পাকিস্তানের অভাব কী?

মনে পড়ে স্কুলের দিনগুলোতে অবশ্যপাঠ্য একটি ছড়ার কথা, যে ছড়ার নামকরণ আমি ধার করেছি আমার আজকের এই কলামের শিরোনাম হিসেবে। ইনিয়ে-বিনিয়ে সেই ছড়ায় যে কথা বলার চেষ্টা করা হয়েছে তা হলো, পাকিস্তান হচ্ছে এমন এক দেশ, যে দেশের কোনো কিছুতেই কোনো রকম ঘাটতির লেশমাত্র নেই এবং পৃথিবীর সেরা দেশের স্বীকৃতি লাভ পাকিস্তানের জন্য কেবলই সময়ের ব্যাপার। প্রায় অর্ধশত বছর পর সেই ছড়ার লাইনগুলো স্মরণে আনার চেষ্টা করার প্রচেষ্টায় যে বাস্তব সত্যের মুখোমুখি আমাকে এখন হতে হচ্ছে তা হলো, ছড়ায় অনেক কিছুর উল্লেখ থাকা সত্ত্বেও যে একটি প্রসঙ্গ সেখানে ইচ্ছাকৃতভাবে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে তা হলো সততা। হ্যাঁ, পাকিস্তানের হয়তো সবকিছুই ছিল এবং এখনো সবকিছুই দেশটির হয়তো আছে। তবে যে একটি জিনিস উদ্ভট সেই সমাজে কখনোই ছিল না এবং এখনো নেই, তা হচ্ছে সেই সততা।

আমরা জানি, সততাবর্জিত কোনো সমাজ নিজেকে যতই আধুনিক কিংবা অগ্রসর দাবি করে থাকুক না কেন,
সেই দাবি আসলেই হচ্ছে শূন্য কলসিতে সজোরে আঘাত হানার মতোই বায়বীয়। অর্থাৎ, শব্দ সেখানে হয়তো ঠিকই তৈরি হচ্ছে, তবে সেই শব্দের সবটাই হচ্ছে ফাঁকা আর অর্থহীন। ঢাকার গুলশান হত্যাকাণ্ড নিয়ে টোকিওতে পাকিস্তানিদের সাম্প্রতিক তৎপরতা দেখে আমার আবারও মনে পড়ে গেছে পুরোনো সেই ছড়ার কথা আর সেই সঙ্গে এত কিছুর পরও যে দেশটার মন-মানসিকতায় বিন্দুমাত্র পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না, দুঃখজনক সেই বাস্তবতার কথাও।

বাংলাদেশে সাত জাপানি হত্যার ঘটনায় টোকিওতে শোকসভার আয়োজন করে পাকিস্তান নিজের জাপানপ্রীতি তুলে ধরার যে প্রয়াস নিয়েছে তাকে আর যা-ই বলা হোক, নিহত ব্যক্তিদের আন্তরিক শোক প্রকাশ হিসেবে বিবেচনা করা যাচ্ছে না। এ মাসের শুরুর দিকে পাকিস্তানের কয়েকটি স্থানীয় সংগঠন টোকিওর জাতীয় প্রেসক্লাবের সেমিনার কক্ষ ভাড়া নিয়ে সে রকম এক শোকসভার আয়োজন করেছিল, যেখানে সাকল্য জনসমাগম হয়েছিল জনা কুড়ি, যার মধ্যে আমন্ত্রিত হাতে গোনা কয়েকজন জাপানি বক্তার বাইরে বাকি সবাই ছিলেন আবার পাকিস্তানি। বক্তাদের মধ্যে টোকিওর পাকিস্তানি দূতাবাসের ঊর্ধ্বতন একজন কূটনীতিকের উপস্থিতি এই সন্দেহকে জোরদার করে যে অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করার পেছনে আর্থিক যে খরচাপাতি জড়িত ছিল, তার সবটাই এসেছে টোকিওর পাকিস্তান দূতাবাস থেকে।

ফলে যে প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবে দেখা দেয় তা হলো, টোকিওর পাকিস্তান দূতাবাসের ঢাকার ঘটনা নিয়ে কেন এতটা উৎসাহী হয়ে ওঠা? বিশ্বের অন্য কোনো দেশে জাপানি নাগরিক নিহত হওয়া নিয়ে এর আগে কিন্তু পাকিস্তানিদের এতটা বিচলিত হয়ে পড়া একেবারেই লক্ষ করা যায়নি। অন্যদিকে বিশ্বের অন্য কোনো দেশের দূতাবাসও কিন্তু ঢাকার নৃশংস হত্যাকাণ্ড নিয়ে টোকিওতে শোকসভার আয়োজন করেনি, এমনকি ইতালির দূতাবাসও নয়। যদিও আমরা জানি, গুলশান হত্যাকাণ্ডে নিহত ব্যক্তিদের তালিকায় ইতালির স্থান হচ্ছে সবচেয়ে ওপরে।

এ কথা আমাদের অনেকেরই জানা আছে যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অনেক বিষয়ে পাকিস্তানিদের জড়িত হয়ে পড়ার অভিযোগ নতুন কোনো অভিযোগ নয়। ঢাকার পাকিস্তান দূতাবাসের বেশ কয়েকজন কূটনীতিকের সাম্প্রতিক কিছু তৎপরতা থেকে এর পরিষ্কার প্রমাণ আমরা অনেক আগেই পেয়েছি। এর আগে ১০ ট্রাক অস্ত্রের ঘটনাসহ নানা ঘটনায় সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীর সম্পৃক্ততার অভিযোগও জোরালোভাবে উঠেছে। জঙ্গিদের অস্ত্র আর অর্থের সরবরাহ কোথা থেকে এসেছে তা খতিয়ে দেখার প্রক্রিয়ায় মনে হয়
আরও অনেক কিছু আমাদের সামনে পরিষ্কার হয়ে উঠবে।

সে রকম অবস্থায় ঢাকার ঘটনা নিয়ে টোকিওতে দূতাবাসের সহায়তায় পাকিস্তানিদের শোকসভার আয়োজন আরও স্পষ্টভাবে যা বলে দিচ্ছে তা হলো বাংলাদেশকে ঘটনার জন্য পুরোপুরি দায়ী করে নিজেকে ধোয়া তুলসীপাতা হিসেবে জাপানিদের সামনে তুলে ধরে জাপানের সহমর্মিতা আদায়ের চেষ্টা করে যাওয়ার মতো ফায়দা লুটে নেওয়ায় দেশটি এখন জড়িত। তবে জাপানি পক্ষ যে পাকিস্তানিদের মুখের কথায় বিশ্বাস করার মতো বোকা আদৌ নয়, পাকিস্তানের সেই অনুষ্ঠান নিয়ে জাপানের সংবাদমাধ্যমের সম্পূর্ণ নীরবতা আমাদের তা বলে দিচ্ছে। আবারও তাই শৈশবের সেই স্মৃতিচারণায় ফিরে গিয়ে বলতে হয়, পাকিস্তান নামের দেশটি এখনো যে রাজনৈতিক অবস্থান ও ধারা অব্যাহত রেখে চলেছে তার মধ্যে সততা ও আন্তরিকতা বলে কিছু নেই। এই দুটির অভাব তাদের রয়েই গেছে। অন্যের বিচ্যুতি ও সমস্যা থেকে ফায়দা লুটে নেওয়ার চেষ্টার মাধ্যমে যে আসলে নিজেকেই হেয় করা হয়, সেই বাস্তবতা বুঝে উঠতে দেশটি কবে সক্ষম হবে কে জানে! 

টোকিও, আগস্ট ২০১৬

মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক