নির্বাচনে আমরা পড়শিদের চেয়ে পিছিয়ে

.
.

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সম্পর্কে কোনো কিছু অনুকরণ করতে গিয়ে আমরা অনেক সময় ব্রিটেনের মতো উন্নত গণতান্ত্রিক দেশের দিকে নজর দিই। সেখান থেকে কিছু আহরণের চেষ্টা করি। সাধারণত আমরা আমাদের মতো যারা গণতন্ত্রে অনগ্রসর, তাদের দিকে তাকাই না।
রোববার প্রথম আলোয় সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আবু হেনার নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন–বিষয়ক ভাবনাচিন্তা পড়ে মনে হলো, আমরা আবার সেই আটপৌরে আলোচনায় অংশ নিতে যাচ্ছি। রাষ্ট্রের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা বা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কথা বাদ দিয়ে আমরা ইসিকে বিচ্ছিন্ন করব। এরপর আমরা সার্বিক শাসনব্যবস্থার গুণগত মান বিবেচনায় না নিয়ে নির্বাচনে রাতারাতি সুশাসন চাইব। আর সেই বিচ্ছিন্ন লক্ষ্য অর্জনে আমরা নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে সার্চ কমিটির মতো কিছু একটা গঠনের আওয়াজ তুলব। আমরা নতুন করে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ও সাহসী নির্বাচন কমিশন চাইব।
আমরা যেটা বলব না, অথচ যেটা সব থেকে বেশি বলা উচিত সেটা হলো, শুধু নির্বাচন কমিশন সফল নির্বাচন করে না, করতে পারে না। একটি ট্রেনের সবগুলো বগি সক্রিয় ও সচল থাকবে। নির্বাচনকালে চালকের আসন-সংবলিত সামনের বগিটা নির্বাচন কমিশনের মতো হবে। কিন্তু পানি, পয়োনিষ্কাশন, নিরাপত্তা, খাবার ইত্যাদি বগিগুলো যদি যার যেখানে থাকার কথা সেভাবে না থাকে, তাহলে সেই ট্রেনযাত্রা কী করে শুভ হতে পারে।
আমাদের পড়শিরা উন্নয়নে হয়তো আমাদের মতো না হতে পারে, কিন্তু গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনে সঠিক পথে পা ফেলছে, অন্তত সে জন্য তারা হানাহানিতে লিপ্ত, সেটা দৃশ্যমান নয়। প্রতিবেশী বা ঘরের কাছের যাদের গণতান্ত্রিক গ্রহণযোগ্যতা কমবেশি প্রশ্নবিদ্ধ, তারা যে পথে যাচ্ছে, আমরা সেদিকে যাচ্ছি না। অবাক হলাম এটা দেখে যে কারও সাতেপাঁচে না থাকা সুখ-শান্তির দেশ ভুটানও তার নতুন সংবিধানে নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকার করেছে। আর সেটা যে বাংলাদেশের বিলুপ্ত হওয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আদলেই, তাতে সন্দেহের অবকাশ কম।
অনেকে বলেন, ভারতের গণতন্ত্রের সঙ্গে আমাদের কোনো তুলনা চলে না। অবশ্য কারও সঙ্গেই কারও সেভাবে তুলনা চলে না। আবার কতগুলো মৌলিক বিষয় আছে, যেখানে সবার থেকে আলাদা হওয়ার দাবি করা হাস্যকর। আবু হেনাসহ যাঁরাই নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করেছেন, তাঁদের অভিজ্ঞতা আলাদা। এর সঙ্গে দলীয় সরকারের সিইসিদের নির্বাচন করার ভালো-মন্দের তুলনা চলে না। সুতরাং সরকারি পদ ও সাংবিধানিক পদে থাকার মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে কার্যত লাভ নেই। নির্দলীয় সরকারের সচিব ও সাংবিধানিক পদধারীর ভূমিকা পালনের মধ্যে তেমন কোনো তফাত আমরা অতীতে দেখিনি। শুধু সংবিধানের জোর খাটিয়ে দলীয় সরকারের অধীনে কোনো সাংবিধানিক পদধারী স্বাধীনভাবে ভূমিকা পালন করবেন, সেটা আশা করা সংগত কিন্তু বাস্তব নয়।
আবু হেনা যথার্থই মনে করেন, একদলীয় নির্বাচন কোনো নির্বাচন নয়। কিন্তু সে জন্য তিনি নিয়োগ প্রক্রিয়ার ‘স্বচ্ছতা’, বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনা এবং সার্চ কমিটি গঠনের সুপারিশ করেছেন। আমরা বর্তমান ইসি সার্চ কমিটি ও বঙ্গভবনে সংলাপ করেই পেয়েছি এবং সামনেও হয়তো পাব। কিন্তু পড়শিদের সঙ্গে তফাতটা কী দেখুন। তারা সবাই সংবিধানগতভাবে বিরোধী দলের নেতা ও ভিন্নমতের কণ্ঠস্বর ধারণ করার সাংবিধানিক ব্যবস্থা করেছে। আমরা তা পারিনি, করিনি। তাদের চেষ্টা চোখে পড়ে। আমাদেরটা পড়ে না।
ভুটান ২০০৮ সালে সংবিধানে অনধিক ৯০ দিনের জন্য রাজা কর্তৃক একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের বিধান করেছে। সংসদ ভেঙে দেওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে প্রধান বিচারপতি প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিযুক্ত হবেন। প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীরা পদত্যাগ করবেন। এরপরও তারা নির্বাচন কমিশনকে নিরপেক্ষ রাখতে রাজাকে সম্পূর্ণ ক্ষমতা দেয়নি। রাজা যে তালিকা থেকে সিইসি ও দুজন কমিশনার বেছে নেবেন, সেই তালিকা যৌথভাবে প্রস্তুত করবেন প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিচারপতি, স্পিকার, ন্যাশনাল কাউন্সিলের (সংসদের উচ্চকক্ষ) চেয়ারপারসন ও বিরোধীদলীয় নেতা।
আমরা ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে ইনক্লুসিভ নির্বাচনের কথা শুনেছিলাম। এখন নেপালের নতুন সংবিধানের ২৮৩ অনুচ্ছেদে একটি নতুন বিধানের উল্লেখ দেখে মুগ্ধ হলাম। এটি বলেছে, রাষ্ট্রের সাংবিধানিক সংস্থাগুলোতে (কনস্টিটিউশনাল বডিজ অ্যান্ড এজেন্সিজ) নিয়োগ দেওয়া হবে ইনক্লুসিভ নীতির ভিত্তিতে। সাংবিধানিক সংস্থাগুলোতে নিয়োগ দিতে গঠন করা হয়েছে কনস্টিটিউশনাল কাউন্সিল, এর চেয়ারপারসন প্রধানমন্ত্রী। আর সদস্যদের মধ্যে আছেন প্রধান বিচারপতি, সংসদের নিম্নকক্ষের স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার, উচ্চকক্ষের চেয়ারপারসন ও সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা।
মিয়ানমারও ২০০৮ সালে নতুন সংবিধান করেছে। নির্বাচন কমিশনকে একটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ক্ষমতা দিয়েছে। এটা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে আমাদের নির্বাচন কমিশন অনেক সময় আইনগত ও সংবিধানের ব্যাখ্যার প্রশ্নে সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধান্বিত থাকে। আদালত কী করবেন তা তাদের মাথায় রাখতে হয়। মিয়ানমারের সংবিধানের ৩২৫ ধারা বলেছে, নির্বাচন কমিশনের চেয়ারপারসন কোনো বিষয়ে ব্যাখ্যা, সিদ্ধান্ত বা মতামত সরাসরি কনস্টিটিউশনাল ট্রাইব্যুনালের কাছে চাইতে পারবেন। কোনো আসনে যেকোনো সময় কোনো পুনর্নির্বাচনের আবেদন জানাতে সংশ্লিষ্ট আসনের ভোটারদের ১ শতাংশ ইসির কাছে আবেদন করতে পারবে। সাংসদদের জবাবদিহি প্রশ্নে দীর্ঘদিন সেনাশাসিত দেশটি যা পারল, আমরা তা পারলাম না। এই দেশটির উন্নয়ন ও গণতান্ত্রিক মর্যাদার মান যদি দ্রুত আমাদের ছাড়িয়ে যায়, তাহলে অবাক হব না।
মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট একদিন হয়তো সু চি হবেন। কিন্তু এখনকার প্রেসিডেন্টকেও যা খুশি করার এখতিয়ার দেয়নি সংবিধান। এমনকি সংসদকেও নিয়মে বেঁধেছে। সাংবিধানিক সংস্থাগুলো থেকে ইসিকে বিচ্ছিন্ন করেনি তারাও। বলা হয়েছে, মন্ত্রী বা নির্বাচন কমিশনারের মতো পদে প্রেসিডেন্ট যাঁদের বাছাই করবেন, তিনি অনুমোদন পেতে তঁাদের নাম পার্লামেন্টে পেশ করবেন। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে একটি সামরিক ব্যবস্থার মধ্যেও যাতে কোনো ব্যক্তি বা সংস্থা একচেটিয়া কর্তৃত্ব খাটাতে না পারে। আর আমরা নানা অজুহাতে কার্যত কী করে চলছি? আমরা সম্ভবত একজন ব্যক্তিকে অনেক বেশি কাজ করতে বাধ্য করে চলছি। মিয়ানমারের সংবিধান বলছে,
সংসদ যদি প্রেসিডেন্টের মনোনীত কোনো ব্যক্তিকে নাকচ করতে চায়, তাহলে সংসদকে নির্দিষ্টভাবে দেখাতে হবে যে সংবিধানে বর্ণিত যোগ্যতা
নির্ধারণী বিধানগুলো সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি কীভাবে পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন?
