এ বছরের ১২ মে দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটক রাজ্যে বিধানসভার নির্বাচন হয়। তাতে বিজেপি ৩৬ শতাংশ ভোট পেয়ে ১০৪ আসন পায়। অথচ কংগ্রেস ৩৮ শতাংশ ভোটে পেয়েছে ৮০ আসন। মজার বিষয়, এর আগের নির্বাচনে কংগ্রেস ভোট পেয়েছিল ৩৬.৬ শতাংশ, আর আসন পেয়েছিল ১২২। এবার তার ভোট বেড়েছে প্রায় দেড় শতাংশ, কিন্তু আসন কমেছে ৪২টি।
নির্বাচন যদি হয় নাগরিকদের মতামতের ভিত্তিতে প্রতিনিধি বাছাইয়ের ব্যাপার, তাহলে ওপরের চিত্রে নিঃসন্দেহে গলদ আছে। ভারতকে অনেকে ‘বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ’ বলতে ইচ্ছুক। কিন্তু সেখানে শুধু রাজ্যে নয়, কেন্দ্রেও এ রকম ত্রুটি চোখে পড়ে।
সর্বশেষ লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি ৩১ শতাংশ ভোট পেয়ে সরকার গড়েছে। অনেকগুলো দল নিয়ে গঠিত তাদের জোট পেয়েছে মোট ৩৮.৫ শতাংশ ভোট। অর্থাৎ প্রায় ৬২ ভাগ ভোটার তাদের বিপক্ষে ছিলেন। কিন্তু তারা সদম্ভে ৫টি বছর কাটিয়ে দিয়েছে।
ভারতের প্রতিবেশী পাকিস্তানের সর্বশেষ নির্বাচনে ইমরান খানের পিটিআই ভোট পেয়েছে ৩২ শতাংশ। কিন্তু তারা আসনের ৪৩ ভাগ (১১৬টি) পেয়ে গেছে। প্রতিপক্ষ মুসলিম লিগ ও পিপিপি পিটিআইয়ের চেয়ে ৬ ভাগ বেশি ভোট পেলেও ৯টি আসন কম পেয়েছে। ইমরানের পক্ষে
জনজোয়ারের কথা প্রচার করা হয়েছে। কিন্তু কার্যত সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটার পিটিআইবিরোধীদের ভোট দিয়েছেন। প্রতি ১০ জন ভোটারের মধ্যে ৪ জনের
কম ইমরানের প্রার্থীদের পছন্দ করেছেন। প্রতি ৩ জনে ১ জনেরও কম। অর্থাৎ সরকার গঠনের ক্ষেত্রে দুই-তৃতীয়াংশ ভোটারের মতের কোনো প্রতিফলন নেই। অথচ বিশ্বে এই নির্বাচনের সুষ্ঠুতা নিয়ে কেউ তেমন প্রশ্ন তোলেনি।
নির্বাচন: বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা
বাংলাদেশ এ মুহূর্তে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের মতো অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দাবিতে সোচ্চার। অতীতের কম বিতর্কিত নির্বাচনগুলোর তথ্যে চোখ বোলালে দেখা যায়, ১৯৯১ সালের নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের ৩১ শতাংশ পেয়ে সরকার গড়েছিল বিএনপি। তারা আসন পেয়েছিল ১৪০টি। অথচ প্রায় ৩২ ভাগ ভোট পেয়ে আওয়ামী লীগ আসন পেয়েছিল ৮৮টি। এক দশক পর ২০০১ সালে বিএনপি ৪১ শতাংশ ভোট ও ১৯৩টি আসন পেয়েছিল। সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৪০ শতাংশ ভোট পেয়ে আসন পেয়েছিল মাত্র ৬২টি। অর্থাৎ এক নির্বাচনে বিএনপির চেয়ে বেশি ভোট পেয়েও আওয়ামী লীগ ৫২টি আসন কম পেয়েছিল। পরের নির্বাচনে তারা মাত্র ১ শতাংশ ভোট কম পেয়ে ১৩১টি আসন কম পেয়েছিল।
কিন্তু যদি ভোটের অনুপাতে আসন বণ্টিত হতো, তাহলে ১৯৯১ সালে বিএনপি আসন পেত ৯৩টি; আওয়ামী লীগ পেত ৯৬টি। আর ২০০১ সালে বিএনপি আসন পেত ১২৩টি, আওয়ামী লীগ পেত ১২০টি। যা ভোটারদের অভিমতের সঙ্গে অনেক মানানসই ও ভারসাম্যপূর্ণ হতো।
বর্তমান নির্বাচনী ব্যবস্থার ভারসাম্যহীনতা আরও প্রকট হয় এলাকাভিত্তিক নজর দিলে। দৈবচয়ন ভিত্তিতে একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া হলো। ১৯৯৬ সালের জাতীয় নির্বাচনে যশোরের ৬টি আসনে আওয়ামী লীগ ৩৭.১৭ শতাংশ ভোট পেয়ে ৬টি আসনেই বিজয়ী হয়। সেখানে বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী মিলিতভাবে ৬০ শতাংশ (২৮+১৫+১৭) ভোট পেয়েও কোনো আসন পায়নি। বর্তমান পদ্ধতির ভাষায় তারা ‘পরাজিত’! ফলে ওই সংসদে যশোরের ৬০ শতাংশ ভোটারের কোনো প্রতিনিধিত্ব ছিল না; সব প্রতিনিধি ছিল ৪০ শতাংশ ভোটারের। এ রকম হলে নির্বাচনে ‘বিজয়’ মানে বিশাল এক ‘বঞ্চনা’ কি না, সে প্রশ্ন অনুসন্ধানের দাবি রাখে।
এ রকম বঞ্চনা বর্তমান ব্যবস্থায় আরও নির্দয় হয়ে ওঠে ছোট দলগুলোর ক্ষেত্রে। দৈবচয়ন পদ্ধতিতে আরেকটি উদাহরণ। ২০০১ সালের নির্বাচনে জামায়াত ৪.২৯ শতাংশ ভোট পেয়ে ১৭টি আসন পায়; অথচ জাপা ৭.২৬ শতাংশ ভোট পেয়ে ১৪টি আসন পায়। ভোটারের পছন্দ অনুযায়ী আসন বণ্টিত হলে ওই নির্বাচনে জাপার আসন পাওয়া উচিত ছিল ২২টি। ২০০১ সালের নির্বাচনে আরেক ছোট দল সিপিবি ১ লাখ ১৯ হাজার ভোট পেয়েও কোনো আসন পায়নি। সিপিবি, জাসদ, বাসদ, গণফোরাম, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন নির্বাচনে ভোট যা পাচ্ছে, তার হিস্যায় আসন পাচ্ছে না। অথচ ভোটের আনুপাতিক হারে আসন দেওয়া হলে এ রকম দলগুলো প্রায় সবাই কিছু আসন পেত। তাতে জাতীয় সংসদ আরও বহুত্ববাদী ও জনপ্রতিনিধিত্বশীল হতো।
নির্বাচন সবার অভিমত সংসদে নেওয়ার জন্য। সেই দর্শনগত দিক বিকৃত করে এটাকে জয়-পরাজয়ের বিষয় করা হয়েছে। নির্বাচনী ব্যবস্থায় যে কাঠামোগত ত্রুটি আছে, তা নিয়ে বাংলাদেশে প্রধান দলগুলো কথা বলে না। শুধু জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা সম্প্রতি সজোরে নির্বাচনী ব্যবস্থায় তাদের ন্যায্য হিস্যা নিয়ে দাবি তুলেছে। কিন্তু সংখ্যাগুরুরা নিশ্চুপ।
সবার মতামত প্রতিনিধিত্ব দাবি করে
নির্বাচনী ব্যবস্থাকে অধিক প্রতিনিধিত্বশীল করতে আমাদের কাছাকাছি উদাহরণ হিসেবে নেপাল চমৎকার সংস্কার সাধন করেছে। সেখানে পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ ‘প্রতিনিধি সভা’র ২৭৫ সদস্যের মধ্যে ১৬৫ জনকে ১৬৫টি নির্বাচনী এলাকা থেকে বাংলাদেশের মতোই নির্বাচিত হতে হয়। একই সময় পুরো দেশকে একটি আসন ধরে দলগুলোর নামেও ভোট হয়। দলগুলোর ভোটের হিস্যা থেকে আনুপাতিক হারে প্রতিনিধি সভায় বাকি ১১০ জন নির্বাচিত হন। শেষোক্ত প্রার্থীরা নির্বাচিত হন দলগুলোর দেওয়া প্রার্থী তালিকা থেকে ভোটের অনুপাতে। এভাবেই গঠিত হয় ২৭৫ আসনের প্রতিনিধি সভা। প্রতিটি দলকে তাদের এক-তৃতীয়াংশ আসন নারী দ্বারা পূরণ করতে হয়।
অন্যদিকে ‘রাষ্ট্রসভা’ নামে পরিচিত পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষের ৫৯ আসনে প্রেসিডেন্ট ৩ জন মনোনয়ন দেন। বাকি ৫৬ জন আসেন ৭ প্রদেশ থেকে ৮ জন করে। প্রতি প্রদেশ তাদের ৮ জনের মধ্যে ৩ জন নারী, ১ জন করে দলিত ও প্রতিবন্ধীকেও রাষ্ট্রসভায় পাঠায়। এভাবে প্রতিনিধি সভা ও রাষ্ট্রসভা মিলে নেপাল তার প্রতিনিধি বাছাই ব্যবস্থাকে বহুভাবে প্রতিনিধিত্বশীল করেছে।
নির্বাচনী ব্যবস্থাকে প্রতিনিধিত্বশীল এবং জাতীয় প্রয়োজনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে বিভিন্ন দেশে হামেশা সংস্কার ঘটে চলেছে। বিশ্বের অনেক দেশে দল বা তাদের প্রতীক ঘিরে ভোট হচ্ছে। ভোটের আগে দলগুলো প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করে। ভোটের হিস্যা অনুযায়ী প্রার্থী তালিকা থেকে ওপর থেকে ক্রম অনুযায়ী সংসদে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ দেওয়া হয়।
এর সংশোধিত রূপ হিসেবে একই সঙ্গে দল ও আসনভিত্তিক ভোট হচ্ছে অনেক দেশে। যেমন নেপালে। শ্রীলঙ্কায়ও অনেকটা কাছাকাছি ব্যবস্থা। সেখানে ২২৫ আসনের পার্লামেন্টে ১৯৬ আসন পূরণ হয় ২২টি নির্দিষ্ট নির্বাচনী এলাকা থেকে। বাকি ২৯ আসন পূরণ হয় দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের হিস্যায় জাতীয় প্রার্থী তালিকা থেকে।
শ্রীলঙ্কার মডেলে প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় থাকে একাধিক সদস্য বাছাইয়ের সুযোগ। কোন এলাকায় কত সংসদ সদস্য থাকবেন, সেটা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। এটা ৪ থেকে ১৯ পর্যন্ত হয়। সেই নির্বাচনও হয় আনুপাতিক পদ্ধতিতে। সর্বোচ্চ প্রতিনিধিত্বের লক্ষ্যে শ্রীলঙ্কা জাতীয় নির্বাচনে দুই স্তরের আনুপাতিক ভোটের ব্যবস্থা করেছে।
প্রত্যেক নাগরিকের মতামত গুরুত্বপূর্ণ। এটা মানলে আইনসভায় প্রত্যেকের মতামতের প্রতিনিধিত্ব থাকাও জরুরি। আনুপাতিক পদ্ধতিতে সেটা সম্ভব। পদ্ধতি পাল্টালে নির্বাচনে নাগরিকদের সবাই ‘বিজয়ী’ হতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ায় নেপাল ও শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞতা তাই বলছে।
বাংলাদেশে অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় অনেক নাগরিক নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার চান। নির্বাচনী আগ্রহের চলতি জাতীয় মুহূর্তে সেই লক্ষ্যে সংলাপ শুরু করা যায়। কারণ, বর্তমান নির্বাচনী ব্যবস্থায় মৌলিক গলদ রয়েছে।
আলতাফ পারভেজ ,দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক