন্তা করে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আর তামাকের স্বাস্থ্যঝুঁকি বলতে আমাদের প্রথমেই সিগারেটের কথা মাথায় আসে। কিন্তু গুল, সাদাপাতা থেকে তৈরি হয় মারাত্মক স্বাস্থ্য জটিলতা। এমনকি হতে পারে মৃত্যু।

তামাকমুক্ত দেশ বলতে আমরা মূলত ধূমপানমুক্ত দেশকে বুঝি। কিন্তু আমাদের দেশে ধোঁয়াবিহীন তামাকের যে বহুল ব্যবহার এবং শরীরের জন্য তা কতটা ক্ষতিকর সে বিষয়ে অনেকেরই অজানা। এ জন্য দেশকে তামাকমুক্ত করতে হলে প্রথমে দরকার ধোঁয়াবিহীন দেশ গড়ার অঙ্গীকার গড়ে তোলা।

২০২১ সালের নভেম্বরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বিশ্বের ১৩০ কোটি মানুষ এখন তামাকজাত পণ্য ব্যবহার করেন। ২০১৫ সালে এ সংখ্যা ছিল ১৩২ কোটি। ২০২০ সালে বিশ্বের জনসংখ্যার ২২ দশমিক ৩ শতাংশ তামাকজাত পণ্য ব্যবহার করেছে। এর মধ্যে ৭ দশমিক ৮ শতাংশ নারী। ২০২০ সালে তামাক সেবনকারী নারীর সংখ্যা ছিল ২৩ কোটি ১০ লাখ। এর মধ্যে ৫৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী নারীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। শুধু তামাক ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারের কারণে প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় ৮০ লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। তাঁদের মধ্যে প্রায় ১২ লাখ মানুষ সরাসরি ধূমপান না করেও তামাকজাত দ্রব্যের কারণে মারা যাচ্ছেন। এ প্রেক্ষাপটে ৩১ মে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস পালিত হচ্ছে।

তামাকবিরোধী নারী জোটের (তাবিনাজ) করা জরিপের তথ্যমতে, আমাদের দেশে ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারকারীদের মধ্যে হাজারে পুরুষের সংখ্যা ৬৩, যেখানে নারীর সংখ্যা ৩৭৯। এ তথ্য নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। ধোঁয়াবিহীন তামাক যেমন গুল, সাদাপাতায় দুই হাজারের মতো রাসায়নিক পদার্থ থাকে, যা জীবনঘাতী রোগ ডেকে আনে। মুখের ক্যানসার, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোকসহ অনেক জটিল রোগের জন্ম দেয় ধোঁয়াবিহীন এসব তামাক। এ ছাড়া গর্ভবতীদের গর্ভপাত, মায়ের মৃত্যুসহ সন্তান জন্ম দিতে জটিলতার জন্য দায়ী এসব তামাক।

প্রথমত নারীদের মধ্যে ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারের প্রবণতা বেশি। ধোঁয়াবিহীন তামাকের দামও অনেক কম এবং সহজেই হাতের নাগালে পাওয়া যায় বলে নারীদের মধ্যে বিশেষ করে গ্রামের দারিদ্র্য এবং শিক্ষা থেকে বঞ্চিত নারীরা এতে সবচেয়ে বেশি আসক্ত। যাঁরা ধোঁয়াবিহীন তামাক সেবন করেন, তাঁদের অনেকেই জানেন না এটা কতটা ক্ষতিকর বা এ থেকে শরীরের কী কী সমস্যা হতে পারে।

তামাকমুক্ত দেশ বলতে আমরা মূলত ধূমপানমুক্ত দেশকে বুঝি। কিন্তু আমাদের দেশে ধোঁয়াবিহীন তামাকের যে বহুল ব্যবহার এবং শরীরের জন্য তা কতটা ক্ষতিকর সে বিষয়ে অনেকেরই অজানা। এ জন্য দেশকে তামাকমুক্ত করতে হলে প্রথমে দরকার ধোঁয়াবিহীন দেশ গড়ার অঙ্গীকার গড়ে তোলা। এ নিয়ে নারীদের মধ্যে ব্যাপক আকারে সচেতনতা তৈরির জন্য বিভিন্ন টিভি চ্যানেল, সংবাদমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, বিলবোর্ড, ব্যানার, ফেস্টুন, হ্যান্ডবিলের মাধ্যমে সচেতনতার বার্তা প্রচার করা প্রয়োজন। যার কোনো উদ্যোগই আসলে নেই বললেই চলে।

আরও পড়ুন

গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকোর সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, দেশে ৩ কোটি ৭৮ লাখ তামাক ব্যবহারকারীর মধ্যে দুই কোটি ২০ লাখ মানুষ ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহার করে, যা শতকরা হিসেবে দাঁড়ায় ৫৮ ভাগ। আবার ধোঁয়াবিহীন তামাকের কারখানার দিকে যদি তাকাই তাহলে দেখা যাবে, দেশে তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা ২০ থেকে ৩০টি। অথচ প্রকৃত অর্থে এর সংখ্যা ১০ থেকে ১৫ হাজার। বাংলাদেশে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন ২০০৫ থাকলেও তা মেনে চলছে না অসাধু ব্যবসায়ীরা।

ধোঁয়াবিহীন তামাক দৃষ্টির আড়ালেই থেকে যাচ্ছে। নীরব ঘাতক হয়ে শেষ করছে অধিকাংশ নারীর জীবন। যার প্রভাব পড়ছে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপরও। ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত দেশ গড়ার লক্ষ্যে কাজ করার জন্য অবশ্যই ধোঁয়াবিহীন তামাকের দিকে নজর দেওয়াটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এতে নিশ্চিত করা যাবে নারীর সঙ্গে সঙ্গে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুরক্ষাও।

তানজিনা আকতারী ফিচার ও কলাম লেখক এবং সংবাদ পাঠক, বাংলাদেশ বেতার