‘কিশোরী ও তার মায়ের প্রতি যে আচরণ করা হয়েছে, তা মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানায়’, একটি কিশোরীকে ধর্ষণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে এ কথাগুলো বলেন  বগুড়ার পুলিশ সুপার মো. আসাদুজ্জামান। ধর্ষণ করার পর ওই কিশোরী ও তার মাকে ভয়াবহভাবে নির্যাতন করে তাঁদের দুজনের মাথা ন্যাড়া করে দেওয়া হয়। আমরা কি ২০১৭ সালের বাংলাদেশে বাস করছি?

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য অনুযায়ী  ২০১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ১ হাজার ২৪৮টি মেয়েশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ২০১৭ সালের প্রথম ছয় মাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ২৯৪টি। এই ঘটনাগুলো দেশে ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির ভয়াবহতা তুলে ধরে। আমাদের দেশে শিশুরা, বিশেষ করে মেয়েরা খুবই অনিরাপদ জীবনযাপন করছে। বিষয়টি বোঝার জন্য শুধু ওই মায়েদের কথা ভাবুন, যাঁরা তাঁদের মেয়েদের সঙ্গে স্কুলে কিংবা কোচিং সেন্টারে যাচ্ছেন এবং ছুটি না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করছেন। নিরাপত্তার অভাব থেকেই তাঁরা এভাবে সময় ব্যয় করতে বাধ্য হচ্ছেন।

সম্প্রতি প্রেমের ডাকে সাড়া না দেওয়ায় কিংবা অন্য কোনো কারণে নির্মমভাবে মেয়েশিশুদের নির্যাতন কিংবা হত্যার বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। যৌন নির্যাতন মেয়েদের জীবনে দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের শিকার মেয়েরা মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা পর্যন্ত করেছে। নিরাপত্তা না থাকায় মা-বাবাদের কেউ কেউ মেয়েশিশুদের বাল্যবিবাহ দিতে চান। তাঁরা মনে করেন, এভাবে তাঁদের মেয়েদের হয়রানি বন্ধ হবে। এখন মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেটের মাধ্যমেও যৌন হয়রানি ঘটছে। প্রযুক্তি একদিকে শিক্ষা, বিনোদন ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করছে, অন্যদিকে কেউ কেউ সেই প্রযুক্তি নারী ও শিশু নির্যাতনে ব্যবহার করছে। এই রকম বিরূপ পরিস্থিতিতে মেয়েশিশুদের পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে বিকশিত হওয়া বাধাগ্রস্ত হতে বাধ্য। প্রশ্ন হলো, আমরা কি এমন পরিবেশ তৈরি করতে পারব, যেখানে মেয়েরা অবাধে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখবে এবং কোনো ধরনের সহিংসতার ভয়ভীতি ছাড়াই বেড়ে উঠে সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখতে পারবে?

নারী ও শিশুদের বিরুদ্ধে সহিংসতার ঘটনায় বিচারহীনতার সংস্কৃতি একটি বড় সমস্যা। পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০০১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ধর্ষণ ও অন্যান্য সহিংসতার শিকার ২২ হাজার ৩৮৬ জন নারী ও শিশু ১০টি সরকারি হাসপাতালের ওয়ান–স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার থেকে চিকিৎসা নিয়েছে। একই সময়ে ৫ হাজার ৩টি মামলা করা হয়েছে, যার বিপরীতে ৮২০টি মামলার রায় হয়েছে এবং মাত্র ১০১ জন অপরাধী শাস্তি পেয়েছে। তার মানে মাত্র ৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ ঘটনার বিচার হয়েছে এবং মাত্র শূন্য দশমিক ৪৫ অপরাধী শাস্তি পেয়েছে।

আমাদের বিচারব্যবস্থা নারী ও শিশুবান্ধব নয়। তাদের সঙ্গে মর্যাদাপূর্ণ আচরণ করা হয় না এবং পুরো প্রক্রিয়াটি এমন যে নির্যাতিত মেয়েদের আবারও মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। মামলা নিষ্পত্তিতে রয়েছে দীর্ঘসূত্রতা। তার ওপর সামাজিক অপবাদ ও মেয়েদের চরিত্র হননের প্রক্রিয়া চলতে থাকে। অপরাধীদের পক্ষে ক্ষমতাশালীদের দিক থেকে নির্যাতিত পরিবারের ওপর চাপ প্রয়োগ করা হয়। এই পরিস্থিতিতে অনেকের পক্ষে ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য লড়াই চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। নারী ও শিশু নির্যাতনসংক্রান্ত মামলাগুলোর বিচার দ্রুত করা উচিত এবং গণমাধ্যমে এই ধরনের মামলার ফলোআপ মামলা শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রচার করা দরকার।

মেয়েদের ক্ষমতায়ন করা এবং তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তোলা প্রয়োজন, যাতে তারা যৌন নির্যাতনের শিকার হলে আত্মহত্যা না করে এবং পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করার সাহস পায়। পাশাপাশি পুরুষ ও ছেলেশিশুদের নারীদের সঙ্গে শ্রদ্ধাপূর্ণ আচরণ করা শেখাতে হবে। এ কথা প্রমাণিত যে পুরুষদের সম্পৃক্ততা নারীদের প্রতি যৌন নির্যাতন ও জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে এবং তাদের মধ্যে কেউ কেউ সমাজে ‘চেঞ্জ এজেন্ট’ বা পরিবর্তনের পক্ষে দূত হিসেবে কাজ করতে পারেন। মা-বাবাদের এমনভাবে সন্তান লালনপালন করা উচিত, যাতে ছেলেমেয়েরা পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়।

নারী ও মেয়েশিশুদের প্রতি যেকোনো সহিংসতা ঘটলে তাদের সহযোগিতা করতে দ্রুত এগিয়ে যেতে হবে। সব ধরনের নির্যাতন সহ্য করা বন্ধ করতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হতে যাচ্ছে। এই সময়ে আমাদের মেয়েরা যদি নির্বিঘ্নে বিদ্যালয়ে যেতে না পারে, তাহলে অর্থনৈতিক উন্নতি নিয়ে আমাদের গর্ব ম্লান হয়ে যাবে। আমরা
যদি এসব বন্ধ করতে না পারি, তবে সেটা হবে আমাদের সম্মিলিত ব্যর্থতা। আমরা কি ব্যর্থ হব, নাকি মেয়েশিশু ও নারীদের প্রতি সহিংসতার অবসান ঘটাতে একটি দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করব—সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে।

লায়লা খন্দকার: পরিচালক, চাইল্ড রাইটস গভর্ন্যান্স ও চাইল্ড প্রোটেকশন, সেভ দ্য চিলড্রেন।