পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে বাংলাদেশ যখন ইস্যু

বাংলাদেশে সম্প্রতি হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপরে আক্রমণকে কেন্দ্র করে দুই জায়গায় সম্পূর্ণ ভিন্ন অবস্থান নিয়েছে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। দিল্লিতে ভারত সরকার বিষয়টি নিয়ে আনুষ্ঠানিক স্তরে এমন কোনো মন্তব্য করেনি, যা বাংলাদেশ সরকারকে বিব্রত করতে পারে। ছোটখাটো জমায়েত, হালকা বিবৃতি দিয়ে দল হিসেবে বিজেপি দিল্লিতে কাজ সেরেছে। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি এবং হিন্দুত্ববাদী সংগঠন বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি) মাঠে নেমেছে। পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন হিন্দু সংগঠনও বিবৃতি দিচ্ছে। ত্রিপুরায় উগ্র প্রচারের জেরে সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি ও ধর্মীয় স্থান আক্রান্ত হয়েছে। অর্থাৎ পূর্ব ভারতে বাংলাদেশ নিয়ে বিজেপির অবস্থান এবং ভারতের অন্যত্র অবস্থানের মধ্যে ফারাক রয়েছে। প্রথমে দেখা যাক পশ্চিমবঙ্গে কী ধরনের প্রচার বিজেপি চালিয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার বিবরণ ছবিসহ ধারাবাহিকভাবে দুই সপ্তাহ ধরে প্রচার করেছে। বিভিন্ন সূত্রে এসব তথ্য ও ছবি পশ্চিমবঙ্গে পৌঁছায়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়ায়। ভুয়া তথ্যও পরিবেশিত হয়েছে। এভাবে দাঙ্গার ‘ভাবমূর্তি’ নির্মাণের পর বিষয়টিকে একটি ইস্যু হিসেবে মানুষের কাছে নিয়ে যায় বিজেপি। তারা বিভিন্ন জেলায় পথসভা, গণসংযোগ, মিছিল করে। আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন পশ্চিমবঙ্গে বিরোধী দলনেতা বিজেপির শুভেন্দু অধিকারী এবং সদ্য নিযুক্ত রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার। শুভেন্দু অধিকারী বলেন, তাঁরা যে ভোট পেয়েছেন, তা সনাতনী হিন্দুরাই দিয়েছেন। ফলে ‘হিন্দুদের কাছে আমরা দায়বদ্ধ’। ভারত সরকারের পররাষ্ট্রনীতির তোয়াক্কা না করে তিনি এ-ও বলেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শক্ত হাতে পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে পারেননি। এ বক্তব্য বিজেপি বারবার তুলে ধরেছে।

শুভেন্দু কলকাতায় বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনে গিয়েও জানান, প্রয়োজনে তিনি ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে অবস্থান বিক্ষোভে বসবেন। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ও সরকারের সায় না থাকলে একটি রাজ্যের নেতা কীভাবে অন্য দেশের কূটনীতিকদের এসব কথা বলতে পারেন, শক্তি প্রদর্শন করতে পারেন, সেটি একটি প্রশ্ন। এটি দিল্লিতে করা যেত? এই প্রশ্ন ভারতের প্রচারমাধ্যম তোলেনি। এককথায়, সরকারি স্তরে বাংলাদেশের সঙ্গে সংঘাতের পথে ভারত সরকার যেমন হাঁটেনি, তেমনই পশ্চিমবঙ্গের বিজেপিকে হাঁটতে নিষেধও করেনি। এর কারণ অবশ্য রয়েছে।

বাংলাদেশকে ইস্যু করে পশ্চিমবঙ্গে রাজনীতি করার চেষ্টা এত খোলাখুলিভাবে সাম্প্রতিক কালে হয়নি। নির্বাচনের পর এই প্রবণতা স্তিমিত হয়ে গিয়েছিল, সাম্প্রতিক ঘটনা বাংলাদেশকে রাজ্যের রাজনীতিতে ফিরিয়ে এনেছে। বিজেপি সেই সুযোগ কাজেও লাগাচ্ছে।

বিধানসভা নির্বাচনে বিশ্রী পরাজয়ের পরে বিজেপির গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে এসে পড়েছে। দলের শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে তাঁদের ব্যক্তিগত জীবন ও চরিত্র থেকে রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি ইত্যাদি সবকিছু নিয়েই দলের জ্যেষ্ঠ নেতৃত্বের একটি অংশ নিয়মিত মুখ খুলছে। এ ছাড়া প্রথম সারির নেতারা নিয়মিত তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দিচ্ছেন। এসবের জেরে বিধানসভায় প্রথমবার ৭৭টি আসন পেয়েও ফলাফল প্রকাশের প্রায় ছয় মাস পরও বিজেপি এমন কোনো ইস্যু সামনে আনতে পারেনি, যা তৃণমূলকে বিপদে ফেলতে পারে। বিজেপির সভায় লোক নেই, কেন্দ্রীয় নেতারাও আর রাজ্যে আসেন না। দলের নেতা-কর্মীদের মনোবল ধরে রাখাই অতএব বড় চ্যালেঞ্জ।

এ অবস্থায় একটি জোরালো ইস্যু দরকার ছিল, যা বিজেপি পেয়ে গেল বাংলাদেশ থেকে। বাংলাদেশ পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে নানাভাবে ইস্যু হয়ে উঠেছিল। কখনো নাগরিক নথিভুক্তীকরণ, কখনো নাগরিকত্ব আইন সংশোধন বা অনুপ্রবেশের ইস্যু সামনে আনা হয়েছিল। নমশূদ্র সম্প্রদায়ের ধর্মীয় গোষ্ঠী মতুয়া সমাজের মন্দির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশে পরিদর্শনও করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্তুদের ভোট পেতে। পেয়েও ছিলেন। বাংলাদেশকে ইস্যু করে পশ্চিমবঙ্গে রাজনীতি করার চেষ্টা এত খোলাখুলিভাবে সাম্প্রতিক কালে হয়নি। নির্বাচনের পর এই প্রবণতা স্তিমিত হয়ে গিয়েছিল, সাম্প্রতিক ঘটনা বাংলাদেশকে রাজ্যের রাজনীতিতে ফিরিয়ে এনেছে। বিজেপি সেই সুযোগ কাজেও লাগাচ্ছে।

দ্বিতীয়ত পশ্চিমবঙ্গ হিন্দু বাঙালিদের শেষ ‘হোমল্যান্ড’ বা আশ্রয়স্থল, সেই জায়গায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্য হিন্দু বাঙালিরা সংখ্যালঘু হয়ে পড়বে, বিজেপির এই বক্তব্য দীর্ঘদিনের। বাংলাদেশের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে, সে দেশের সংখ্যালঘুদের সমস্যার সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যাগুরুদের নিরাপত্তাহীনতা সফলভাবে জুড়ে দিতে পেরেছে বিজেপি। গত দুই সপ্তাহে তারা বারবার বলেছে, আজ বাংলাদেশে যা হচ্ছে, ভবিষ্যতে সংখ্যাগুরুদের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গেও সেটাই হবে। কল্পনাপ্রসূত এই বক্তব্যের বিরোধিতা মাঠপর্যায়ে কোনো রাজনৈতিক দল করেনি হিন্দু ভোট হারানোর ভয়ে, নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকেও কোনো বড় প্রতিবাদ হয়নি।

অতএব এই ‘বাইনারি’র-বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপরে আক্রমণ হচ্ছে, ফলে পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুদের গর্জে উঠতে হবে এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের নাম নিয়ে তৃণমূলকে চাপে রাখতে হবে—বিরোধিতা পশ্চিমবঙ্গে বিশেষ দেখা যায়নি। ফলে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ টেনে পশ্চিমবঙ্গে হারানো জমি এমন একটা সময়ে কিছুটা ফিরে পেল বিজেপি, যখন রাজ্যের চারটি বিধানসভা আসনে উপনির্বাচন হতে চলেছে ৩০ অক্টোবর। এতে ভোটের হার বাড়ে কি না, সেটা দেখার।

তৃতীয়ত গত নির্বাচনে বিজেপির ভেতরে একটা বিতর্ক ছিল। উত্তর ভারতে যেমন সম্পূর্ণ সাম্প্রদায়িক লাইনেই বিজেপি নির্বাচনী প্রচার করে, তেমনটা পশ্চিমবঙ্গেও করা উচিত কি না, এ নিয়ে তাদের কোনো নির্দিষ্ট কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত ও নির্দেশ ছিল না। ফলে যেমন শুভেন্দুর মতো নেতারা বলেছেন তৃণমূল জিতলে পশ্চিমবঙ্গ পাকিস্তান হয়ে যাবে, তেমনই অন্যদিকে অনেক নেতা-নেত্রীই সাম্প্রদায়িক লাইনে প্রচার করার বিরোধীও ছিলেন।‌

নির্বাচনে হারার পর রাজনৈতিক দলে পুরোনো লাইন নিয়ে সবাই প্রশ্ন তোলেন। বিজেপির ভেতরের সমালোচকেরা পরিষ্কার বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গেও আসামের মতো ১০০ শতাংশ সাম্প্রদায়িক লাইনে প্রচার করা উচিত ছিল। আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা বরাবরই বলেছেন, তিনি বাঙালি মুসলমানের (মিয়া মুসলিম) ভোট চান না। এ কথাটি নির্বাচনের আগে পশ্চিমবঙ্গের কোনো বিজেপি নেতা সাহস করে বলতে পারেননি। বরং তাঁরা মুসলমান সমাজের মানুষকে বিজেপিতে নিয়ে এসেছেন। এতে মানুষ বিভ্রান্ত হয়েছেন বলে এখন মনে করা হচ্ছে।

পুরোপুরি হিন্দুদের পক্ষ নিয়েই আগামী দিনে পশ্চিমবঙ্গে রাজনীতি করবে বিজেপি। সেই রাজনীতি করতে গেলে বাংলাদেশকে জড়িয়ে করা লাভজনক। কারণ, সেখানে হিন্দুদের ওপরে আঘাতের বিষয়টিকে যদি পশ্চিমবঙ্গে বারবার প্রচার করা যায়, তবে তা মানুষের মনে দাগ কাটতে বাধ্য। এর কারণ দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস এবং ভারতে সাম্প্রতিক সময়ে হিন্দু-মুসলমানের তিক্ত রাজনৈতিক সম্পর্ক।

নতুন সভাপতি সুকান্ত মজুমদারও পরিষ্কার করে দিয়েছেন যে তিনিও নির্দিষ্টভাবে মুসলমান সমাজের ভোট চান না, পশ্চিমবঙ্গবাসীর ভোট চান। সেপ্টেম্বর মাসে তাঁর সংবর্ধনা সভায় মজুমদার খোলাখুলি বিশ্বশর্মার নীতির প্রশংসা করে বুঝিয়ে দিয়েছেন পুরোপুরি হিন্দুদের পক্ষ নিয়েই আগামী দিনে পশ্চিমবঙ্গে রাজনীতি করবে বিজেপি। সেই রাজনীতি করতে গেলে বাংলাদেশকে জড়িয়ে করা লাভজনক। কারণ, সেখানে হিন্দুদের ওপরে আঘাতের বিষয়টিকে যদি পশ্চিমবঙ্গে বারবার প্রচার করা যায়, তবে তা মানুষের মনে দাগ কাটতে বাধ্য। এর কারণ দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস এবং ভারতে সাম্প্রতিক সময়ে হিন্দু-মুসলমানের তিক্ত রাজনৈতিক সম্পর্ক।

হিন্দু-মুসলমানের সামাজিক সম্পর্ক অবশ্য পশ্চিমবঙ্গে এখনো খুব তিক্ত নয়। কিন্তু বিজেপি যেহেতু এখন পশ্চিমবঙ্গের প্রধান বিরোধী দল (তারা ৪০ শতাংশ ভোটও পেয়েছে), তাই তারা যদি ক্রমাগত বাংলাদেশের ঘটনা সামনে এনে পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে দূরত্ব বাড়াতে চায়, তবে তাদের সফল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আগামী দিনে অতএব পশ্চিমবঙ্গে মেরুকরণের রাজনীতি আরও গভীর হবে এবং এর অনেকটা জুড়ে থাকবে বাংলাদেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ওঠাপড়া। বাংলাদেশের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্য বিজেপির দুই শীর্ষ নেতা সুকান্ত মজুমদার ও শুভেন্দু অধিকারীর কথা থেকেও পরিষ্কার, তাঁরা মেরুকরণের রাজনীতির ওপরেই জোর দেবেন।

এখানে প্রশ্ন, ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হিন্দুত্ববাদী সামাজিক রাজনৈতিক উত্থানের দ্বিতীয় পর্বকে পশ্চিমবঙ্গে কীভাবে ঠেকাবেন। এর নির্দিষ্ট উত্তর এখনই পাওয়া না গেলেও এটা পরিষ্কার, মমতাও তাঁর নরম হিন্দুত্বের লাইন ছাড়বেন না। গত সপ্তাহেই অতীতে বামপন্থীদের দুর্গ বলে পরিচিত দক্ষিণ কলকাতার যাদবপুরে একটি বড়সড় ভারতমাতা মন্দিরের উদ্বোধন করেছে তৃণমূল। ভারতমাতা হিন্দুত্ববাদীদের প্রতীক। সেই প্রতীককে আঁকড়ে তৃণমূল বুঝিয়ে দিয়েছে নরম হিন্দুত্ববাদের রাজনীতি আপাতত চলবে। কিন্তু যেহেতু মুসলমান সম্প্রদায়ের বড় অংশের ভোট মমতা এখনো পাচ্ছেন, তাই তাঁকে আরও এক নতুন ও জটিল ফর্মুলার মধ্য দিয়ে গিয়ে একটি সাম্প্রদায়িক সাম্য বজায় রাখতে হবে। কাজটা সহজ হবে না মোটেই।

এ অবস্থায় লোকসভা নির্বাচনের আগে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি যে আরও বর্ণময় ও চিত্তাকর্ষক হয়ে উঠবে, তা বলাই বাহুল্য।

শুভজিৎ বাগচী প্রথম আলোর কলকাতা সংবাদদাতা