শ্রীলঙ্কাতেও নির্বাচন কমিশনকে বিচার বিভাগ বা পিএসসির মতো অন্যান্য সাংবিধানিক সংস্থা থেকে আলাদা করা হয়নি। সব সাংবিধানিক সংস্থার কর্তাদের নিয়োগ দেন প্রেসিডেন্ট। তবে তা কনস্টিটিউশনাল কাউন্সিলের পরামর্শক্রমে। ৪১(ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সাংবিধানিক পরিষদ গঠন করা হয়। স্পিকারের নেতৃত্বাধীন এ কমিশনের সদস্যরা হলেন প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা, প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত একজন সাংসদ, প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতার বাছাই করা ব্যক্তিদের (দুজন সাংসদ) মধ্যে থেকে পাঁচজন। এখানে দেখার বিষয় যে শুধু দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দল ঐকমত্য হলেই গণতন্ত্রের শর্তের পূরণ হয় না, সেদিকেও সন্ত্রাস ও গৃহযুদ্ধে দীর্ণ এই দ্বীপরাষ্ট্র খেয়াল রেখেছে। আর সে কারণে দুই বড় দলের বাইরে সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী অন্যান্য দল বা গ্রুপের সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে একজন সদস্য নিযুক্ত হবেন। ৪১(ক) অনুচ্ছেদের ৪ দফা বলেছে, সাংবিধানিক পরিষদটি এমনভাবে গঠিত হতে হবে, যাতে বিভিন্ন পেশা ও সামাজিক বৈচিত্র্যসহ শ্রীলঙ্কান সমাজের বহুত্ববাদী চরিত্রের প্রতিফলন ঘটে।
শাবাশ শ্রীলঙ্কা। শাবাশ নেপাল। শাবাশ ভুটান। সংবিধানে তারা পদ্ধতিগতভাবে ক্ষমতাধর ব্যক্তিনির্ভরতা হ্রাস করছে। ইসিসহ সব গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক সংস্থার নিয়োগকে তারা একটি সাংবিধানিক পরিষদের আওতায় আনছে। এমনকি পাকিস্তানের সংবিধানেও এই বহুত্ববাদী চরিত্র বজায় রাখতে বিশেষ রক্ষাকবচ সৃষ্টি করা হয়েছে। ২১৩ অনুচ্ছেদের ২(ক) দফা বলেছে, প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতার পরামর্শক্রমে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের জন্য একটি সংসদীয় কমিটিতে শুনানি ও কনফারমেশনের জন্য তিনজনের নাম পাঠাবেন। এভাবে তারা ইসি পুনর্গঠন করছে এবং তা নিয়ে অচলাবস্থা দেখা যায়নি।
পড়শিদের বাইরেও একই প্রবণতা। এটা বৈশ্বিক প্রবণতা। ইদানীং আমরা শাসন বিষয়ে মালয়েশিয়ার সঙ্গে তুলনা করতে অভ্যস্ত হচ্ছি। বিশ্বের নির্বাচিত রাজতন্ত্রের দেশ মালয়েশিয়া। বর্তমান রাজা হলেন আবদুল হালিম। মালয়েশিয়ার সংবিধানের ১১৪ অনুচ্ছেদ বলেছে, রাজা কনফারেন্স অব রুলার্সদের সঙ্গে পরামর্শক্রমে সাত সদস্যের নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন। এখানে লক্ষণীয় হচ্ছে, রাজাকেও পাঁচ বছর মেয়াদে নির্বাচিত করে এই ‘কনফারেন্স অব রুলার্স’। আবার পিএসসি সদস্য নিয়োগে সংবিধান রাজাকে তাঁর নিজস্ব ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ দিয়েছে। এক হাতে দিয়েছে আবার অন্য হাতে সেখানে ভারসাম্য আনার চেষ্টা করেছে। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্য নিয়োগে মালয়েশিয়ার মতো কর্তৃত্ববাদী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র সতর্ক থেকেছে, রাজা যাতে স্বেচ্ছাচারী না হতে পারেন। সে জন্য বলা হয়েছে, রাজাকে প্রধানমন্ত্রীর ‘উপদেশ’ এবং কনফারেন্স অব রুলার্সদের ‘পরামর্শ’ বিবেচনা করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভীর একটি মন্তব্য প্রথম আলোয় দেখলাম। বাহাত্তরের সংবিধানের কিছু বিধানে তিনি ফিরবেন। আমরাও তাই চাই। কিন্তু সেসব আমাদের উল্লিখিত পড়শিদের মতো একটি নয়া গন্তব্যে নিয়ে যাবে না। আসুন, খোলামনে স্বীকার করি, বাহাত্তরের শ্রেষ্ঠ অর্জন যে সংবিধান, তার প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল থাকি, কোনো অহেতুক বিতর্ক না করি, তবে সেখানে যেসব সাংবিধানিক সংস্থার নিয়োগে অগ্রহণযোগ্য ব্যক্তিবাদের বীজ নিহিত, সেটা নীরবে স্বীকার করি। আর তাতে পরিবর্তন আনতে আমরা সরব হই।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
[email protected]