পদত্যাগের ‘সৌন্দর্য’ আমরা কেন উপভোগ করি না

সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদী স্লোগান
ছবি : প্রথম আলো

একটি প্রতিষ্ঠানে বা রাষ্ট্রে গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত একজন ব্যক্তি তাঁর দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে ব্যর্থ হলে তিনি পদত্যাগ করবেন কি না, তা নির্ভর করে সেই ব্যক্তির আত্মমর্যাদাবোধের ওপর। শিক্ষকশ্রেণির এই মর্যাদাবোধ বেশি—অন্তত বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে এ ধারণা এখন সেকেলে। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের দুর্নীতি বা স্বেচ্ছাচারিতা নিয়ে যেসব ঘটনা পত্রিকায় এসেছে, তাতে আমাদের মধ্যে এ প্রতীতিই জন্মায়। যে দায়িত্ব থাকে নির্ধারিত, তার বাইরে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। কিন্তু কর্তব্যের কোনো সীমানা থাকে না। প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মচারী বা ছাত্রও যদি বঞ্চিত বোধ করেন, প্রতিষ্ঠানের প্রধানের কোনো কাজকে অন্যায় ও অন্যায্য মনে করেন, প্রতিষ্ঠানের প্রধানকে সেখানে থামতে হবে। তাঁর কাজ বা আচরণ ব্যাখ্যা করতে হবে, অন্যায় হলে ক্ষমা চাইতে হবে, প্রতিকার করতে হবে। কর্মচারী বা ছাত্র সন্তুষ্ট না হওয়া পর্যন্ত তাঁকে স্থির দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। একে বলে গণতন্ত্রের চর্চা, সৌন্দর্যের চর্চা।

আত্মমর্যাদাবোধের সঙ্গে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের গভীর সম্পর্ক আছে। অর্থাৎ গণতন্ত্র শুধুই একটি রাজনৈতিক উপাদানমাত্র নয়; গণতন্ত্র একটি সংস্কৃতিও বটে। দীর্ঘকাল একটি রাষ্ট্রে গণতন্ত্র বিরাজ করলে সমাজে বসবাসরত মানুষের মধ্যে ধীরে ধীরে গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণ প্রকাশিত হতে থাকে। আর গণতন্ত্রহীন রাষ্ট্রে এই সংস্কৃতি ধীরে ধীরে তিরোহিত হতে থাকে। রাষ্ট্রে গণতন্ত্র না থাকলে সমাজে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে ওঠে না, প্রতিষ্ঠানে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বদলে দেখা দেয় স্বেচ্ছাচারিতা।

রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠন হিসেবে শিক্ষকদের সংগঠন এবং সেই সংগঠনের মধ্য থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্তাব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়া আর কোন কোনো দেশে আছে কি না, আমি জানি না। কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংসের যে প্রধান কারণ এটা, তা জানি।

দলীয় নিয়োগ পেয়ে তাঁরা হলগুলোর প্রভোস্ট নিয়োগ দেন নিজ দলের থেকে, নিজ দলের ছাত্রসংগঠনকে যা খুশি করার আশকারা দেন আর অন্য দলের ছাত্রদের সঙ্গে করেন বিমাতাসুলভ আচরণ। এই বৈষম্যের বীজ প্রবাহিত হবে এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে, যা শিক্ষার মূল যে উদ্দেশ্য—সংস্কৃতিমান তৈরি করা—ব্যর্থ হবে চিরতরে। শিক্ষিতরা গড়ে উঠবে এক একজন স্বার্থপর নাগরিক হিসেবে, যা শিক্ষার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য সমন্বিত জীবনচেতনার পরিপন্থী।

পদত্যাগ গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সমগ্র ইতিহাসে অসংখ্য পদত্যাগের ঘটনা আমরা জানি। উন্নত দেশগুলোয় যেখানে গণতন্ত্র পরিপক্ব, কোনো দলের নেতা নির্বাচনে হেরে গেলে পদত্যাগ করেন দলের মধ্যে তাঁর প্রতি কোনো অসন্তোষ না থাকলেও। এটা তিনি তাঁর আত্মমর্যাদাবোধের জায়গা থেকেই।

পদত্যাগ গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সমগ্র ইতিহাসে অসংখ্য পদত্যাগের ঘটনা আমরা জানি। উন্নত দেশগুলোয় যেখানে গণতন্ত্র পরিপক্ব, কোনো দলের নেতা নির্বাচনে হেরে গেলে পদত্যাগ করেন দলের মধ্যে তাঁর প্রতি কোনো অসন্তোষ না থাকলেও। এটা তিনি তাঁর আত্মমর্যাদাবোধের জায়গা থেকেই। ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাঁর প্রতিশ্রুতি ছিল তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) থাকা না–থাকা নিয়ে রেফারেনডাম দেবেন এবং তাঁর ও দলের অবস্থান ছিল ইইউয়ে থাকার পক্ষে। রেফারেনডামে হেরে যাওয়ার পর নির্বাচিত হওয়ার এক বছরের মাথায় প্রধানমন্ত্রী ও দলের নেতার পদ থেকে সরে দাঁড়ান ডেভিড ক্যামেরন।

পাশের দেশ ভারতেও রয়েছে পদত্যাগের নানা ঘটনার দীর্ঘ ইতিহাস। ১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধে ভারতের পরাজয়ের দায় নিয়ে তখনকার প্রতিরক্ষামন্ত্রী কৃষ্ণ মেনন পদত্যাগ করেছিলেন; যদিও জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের বিশ্বনেতা হিসেবে তাঁর উচ্চতা ছিল প্রায় নেহরুর সমান। পদত্যাগের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি দুটি বাক্য উচ্চারণ করেছিলেন, ‘মৃত কুকুরকে কেউ কখনো লাথি দেয় না’; ‘কার কতজন শত্রু আছে, সেই সংখ্যা দিয়ে ভালো মানুষকে চেনা যায়’। চন্দ্র শেখর সিং, ভিপি সিংহ নেতৃত্বাধীন জনতা দল ভেঙে কংগ্রেসের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করেছিলেন। এ ঘটনায় তিনি ব্যাপকভাবে নিন্দিত হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর কাজে রাজীব গান্ধীর নাক গলানোয় বিরক্ত হয়ে সমগ্র পৃথিবীকে চমকে দিয়ে তিনি পদত্যাগ করে বসেন। এটা ছিল তাঁর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার গ্লানি মোচনের চেষ্টা।

বাংলাদেশেও এমন ঘটনা যে একেবারে ঘটেনি, তা নয়; ১৯৮৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য মোহাম্মদ শামসুল হক স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের অন্যায় আদেশ না মেনে পদত্যাগ করেছিলেন। বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ছেলে সোহেল তাজ স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী পদে ইস্তফা দিয়েছিলেন আত্মমর্যাদার প্রশ্নেই।

আচার্য শব্দের অর্থ হলো প্রধান পুরোহিত। উপাচার্য হলেন দ্বিতীয় প্রধান পুরোহিত। হিন্দুশাস্ত্রমতে, ধর্মীয় ক্রিয়াকর্মের ভার থাকে এই দুজনের ওপর। শত শত ভক্তের মুক্তির ভার, স্বর্গলাভের গুরুভার এ দুজনের ওপর। অতএব এই শব্দ দুটোর মধ্যে নিহিত রয়েছে গভীর ভক্তির ভাব। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও হাজার হাজার শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবনের গুরুভার একজন উপাচার্যের ওপর। জীবনে তারা কী হতে পারবে, কত দূর যেতে পারবে, তা অনেকটাই নির্ভর করে উপাচার্যদের কার্যকলাপের ওপর। কিন্তু বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে উপাচার্যদের যে চিত্র আমরা দেখি, তাতে আমরা গভীর হতাশায় ডুবে যাই, শত শত শিক্ষার্থীর জীবন হতাশায় ডুবে যায়।

শিক্ষার্থীরা শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘উপাচার্য’ ফরিদ উদ্দিন আহমেদকে অবরুদ্ধ রেখেছে, দেয়ালে দেয়ালে ‘উপাচার্য নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি’ দিয়েছে—এসব কথা খুবই করুণ শোনায়, কিন্তু তার চেয়েও করুণ শোনায় ‘ছাত্ররা অনশন করছে। তারা অসুস্থ হয়ে পড়েছে’। অনেক প্রাক্তন শিক্ষার্থীও আন্দোলনে শামিল হয়েছে। এ থেকে বোঝা যায়, উপাচার্যের বিরুদ্ধে ছাত্রছাত্রীদের অভিযোগ অনেক আগে থেকেই। অভিযোগের সত্যাসত্য আমরা জানি না কিন্তু উত্থাপিত অভিযোগের তদন্ত হবে না কেন? দুই পক্ষেরই কথা শোনা হবে না কেন? উপাচার্য কি জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে ভুল করতে পারেন না, অন্যায় করতে পারেন না? ‘তদন্ত করা হবে’—শিক্ষামন্ত্রীর পক্ষ থেকে ঘোষণা এলেই শিক্ষার্থীদের ঘরে ফিরে পড়াশোনায় মন দিতে বলতে পারেন অভিভাবকেরা। আমরা প্রস্তাব করি, উপাচার্যকে ছুটিতে পাঠিয়ে, একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হোক। তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হলে স্বপদে ফিরিয়ে আনা হোক।

ছাত্ররা আন্দোলন করছে অন্যের উসকানিতে, অন্য দলের মদদে বা দেশের বাইরের শক্তির অর্থ-সাহায্যে—এসব কথা বলা বন্ধ করা দরকার। কারণ, এটা একটা নিম্ন সংস্কৃতির পরিচয় বহন করে। ছাত্ররা, এমনকি স্কুলের ছাত্ররাও আন্দোলন করেছে বিভিন্ন ইস্যুতে। কখনো গাড়িচালকদের স্বেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে, কখনো ট্রাফিক পুলিশের বিরুদ্ধে, শিক্ষায় ভ্যাট আরোপের বিরুদ্ধে, কখনো কোটার বিরুদ্ধে, কখনোবা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ফি বাড়ানোর প্রতিবাদে। এর মধ্যে কোনটা অযৌক্তিক? অন্যের উসকানিতে আন্দোলন করতে হবে কেন ছাত্রদের? তারা কি নিজেরা কিছু বোঝে না। অন্যের উসকানিতে আন্দোলন করছে—এ কথা বলার অর্থ হলো ছাত্রদের চরমভাবে অপমান করা।

উপাচার্যদের সংগঠন, শিক্ষক সমিতি, ফরিদ উদ্দিনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে কেন, আমার কাছে বোধগম্য নয়। তারা কি অভিযোগের তদন্ত চায় না? ছাত্রদের কথা শুনতে চায় না? ভুল করলে, অন্যায়-অবিচার করলে, তার বিচার কি তারা চায় না?

ড. এন এন তরুণ রাশিয়ার সাইবেরিয়ান ফেডারেল ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির ভিজিটিং প্রফেসর ও সাউথ এশিয়া জার্নালের এডিটর অ্যাট লার্জ। [email protected]