পাকিস্তানে গণতন্ত্রের পুতুলনাচ ও ইমরানের বিদায়ঘণ্টা

ইমরান খান
ছবি: রয়টার্স

যেদিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করেন, সেদিনই রুশ সেনাবাহিনী ইউক্রেনে অভিযান চালায়। ঘটনাটি কাকতাল হলেও ইমরান খানকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। পাকিস্তানের মিত্র যুক্তরাষ্ট্র ওই ঘটনায় ক্ষুব্ধ। পাকিস্তানের বিরোধী রাজনীতিকদের দাবি, ইমরানের ভুল নীতি পাকিস্তানকে বন্ধুহীন করেছে। পাকিস্তানের ক্ষমতার পালাবদলে বরাবর সেনাবাহিনীর পাশাপাশি পৃথিবীর এক নম্বর পরাশক্তিটির নেপথ্যের ভূমিকাও কূটনৈতিক মহলে বেশ আলোচিত।

ইমরান খান গত বৃহস্পতিবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেছেন, বিদেশি শক্তি তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য বিরোধী দলের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। ইমরান বিদেশি শক্তিটির নাম উল্লেখ না করলেও আভাসে-ইঙ্গিতে যুক্তরাষ্ট্রের কথাই বলেছেন। পাকিস্তানের কূটনৈতিক মহলেও জোর জল্পনা যে ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা চলাকালে ইমরানের ক্রেমলিন দর্শন ওয়াশিংটন ভালোভাবে নেয়নি। কূটনৈতিক চ্যানেলে তারা এর প্রতিক্রিয়াও জানিয়েছে।

এর আগে গত রোববার ইসলামাবাদে এক সমাবেশে একটি চিঠি দেখিয়ে ইমরান খান বলেছেন, তাঁর বিরুদ্ধে বিদেশি ষড়যন্ত্রের এটাই প্রমাণ। জাতীয় পরিষদে বিরোধীদের আনা অনাস্থা প্রস্তাব এই বিদেশি ষড়যন্ত্রেরই অংশ। তাঁর এ অভিযোগের কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। জিও নিউজের প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে আনা অনাস্থা প্রস্তাবের সঙ্গে কোনো ধরনের সম্পৃক্ততার বিষয়টি জোরালোভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তারা বলছে, অনাস্থা প্রস্তাবের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা এবং প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে ‘হুমকি দিয়ে চিঠি লেখার’ বিষয়টি ভিত্তিহীন।

ইসলামাবাদের ওপর ওয়াশিংটনের ক্ষুব্ধ হওয়ার আরেকটি কারণ হলো, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ইউক্রেনে রুশ হামলার নিন্দা জানিয়ে যে প্রস্তাব পাস হয়েছিল, সেই ভোটাভুটিতেও পাকিস্তানের গরহাজির থাকা।

পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলো একে অপরকে ‘বিদেশি চর’ হিসেবে চিহ্নিত করতে অভ্যস্ত। অর্থাৎ যে আমার সঙ্গে নেই, সে-ই শত্রু। বিরোধীদের অভিযোগ, ইমরান সরকার কাশ্মীর ইস্যুতে ভারতের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয়নি। এ কারণে কেউ কেউ তাদের ‘মোদির পুতুল’ বলেও গালমন্দ করে থাকেন। ক্ষমতাসীন পিটিআইএর অভিযোগ, পাকিস্তানে যে সরকারই স্বাধীন নীতি নিয়ে চলেছে, যুক্তরাষ্ট্র তাকে ‘শিক্ষা’ দেওয়ার চেষ্টা করেছে।

তবে পররাষ্ট্রনীতিই ইমরানের বিরুদ্ধে বিরোধীদের অনাস্থা প্রস্তাব নেওয়ার একমাত্র কারণ নয়। ইমরান ক্ষমতায় এসেছিলেন দুর্নীতি ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে ‘জিহাদ’ ঘোষণা করে। গত সাড়ে তিন বছরে এ ক্ষেত্রে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। ব্যক্তিগতভাবে ইমরানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ না থাকলেও তিনি পূর্বসূরিদের জুতোয় পা রেখেই দেশ শাসন করেছেন। বিরোধী দলকে অগ্রাহ্য করেছেন। জোটসঙ্গীদের উপেক্ষা করে এককভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারেও কোনো টেকসই পদক্ষেপ নিতে পারেননি।

পাকিস্তানে যতবার ক্ষমতার পরিবর্তন হয়েছে, সেনা নেতৃত্ব মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। এবারে কী হবে? ইমরান আস্থা ভোটে হেরে গেলে পাকিস্তানে যিনি নতুন প্রধানমন্ত্রী হবেন, তাঁকেও হয়তো সেনা নেতৃত্বের বিরাগভাজন হয়ে মসনদ ত্যাগ করতে হবে।

অন্যদিকে ২০১৮ সালে তাঁর ক্ষমতারোহনে যে সেনাবাহিনীর সহায়তা ও সমর্থন পেয়েছিলেন, তাদের সঙ্গেও সাম্প্রতিক কালে টানাপোড়েন চলছিল। পাকিস্তানে ‘রাষ্ট্রের ভেতরে রাষ্ট্র’ বলে পরিচিত আইএসআইয়ের প্রধান পদে ইমরান খান ফাইজ হামিদকে বহাল রাখতে চেয়েছিলেন। তাঁর ইচ্ছা ছিল, এই উচ্চাভিলাষী কর্মকর্তাই পাকিস্তানের পরবর্তী সেনাপ্রধান হবেন। কিন্তু বর্তমান সেনাপ্রধান কামার জাভেদ বাজওয়া রাজি হননি। পরে সেনাপ্রধানের মনোনীত নাদিম আঞ্জুমকেই আইএসআইয়ের প্রধান পদে নিয়োগ দিলেও সেনা নেতৃত্বের সঙ্গে চাপান-উতোর থেকেই যায়। পাকিস্তানের সেনা নেতৃত্ব কখনোই চায় না, রাজনৈতিক সরকার শক্তিশালী হোক। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে দিতে তারা কলকাঠি নেড়েছে। এবারের রাজনৈতিক ঝোড়ো হাওয়ার পেছনেও সেনাবাহিনীর নেপথ্য ভূমিকা আছে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ধারণা।

সাম্প্রতিক কালে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া, রুপির অবমূল্যায়ন হওয়া এবং বৈদেশিক সহায়তা কমে যাওয়ায় পাকিস্তানের অর্থনীতি বেশ ঝুঁকিতে আছে। সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ। বিরোধী দলগুলো এই সুযোগ কাজে লাগিয়েই ইমরান খানকে সরাতে একজোট হয়েছে। ৩৪২ আসনের পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে ইমরান খানের পিটিআইয়ের আসন ১৫৫। এমকিউএম, মুসলিম লীগ কিউসহ কয়েকটি দলের সহযোগিতায় ইমরান খান জোট সরকার গঠন করে। সে সময় দুই মেরুতে থাকা পিপিপি ও মুসলিম লীগ নেওয়াজ এখন ইমরানের বিরুদ্ধে এককাট্টা হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে গত বুধবার মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট-পাকিস্তান (এমকিউএম-পি) জোট সরকার থেকে বেরিয়ে এসে বিরোধীদের সঙ্গে হাত মেলায়। এমনকি ক্ষমতাসীন পিটিআইয়ের ডজনখানেক ক্ষুব্ধ সদস্যও যোগাযোগ রাখছেন বিরোধীদের সঙ্গে। নাটকীয় কিছু না ঘটলে অনাস্থা ভোটে ইমরানের হেরে যাওয়ার আশঙ্কাই বেশি।

এমকিউএম-পি জোট ছাড়ার ঘোষণার পর বুধবারই ইমরান খানের জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেওয়ার কথা ছিল। পাকিস্তানের অন্দরমহলের বরাত দিয়ে ভারতের এনডিটিভি বলেছে, সেনাবাহিনীর প্রধানের পরামর্শে তিনি সেদিন ভাষণ দেননি। বৃহস্পতিবার রাতে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেছেন, বিরোধীদের দাবি অনুযায়ী তিনি পদত্যাগ করবেন না। শেষ বল পর্যন্ত লড়ে যাবেন। উল্লেখ্য, সাবেক এই কৃতী ক্রিকেটার ১৯৯২ সালে পাকিস্তানের জন্য বিশ্বকাপ শিরোপা এনে দিয়েছিলেন।

আরও পড়ুন

ক্রিকেটার থেকে রাজনীতিক বনে যাওয়া ইমরান খান ২০১৮ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পান। ২০২৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত তাঁর সরকারের মেয়াদ রয়েছে। তবে অনাস্থা ভোটে হেরে গেলে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তাঁকে পদত্যাগ করতে হবে। বিরোধীদের তরফ থেকে কেউ প্রধানমন্ত্রী হবেন। বিরোধীদের সিদ্ধান্ত, অনাস্থা ভোটে ইমরান পরাজিত হলে মুসলিম লীগ নেওয়াজ গ্রুপের নেতা ও লন্ডনে নির্বাসিত সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের ভাই শাহবাজ শরিফ পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হবেন।

ইমরান খান এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, নেওয়াজকে লন্ডনে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া তাঁর সরকারের বড় ভুল ছিল। উন্নয়নশীল দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানেরা ভাবেন, বিরোধী দলের ওপর যত পীড়ন চালানো যাবে, সরকার তত শক্তিশালী হবে। এই ধারণা যে ভুল, তা পাকিস্তানে আবারও প্রমাণিত হলো। বৃহস্পতিবার জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেওয়ার আগে ইমরান খান জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির বৈঠক করেছেন। এই বৈঠকেও দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশিদের নাক গলানোর বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। এই উদ্বেগ আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া কিছুই নয়।

পাকিস্তানে এ পর্যন্ত কোনো প্রধানমন্ত্রী মেয়াদ পূরণ করতে পারেননি। প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ১৯৫১ সালে লাহোরে আততায়ীর হাতে নিহত হন। এরপর একের পর প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হয় সেনাবাহিনীর চাপে। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান সেনাশাসন জারি করেন, যা ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত বহাল ছিল। এরপর দৃশ্যপটে আসেন ইয়াহিয়া খান। তিনি অবিভক্ত পাকিস্তানে সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রথম ও শেষ নির্বাচন দিলেও সেই নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেননি। এরপর ৯ মাস স্থায়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। ১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বর ইয়াহিয়াকে সরিয়ে পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রথমে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৩ সালে নতুন সংবিধান রচনার পর প্রধানমন্ত্রী হন। ১৯৭৭ সালে সেনাপ্রধান জিয়াউল হক তাঁকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করেন। পরে এক হত্যা মামলায় ভুট্টোকে ফাঁসি দেওয়া হয়। ১৯৮৮ সালে রহস্যজনক বিমান হামলার ঘটনায় জিয়া নিহত হওয়ার পর বেনজির ভুট্টো ও নেওয়াজ শরিফ পালাক্রমে ক্ষমতায় এলেও কেউ পুরো মেয়াদ পার করতে পারেননি। ১৯৯৯ সালে নেওয়াজ শরিফকে হটিয়ে সেনাপ্রধান পারভেজ মোশাররফ ক্ষমতায় আসেন এবং ২০০৭ সাল পর্যন্ত বহাল ছিলেন। তার শাসনামলে বেনজির ও নেওয়াজ দুজনই বিদেশে নির্বাসিত জীবন যাপন করতে বাধ্য হন। পরে রাজনৈতিক সমঝোতার ভিত্তিতে বেনজির দেশে এসে এক নির্বাচনী সভায় যোগ দিতে গিয়ে জঙ্গিদের বোমা হামলায় নিহত হন। আবারও কয়েক বছর পিপিপি ও মুসলিম নেওয়াজ পালাক্রমে দেশ শাসন করে। কিন্তু কেউ মেয়াদ পূরণ করতে পারেনি।

ডন বৃহস্পতিবার সম্পাদকীয় কলামে ইমরান খানের বিদায় বার্তাই দিয়েছে। এতে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রীর বিদায় নেওয়াই মঙ্গল। এমকিউএম-পির সমর্থন প্রত্যাহারে জোট সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে। ইমরান খান রাজনৈতিকভাবে তাঁর পরবর্তী বিপর্যয় ঠেকাতে পারবেন, এটা মনে হয় না। রহস্যজনক বিদেশি চিঠি, যাকে তিনি মনে করেন, তাঁকে পুনর্বাসিত করবে, তার সম্ভাবনা কম।

পাকিস্তানে যতবার ক্ষমতার পরিবর্তন হয়েছে, সেনা নেতৃত্ব মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। এবারে কী হবে? ইমরান আস্থা ভোটে হেরে গেলে পাকিস্তানে যিনি নতুন প্রধানমন্ত্রী হবেন, তাঁকেও হয়তো সেনা নেতৃত্বের বিরাগভাজন হয়ে মসনদ ত্যাগ করতে হবে।

৭৫ বছর বয়সী পাকিস্তানের রাজনীতিতে যে গণতন্ত্রের পুতুলনাচ চলছে, তার সুতাটি এখনো সেনাবাহিনীর হাতে।

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি