পরিচয়ের রাজনীতি আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে

সব কিছু পুড়ে শেষ। স্বজনকে ধরে কাঁদছেন ভুক্তভোগী এক নারী। সোমবার রংপুরের পীরগঞ্জের বড়করিমপুরে।
ছবি : প্রথম আলো

আমরা এমন এক সময়ে বাস করছি, যখন পরিচয়ের রাজনীতি সবকিছু ছাপিয়ে চিন্তাজগতে গেড়ে বসেছে। জাতীয়তাবাদ কিংবা ধর্ম, যে পরিচয়েই হোক, পরিচয়ের রাজনীতির অনিবার্য ফলাফল হচ্ছে মানুষে মানুষে বিভাজন সৃষ্টি। এ রাজনীতি শুধু অপর তৈরি করছে। শ্রেষ্ঠত্ববাদী মতাদর্শ ও ঘৃণাজাত অপরাধে এর চূড়ান্ত রূপ প্রকাশ পাচ্ছে। যে ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বিশ্বকে ঐক্য ও সংহতির পথ দেখানোর কথা, সেটাই এখন ঘৃণা ও বিভেদচর্চার প্রধান মঞ্চ হয়ে উঠেছে। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনের ক্যাপিটল হিল হোক, ভারতের আসাম হোক আর বাংলাদেশের কুমিল্লা, নোয়াখালী, পীরগঞ্জ হোক, এ প্রবণতার বাইরে এখন আর কোনো দেশ বা অঞ্চল নেই।

রাগ, ক্ষোভ, বিদ্বেষ, ঈর্ষা নেতিবাচক অনুভূতি। কিন্তু এসব অনুভূতি থেকে ঘৃণার পার্থক্য রয়েছে। ঘৃণা থেকে বর্বরতম সহিংসতার জন্ম নেয়। এ ধরনের ঘৃণা সমাজে কেন জন্ম নেয়, সে ব্যাখ্যা খুঁজে বের করা খুব জরুরি। কেননা, একবার ঘৃণার জন্ম নিলে তার স্থায়িত্ব সারা জীবনের। গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল মনে করতেন, সময়ের সঙ্গে রাগ ও ক্ষোভের উপশম হয়। কিন্তু ঘৃণা কখনো শেষ হয় না। রাগের সঙ্গী যন্ত্রণা, কিন্তু ঘৃণার নয়।

আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট জেসিকা হেন্ডারসন ডেনিয়েল সম্প্রতি ঘৃণাজাত অপরাধের উৎস ও প্রভাব নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। তাঁর মতে, ঘৃণাজাত অপরাধ মানুষের কুসংস্কারের সবচেয়ে চরমতম বহিঃপ্রকাশ। অন্যান্য অপরাধের তুলনায় ঘৃণাজাত অপরাধ ব্যক্তি কিংবা সম্প্রদায়ের ওপর ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলে। কেননা, মানুষ হিসেবে আমাদের পরিচয়ের যে গোড়ার পরিপ্রেক্ষিত, এটা সেখানে আঘাত করে।

সম্প্রতি ভারতের আসামে ঘৃণাজাত অপরাধের ভয়াবহ একটা ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। দারাং জেলায় কৃষকদের উচ্ছেদ করতে যাওয়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে মৃত কিংবা মুমূর্ষু এক ব্যক্তির শরীরের ওপর ক্রমাগত লাফিয়ে চলেছেন এক আলোকচিত্রী। এ ঘটনায় ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেমন প্রতিবাদের ঝড় ওঠে; আবার দায়ী আলোকচিত্রীকে ‘বীর’ আখ্যা দিয়ে অনেকে উল্লাস প্রকাশ করেছেন। অনেকে তাঁদের টুইটার হ্যান্ডেল ওই আলোকচিত্রীর নামে নামকরণ করেন। অনেকে আবার তাঁকে ভারতের বিকল্প প্রধানমন্ত্রী কিংবা উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন।

ঘৃণাজাত অপরাধ মানুষের কুসংস্কারের সবচেয়ে চরমতম বহিঃপ্রকাশ। অন্যান্য অপরাধের তুলনায় ঘৃণাজাত অপরাধ ব্যক্তি কিংবা সম্প্রদায়ের ওপর ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলে। কেননা, মানুষ হিসেবে আমাদের পরিচয়ের যে গোড়ার পরিপ্রেক্ষিত, এটা সেখানে আঘাত করে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভেদ ও ঘৃণা বন্ধ করতে না পারার অভিযোগ নতুন নয়। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত নিধনযজ্ঞের সময় রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানো পোস্টগুলোর বিরুদ্ধে প্রথম দিকে ব্যবস্থা নেয়নি ফেসবুক। শ্রীলঙ্কায় সহিংসতার সময় একই অভিযোগ ওঠে তাদের বিরুদ্ধে। পৃথিবীর প্রায় ৩৫০ কোটি মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করেন। ফেসবুকের আরেক প্রতিষ্ঠান হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করেন ২০০ কোটি মানুষ। এ কারণে কোনো ঘটনা ঘটা এবং তার পরবর্তী প্রতিক্রিয়া কী হবে, সেটা অনেকটা ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর অনেকটাই নির্ভর করছে। বিশ্বের বিপুলসংখ্যক মানুষের মনোজগতের নিয়ন্ত্রণ করছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম।

মূলধারার সংবাদমাধ্যম এসব ঘটনায় প্রায় ক্ষেত্রে নিজেদের করণীয় নিয়ে দ্বিধায় পড়ে অথবা নীরবতা পালন করে। সেই সুযোগে ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম গুজব ও মিথ্যা তথ্যে ভরে ওঠে। মানুষের পরিণতি কী, সেটার চেয়ে মুনাফাই প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে প্রধান বিবেচ্য। অ্যালগরিদম সেভাবেই তৈরি। এ কারণে সহিংসতা উসকে দেওয়ার জন্য যখন কেউ লাইভ করছে, সেই ভিডিও নিমেষে ভাইরাল হয়ে যাচ্ছে। অথচ কেউ যদি একই ঘটনায় শান্তি বজায় রাখার আহ্বান জানিয়ে পোস্ট দেয়, সে পোস্ট খুব বেশি মানুষের কাছে পৌঁছায় না।

এ মাসে ফেসবুকের সাবেক প্রোডাক্ট ম্যানেজার ফ্রান্সেস হাউজেন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট কমিটির কাছে দেওয়া সাক্ষ্যে অভিযোগ করেছেন, ‘ফেসবুক ও তাদের অ্যাপগুলো শিশুদের ক্ষতি করছে, বিভেদ বাড়াচ্ছে এবং গণতন্ত্রকে দুর্বল করে দিচ্ছে। ফেসবুক মুনাফার প্রশ্নে নিজেদের মোটেই বদলাতে ইচ্ছুক নয়, তা সেটা সমাজকে যতই ক্ষতি করুক না কেন। মানুষকে রক্ষার চেয়ে ফেসবুকের নজর ব্যবসার দিকে।’ এ বছরে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ফিলিপাইনের সাংবাদিক মারিয়া রেসা একই অভিযোগ করেছেন। তাঁর মতে, ঘৃণা ও ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ। এর মধ্য দিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমটি গণতন্ত্রের জন্য হুমকি তৈরি করছে।

বাংলাদেশে উৎসব এলে সহিংসতা হবে কি না, সে প্রশ্নে গত কয়েক বছর জনমনে আতঙ্ক তৈরি হচ্ছে। উৎসবকে কেন্দ্র করে সহিংসতা, হামলার ঘটনা ঘটছে। যারা উৎসবকে কেন্দ্র করে সহিংসতা তৈরি করছে, তারা অনেক সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা করেই সেটা করছে। কেননা, এর প্রভাব অনেক বেশি। উৎসবের মধ্যে যাঁরা এ ধরনের সহিংসতার শিকার হন, তাঁদের মধ্যে সম্প্রদায়গত ও জাতিগত আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তাবোধ তৈরি হচ্ছে। আবার অবিশ্বাস, অনাস্থাটা একবারে বহুগুণ বেড়ে যায়। উৎসবের আগে থেকে বাংলাদেশে একটা পক্ষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিতর্ক তৈরি করে। তারা অবশ্য সমাজের ওপরতলার বুদ্ধিবৃত্তিক অংশ। এ বিতর্ক যখন সমাজের নিচতলায় পৌঁছায়, তখন সেটা আর বিতর্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। বাস্তবে জীবনের সমস্ত না পাওয়া মানুষের কাছে এ বিতর্ক ঘৃণা জন্ম নেওয়ার জন্য যথেষ্ট। এ ঘৃণা কখনো কখনো অসহিষ্ণুতা ডেকে আনে। কখনো কখনো তা সহিংস রূপ নেয়। গত কয়েক বছর যে বিতর্ক সবচেয়ে বেশি সামনে এসেছে, সেটা হলো ধর্মীয় উৎসব কি সর্বজনীন উৎসব হতে পারে? ধর্মীয় উৎসবে রীতিগত যে বিষয়টা আছে, সেটা নিঃসন্দেহে সম্প্রদায়ের। কিন্তু আমরা যে সামাজিক-অর্থনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে বাস করি, সেখানে সর্বজনীনতার শর্তের বাইরে কেউ নেই, কিছু নেই।

আমেরিকা, ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঘৃণাজাত অপরাধ বিস্তারে সংঘবদ্ধ রাজনৈতিক শক্তি বড় ভূমিকা পালন করছে। আমাদের দেশে অবশ্য এ ধরনের সংঘবদ্ধ রাজনৈতিক শক্তি এখন নানা কারণেই তেমন প্রভাবশালী নয়। কিন্তু সমাজের বড় একটা অংশের ভেতরে শত বছরের পুরোনো সাম্প্রদায়িক ও জাতিগত ভেদ-বিভেদ রয়েছে। সেটাকে উসকে দিয়ে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা গত কয়েক বছরে বেশ কিছু ঘটেছে। রামু, নাসিরনগর, সুনামগঞ্জ, ভোলাসহ বিভিন্ন স্থানে ফেসবুকে ভুয়া খবর ছড়িয়ে একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছে। এসব ঘটনায় সাড়া দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা বরাবরই প্রশ্নবিদ্ধ। একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলেও অভিজ্ঞতা থেকে কিছুই শেখা হয় নি। এ কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যখন দৃশ্যপটে আসছে, তার আগেই সহিংসতা ও হামলার ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। ঘরবাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। সহিংসতাকারীদের হাতে মানুষ মারা যাচ্ছে। অরক্ষিত অবস্থায় হামলার শিকার হওয়ায় নিরাপত্তাহীনতার বোধ প্রবল হচ্ছে। আবার উন্মত্ততা ঠেকাতে প্রাণহানিও থামানো যাচ্ছে না ।

সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও হামলার একেকটা ঘটনা ঘৃণাজাত অপরাধের মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে। এ কারণে আমরা আরও সংকীর্ণ হয়ে, আরও ক্ষুদ্র হয়ে ঢুকে যাচ্ছি পরিচয়ের রাজনীতির বৃত্তে। এর যে ভয়ংকর পরিণতি, তা কেউ অনুধাবন করতে পারছি না।

গণমাধ্যমের খবর থেকে জানা যাচ্ছে, কুমিল্লায় মন্দিরে যারা হামলায় অংশ নিয়েছে, তারা অচেনা ও সংঘবদ্ধ। স্থানীয় হিন্দু-মুসলিম মিলিতভাবে তাদের ঠেকাতে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু হামলাকারীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় তারা পারেননি। প্রতিটি সহিংসতার পরই গণমাধ্যমের খবরে একই তথ্য বেরিয়ে আসে। কিন্তু বিস্ময়কর সত্য হচ্ছে, রামু থেকে শুরু করে কোনো ঘটনাতেই বের হচ্ছে না, হামলার নেপথ্যে কারা ভূমিকা পালন করছে? হামলাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিও হচ্ছে না। এ দায়িত্ব সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। আজকের তথ্যপ্রযুক্তির যুগে সেটা বের করা খুব যে কঠিন, তা–ও নয়। এর বদলে শুধু রাজনৈতিক বাগাড়ম্বর আর দোষারোপ হচ্ছে। কিন্তু একেকটা হামলা যাদের বুকে স্থায়ী ক্ষত তৈরি করছে, তাদের জন্য কোনো উপশম কোথাও নেই।

সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও হামলার একেকটা ঘটনা ঘৃণাজাত অপরাধের মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে। এ কারণে আমরা আরও সংকীর্ণ হয়ে, আরও ক্ষুদ্র হয়ে ঢুকে যাচ্ছি পরিচয়ের রাজনীতির বৃত্তে। এর যে ভয়ংকর পরিণতি, তা কেউ অনুধাবন করতে পারছি না। চলমান সাম্প্রদায়িক সহিংসতা সমাজে রাজনৈতিক ইসলামের চর্চা যেমন বাড়াবে আবার রাজনৈতিক হিন্দুত্ববাদও প্রকট হবে। পরিচয়ের রাজনীতি নিয়ে স্লাভোয় জিজেকের একটা মন্তব্য দিয়ে শেষের শুরুটা করা যাক। ‘হাউ টু বিগিন ফরম বিগেনিং’ নামের একটি লেখাতে স্লাভোয় জিজেক বলছেন, ‘আজকের দিনে সমস্ত ক্ষোভ–সংগ্রাম পরিচয়ের রাজনীতিতে টুকরা টুকরা হয়ে ভাগ হয়ে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কোন কোন মিলগুলো আমাদের এক করতে পারে, তা খুঁজে বের করা দরকার।’

সেটা করতে হলে সবার আগে মনে রাখা দরকার, হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, চাকমা, সাঁওতাল—যে–ই হোক না কেন, তারা রাষ্ট্রের সম অধিকারপ্রাপ্ত একেকজন নাগরিক। সমাজদেহে যে সাম্প্রদায়িক বিভেদ, হিংসার প্রবলতর অসুখ আছে, সেটাও স্বীকার করে নিতে হবে। আমরা কি সবাই মিলে আমাদের ভবিষ্যৎ নির্মাণ করব, নাকি বিভেদের কৃষ্ণগহ্বরে ঢুকে পড়তেই থাকব, সে সিদ্ধান্ত আমাদেরই নিতে হবে।

মনোজ দে প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক।