পরীমনির প্রত্যাবর্তন: নায়িকা বটে, পুতুল নই

জামিনে মুক্তি হয়ে পরীমনি
ছবি: প্রথম আলো

পরী হয়ে জেলে গিয়েছিলেন, রিমান্ড এখন বিজয়ের মণি হাতে মুক্ত হলেন। গ্ল্যাডিয়েটরদের লড়াইয়ের বেলায় কে কতটা মার খেল তা দিয়ে জয় ঠিক হয় না। ক্ষতবিক্ষত হয়েও ময়দানে যে শেষতক দাঁড়িয়ে থাকতে পারে, দর্শকেরা তাকেই করতালি দিয়ে অভিনন্দন জানায়। পরীমনি যখন শুভ্র বেশে, মাথায় সাদা পাগড়ি জড়িয়ে, সাদা গাড়িতে করে কেন্দ্রীয় কয়েদখানার ফটক দিয়ে বেরিয়ে এলেন, তখন তাঁকে বিজয়ী মনে হয়েছে। তিনি বিতর্কিত হয়েছেন, নিন্দিত হয়েছেন, শাস্তিভোগ করছেন। আবার মানুষের, বিশেষত নারীদের বিপুল ভালোবাসাও তাঁর দিকে ধাবিত হয়েছে। ২৭ দিন কারাভোগ ও তিন দফা রিমান্ড শেষে এই জামিনে মুক্তি আর কেউ না হোক, পরীমনি অবশ্যই উদ্‌যাপন করবেন।

‘তুমি আমাকে ভালোবাসো না, হে খেলারাম’
পরীমনির জীবন নিজেই এক সিনেমা। এই শরতে আকাশে সাদা মেঘ, জমিনে কাশফুল আর গণমাধ্যমজুড়ে শ্বেত কপোতের বেশে পরীমনি যে হাজির হলেন, তা-ও কিন্তু সিনেমাটিক। সমাজ তাঁর গায়ে কলঙ্ক দিয়েছে। অনেক ক্লেদ ও গ্লানির ভেতর দিয়ে তিনিও গিয়েছেন অথবা তাঁকে যেতে হয়েছে। সেসব পেছনে ফেলে তিনি নিরঙা সাদা বেশ গায়ে নিয়ে কী বোঝাতে চেয়েছেন যে তাঁর পুনর্জন্ম হলো? সাদা কবুতর শান্তির প্রতীক। পরীমনি হয়তো এখন শান্তি চান।

কিন্তু গেরিলা কায়দায় আরও তীব্র বার্তাও তিনি দিয়েছেন। এখন হয়তো তাঁর জনসমক্ষে কথা বলা বারণ। জেলগেটে ভক্তদের ভালোবাসার ডাকে তিনি শুধু হেসেছেন, হাত নেড়েছেন এবং সেই হাতের তালুতেই মেহেদির রঙে আঁকা ছিল এক বিদ্রোহী বার্তা। ইংরেজিতে লেখা ছিল: ডোন্ট লাভ মি বিচ। এটি একটি ইংরেজি গানের কথা। জ্যাজ শিল্পী রাসেল গানের একটি সুরের শিরোনাম ‘বিচ, ইউ ডোন্ট লাভ মি’। বিচ শব্দের অর্থ বাংলায় ঠিক আসে না। আক্ষরিক অর্থ ধরলে দুশ্চরিত্রা বলা যায়। কিন্তু মনে হয় না পরীমনি বলেছেন, ‘আমি দুশ্চরিত্রা, আমাকে ভালোবেস না।’ বরং তিনি হয়তো বিগক্লিট নামের ডিজে শিল্পীর র‌্যাপ গানের কথা মনে রেখেছেন। শিল্পী মেয়েটি সেখানে গানে গানে বলে,
তুমি আমাকে ভালোবাসো না হে ভোগী খেলারাম
আমি ভালোবাসি যখন তুমি মিথ্যা বলো
তুমি আমাকে ভালোবাসো না, হে খেলারাম
তুমি শুধু আমাকে ভোগই করতে চাও
দূর হও, দূর হও, জাহান্নামে যাও
আমি তোমার ফ্যান্টাসি শুধু
তুমি শুধু চাও আমার গরিমা
কিন্তু তুমি আমাকে ভালোবাসো না…
এই ভাষাটা ব্যক্তিগত। তবে পরীমনির হাতের লেখাটা সবার উদ্দেশে যেভাবে মেলে ধরা, তাতে মনে হয় তিনি গোটা সমাজকেই বলছেন, তোমরা আমাকে গালি দিয়েছ, কলঙ্কিত ভেবেছে, ‘আমি তোমাদের পরোয়া করি না।’ আমার যায় আসে না কিছু, আমি একাই চলতে সক্ষম: এই যে বার্তা, এখানেই পরীমনি তাঁর অতীত থেকে আলাদা হয়ে অন্য উচ্চতায় চলে যান। যেন বলেন, আমাকে যা-ই ভাব, যা-ই করো, আমি পরোয়া করি না। চমৎকার নারীবাদী স্লোগান হয়ে উঠতে পারে কথাটা। সামাজিক মাধ্যমে তুমুল প্রতিধ্বনিও তুলেছে স্লোগানটা।

শিল্পীর কতটা স্বাধীনতা দেব, ব্যক্তির গোপনীয়তা কতটা মানব
পরীমনির এই বিবৃতির বিরুদ্ধেও সংস্কার জেগে উঠবে, আবারও নিন্দা হবে। কিন্তু এটাও ভাবা দরকার যে গৃহবধূ কিংবা নেতা-নেত্রী অথবা একজন নারী শিক্ষকের কাছে যে আদর্শ জীবন ও পরিষ্কার নৈতিকতা আশা করা হয়, একজন কবি, শিল্পী, অভিনেত্রী, মডেল বা নায়িকার কাছে তা প্রত্যাশা করা মানে তাদের কাজ ও শিল্পমাধ্যমকে বুঝতে না পারা। স্বাধীনতা ছাড়া কেউ শিল্পী হতে পারে না, শেখানো বুলির তোতা পাখি হতে পারে বরং। নায়িকার চলনবলনের সঙ্গে সাধারণের চলনবলনের মিল আশা করা বৃথা। একজন সৈনিক যে শৃঙ্খলায় চলেন তা সাধারণ মানুষের জন্য কঠিন, তেমনি একজন শিল্পী যে জীবনযাপন করেন, করতে হয় বা করার দরকারও হয়, তা সমাজের গড়পড়তা রুচির শাসন দিয়ে বোঝা যাবে না। তার অর্থ এই নয় যে স্বেচ্ছাচারকে মেনে নেব।

ব্যক্তির স্বাধীনতা কোথায় শেষ আর কোথায় শুরু সামাজিক দায়িত্বের তা নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে আইনশাস্ত্র থেকে দর্শন অবধি। জাগরণের কালে, সেই সতেরো-আঠারো শতকে ইউরোপের আগুয়ান রাজনীতিকেরা, দার্শনিকেরা, শিল্পী-সাহিত্যিকেরা এবং ব্যবসায়ী ও শিল্প উদ্যোক্তারা বুঝতে পারছিলেন যে ব্যক্তির যদি কোনো স্বাধীনতাই না থাকে তাহলে সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্র এগোবে না। সবই যদি রাজা বা পুরোহিতেরা ঠিক করে দেবে, তখন ব্যবসায়ী ব্যবসা করতে পারবে না, কৃষক নতুন করে চাষের বন্দোবস্ত করতে পারবে না, নতুন আবিষ্কার হবে না, চিন্তা থেমে যাবে, জগৎ উন্নত হবে না।

বাংলাদেশে কায়েম হওয়া দুর্বৃত্ত খেলারামরা পরীমনিকে পুতুল ভেবেছিল। কারাগারের মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে আসার প্রথম প্রহরেই তিনি জানালেন, তিনি নারী বটে, নায়িকা বটে কিন্তু কারও হাতের পুতুল নন।

আরও আগে, বারো শতকের স্পেনের আন্দালুসিয়ার মুসলিম দার্শনিক-চিকিৎসক ইবনে রুশদ বুঝেছিলেন ব্যক্তির এই স্বাধীনতার ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তাঁর দুই শ বছর পরে তিউনিসিয়ার মুসলিম দার্শনিক ও সমাজবিজ্ঞানী ইবনে খালদুন জোর দেন ‘আসাবিয়া’ অর্থাৎ সমষ্টির প্রতি দায়বদ্ধতার ওপর। দুজনই কিন্তু ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যে টানাপোড়েন ও মিতালির সম্পর্ককে সমাজের জন্য স্বাস্থ্যকর বলেছিলেন। এর উত্তম এক মীমাংসা করেন জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট। সহজ ভাষায় তিনি ব্যক্তি স্বাধীনতাকেই আলোকায়ন বলেছেন। তবে সেই স্বাধীনতাকে লাগামহীন ভাবেননি। ব্যক্তি ঘরে বা প্রাইভেট স্তরে যা করবে, সামাজিক বা পাবলিক পরিসরে তা করবে না। রাষ্ট্রকে মান্য করে যা করবে, মনের ভেতর তা করবে না। আমরাও তো, বাজারে যে পোশাকে যাই, বেড়াতে গেলে তা পরি না। যেভাবে সড়কে চলি, সেভাবে ঘরের বারান্দায় হাঁটি না।

এত কথা বলার কারণ এই যে শিল্পী বা ব্যক্তির ব্যক্তিগত জীবন থাকবে। যতক্ষণ পর্যন্ত তা অন্য ব্যক্তি বা সমাজের স্বাধীনতাকে বাধা না দেয়, ততক্ষণ তা নিয়ে কারও কিছু বলার থাকতে পারে না। এটা যদি মানি, তবে পরীমনি বা অন্য কারও ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি না করে দেখা দরকার ব্যক্তি হিসেবে তিনি কারও অধিকার কাটছেন কি না এবং অন্য কেউ তাঁর ব্যক্তিগত অধিকারে বাধা হচ্ছে কি না। আইনের কাছে সোপর্দ হলেও তাঁর এই নাগরিক ব্যক্তিগত অধিকার ও সম্মান যেন খর্ব না হয়। তাঁর যে বিচার চলছে তা নৈতিকতার মামলাজাত নয়, তা আদালতের বিচার, নাগরিক হিসেবে সীমা লঙ্ঘন হয়েছে কি না, তার তদন্ত কর্তৃপক্ষ করবে, তাঁর জীবনযাপনের গোপনীয়তার অধিকার তাতে যেন লঙ্ঘিত না হয়। এটা পরীমনির বিষয় না, যেকোনো নাগরিকের অধিকার রক্ষার স্বার্থেই পরীমনির অধিকার বাঁচাতে হবে।

খেয়াল করুন উচ্চ আদালত পরীমনির জামিনের সময় কিন্তু নৈতিক প্রশ্ন আনেননি। আদালত দেখেছেন অন্যায় হয়েছে কি না। ন্যায়বিচারের জায়গা থেকে আদালত বলেছেন, ‘রিমান্ডের উপাদান ছাড়া তদন্ত কর্মকর্তা প্রার্থনা দিল, আপনি (ম্যাজিস্ট্রেট) তা মঞ্জুর করে দিলেন। এগুলো সভ্য সমাজে হতে পারে না।’ মাদক মামলায় পরীমনিকে রিমান্ডে পাঠানোর ক্ষেত্রে ‘ক্ষমতার অপব্যবহার’ করা হয়েছে বলে মনে করছেন হাইকোর্ট (ডয়চে ভেলে, বাংলা)

নায়িকা বটে কিন্তু পুতুল নই
পরীমনির হাতে লেখা ওই তিরস্কারের ভাষা হয়তো কোনো ব্যক্তিকে উদ্দেশ করে, একই সঙ্গে তাতে রয়েছে অমানবিক সমাজের প্রতি ধিক্কার। আরও গভীরে গেলে বোঝা যাবে যে দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠী বা ক্ষমতার দ্বন্দ্বের শিকার পরীমনি। তলার জগতের সেই বাস্তবতা না জেনে কেবল ব্যক্তিকে আমরা যেন খলনায়িকা না বানাই।

বাংলাদেশে কায়েম হওয়া দুর্বৃত্ত খেলারামরা পরীমনিকে পুতুল ভেবেছিল। কারাগারের মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে আসার প্রথম প্রহরেই তিনি জানালেন, তিনি নারী বটে, নায়িকা বটে কিন্তু কারও হাতের পুতুল নন। পরীমনির অদৃশ্য এক ডানা সত্যিই ছিল। মামলা-নিন্দা-নির্যাতনে সেই ডানাটা কাটা পড়েছে। গ্রিক উপকথার ইকারুসের মোমের ডানা ছিল। উড়তে গিয়ে সূর্যের তাপে সেই ডানা গলে গিয়েছিল। ইকারুস পতিত হয়েছিল মাটিতে এবং প্রাণ হারিয়েছিল। পরীমনির মোমের ডানাটা গলে গেছে ঠিকই। স্বপ্নের আকাশ থেকে তিনি মাটিতে নেমে এসেছেন। সেই মাটিতে সাদা পাগড়ি ও সাদা জামা পরে তিনি দেখা দিয়েছেন। তাঁর এই শ্বেত-সাবলীল ভঙ্গিমা যেন পুনর্জন্মের প্রতিশ্রুতি হয়। আমরা একজন প্রতিশ্রুতিশীল শিল্পীর সুষমাময় ভবিষ্যতের আশা রাখি। পাশাপাশি খেলারামদের খেলারও অবসান হোক।

ফারুক ওয়াসিফ লেখক ও সাংবাদিক। [email protected]