বাংলাদেশের মানুষও জীবিত ও মৃত অবস্থায় খবর হয়, কিন্তু তাদের মনের কথা কওয়া বারণ। সরকারওঠিক করেছেন, দিনরাত জনগণের কথা বলা হবে, কিন্তু জনগণকে বলতে দেওয়া হবে না। জনগণ মিডিয়ায় এসে কথা বলে না, জনসভা ও জমায়েত ও চায়ের দোকান এবং কলিকালে ফেসবুকই তাদের কলরব করার স্থান। সেসব স্থানে বিরাজ করছে ভয়। পুলিশ ও মাস্তানের ভয় তো ছিলই, এখন এসেছে অধরা হাতের চাপাতির ভয়। এই দ্বিপদী ভয়ে সিটিয়ে থাকে জনপদ।
ভয়ের পরিবেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকার কথা নয়। এসব নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা তখনই থাকে, যখন মানুষের মত শোনার কান থাকে রাষ্ট্রযন্ত্রের—সরকারের। মতের মধ্যে চাওয়া থাকে, দাবিদাওয়া থাকে। মানুষের দাবিই যদি পাত্তা না পায়, তাহলে মত প্রকাশের স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে যায়। মত প্রকাশের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা যদি থাকেও, দাবি মানানোর অধিকার না থাকলে, মতামত হাওয়ায় উড়ে যায়। বিষয়টা এমন: তুমি বলতে পারো, কিন্তু আমরা শুনব না। যখন বলারই অধিকার নেই তখন দাবি মানানো তো দূর অস্ত।
গত এক বছরে কম প্রতিবাদ তো হয়নি। বিরোধী বিএনপি জোটের কথা নাহয় বাদই থাকল। সাধারণ মানুষ জাতীয় স্বার্থে কিংবা জীবন-জীবিকার ফরিয়াদ নিয়ে অনেক দাবি তুলেছে। সুন্দরবন বাঁচাতে অনেক প্রতিবাদ, লংমার্চ হলো রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরুদ্ধে। সরকার সেসব শুনলেন না। উল্টো দেখা গেল, দুই দফা সেখানে বিষাক্ত জ্বালানিবাহী জাহাজ ডুবল, প্রতি মাসেই বনে আগুন লাগল। গত মাসেই পাঁচ-ছয় দিন ধরে বনের ২০টি জায়গায় আগুন জ্বলেছে। সুন্দরবন কেবল কাঠ না, কিছু গাছ আর প্রাণীর বাসস্থান না, এটা বাংলাদেশের ফুসফুস। বিশ্বের মধ্যে সুন্দরবনের কোনো বিকল্প নেই, এটা ঝড়-প্লাবনের বিরুদ্ধে দক্ষিণাঞ্চলের প্রাকৃতিক রক্ষা দেয়াল, এখানকার জীববৈচিত্র্য ভবিষ্যতের জন্য অমূল্য উপাদান জিইয়ে রেখেছে ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু কোনো কথা বলেই এর গুরুত্ব বোঝানো গেল না।
কিন্তু মহাশয় সরকারের সব সয়। তঁারা মানুষের কথায় কান দেন না। আমাদের জাতীয় সংসদ ভবন ঘিরে দেয়াল তোলার বিরুদ্ধে কত প্রতিবাদ হলো। দেশ-বিদেশের সেরা সেরা স্থপতি, প্রকৌশলী, নগর পরিকল্পনাবিদ এবং শীর্ষ নাগরিকেরা অনেক যুক্তি দিলেন। কিছুদিন কাজ বন্ধ রাখার পর এ মাসেই তাড়াহুড়া করে গোটা এলাকাটাকে কোমরসমান উঁচু কংক্রিট এবং দেড় মানুষ সমান উঁচু লোহার গরাদ দিয়ে ঘিরে ফেলা হলো। বিশ্বের সুন্দরতম স্থাপনা লুই কানের নকশা করা আমাদের সাধের জাতীয় সংসদ। জার্মান রাইখস্ট্যাগ হাজার হাজার লোক দেখতে যায় প্রতিদিন। এত দিন আমরা আমাদের জাতীয় সংসদ ভবনকে দূর থেকে দেখেই সাধ মেটাতাম। যে ভোরের আলোর মতো পলি আর উজ্জ্বল দিনের মতো লাল মাটির রঙের এই জাতীয় সৌধের মধ্যে বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবিই আমরা দেখতাম। রোদের দিনে একে মনে হতো গর্বিত ও সংহত, মেঘলা আকাশের নিচে একে মনে হতো পবিত্র ও বিষণ্ন, ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে এর শান্ত স্থির দাঁড়িয়ে থাকায় ভরসা জাগত। তখন কেবল দূরত্ব ছিল, চোখের সামনে বিশ্রী কোনো দেয়াল ছিল না। কিন্তু সরকার মহাশয় কারও কথা না শুনে দেয়াল তুলে দিলেন। অচিরেই মেট্রোরেলও চলবে এর সুন্দর শোভন শক্তিকে মুষড়ে দিয়ে। কারও কোনো প্রতিবাদ, হাহাকার, দুঃখে কান পাতা হবে না।
বাঁশখালীর চারজন কৃষক প্রাণ দিলেন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রকে না বলতে। তাঁরা বললেন, পরিবেশসম্মত কারখানা করলে তাঁরা জমি দিয়ে গায়ে খেটে সাহায্য করবেন, তবু পরিবেশবিনাশী কয়লাকেন্দ্র হতে দেবেন না। সরকার আত্মদান দেখলেন না, দেখলেন কোম্পানির মুনাফার লোভ। বলা হচ্ছে, সেই বিদ্যুৎকেন্দ্র হবেই। বাঁশখালীতে চারজনের মৃত্যু হলো গুলিতে, তার বিচার হলো না। প্রতিবাদকারীরা এখন গ্রেপ্তার হতে শুরু করেছেন। পাথরে আঘাত করলেও শব্দ হয়, জনগণের চিৎকার কোনো প্রতিধ্বনি তোলে না ক্ষমতার দেয়ালে।
মোবাইলের বায়োমেট্রিক সিম রেজিস্ট্রেশন করানোর জন্য মরিয়া সরকার। মানুষ বলল, আঙুলের ছাপ নেবেন ভালো কথা, তাহলে এমন এক আইন করুন, যাতে করে জনগণের এই নাজুক সইনামার তথ্য সুরক্ষিত থাকে। প্রতিমন্ত্রী বললেন, যারা বিরোধিতা করছে তারা বিএনপি-জামায়াত। মানবাধিকার সংগঠক সুলতানা কামালকেও অবশেষে বলতে হলো, সরকার সমালোচনাকে দেখছে বিরোধিতা হিসেবে। ডাক ও টেলিযোগাযোগ–বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম যখন কথা বলেন, কাউকেই গ্রাহ্য করেন বলে মনে হয় না।
প্রশ্নপত্র ফাঁস ও সৃজনশীল পদ্ধতির সমস্যা শিক্ষাব্যবস্থাকে ভেতর থেকে শেষ করে দিচ্ছে। এ নিয়ে কোনো অভিযোগই শিক্ষামন্ত্রী শুনলেন না। তিনি ভাবতে থাকলেন, সবই ষড়যন্ত্র। আমরা দেখে আসছি, সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মরার প্রতিবাদের জবাব দেন নৌমন্ত্রী! কোনো কোনো মন্ত্রী সম্ভবত জনগণের দিকে তাকিয়ে মানুষ দেখেন না, অন্য কিছু দেখেন। ক্রসফায়ার ও গুম–খুনে মানুষ মরছে, চাপাতির কোপে শিক্ষক মরছেন, হিন্দু সমাজের ওপর জুলুম চলছে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন, ‘সব ঠিক আছে’! নিহত ব্যক্তিদের মা-বাবার কান্নাও বোধ করি তাঁরা শুনতে পান না। এ কেমন দেশ হলো আমাদের! বালুতে যত পানি ঢালা হোক, শুষে নেবে। চোরাবালি যতই খোঁড়া হোক, তলায় শুধুই চোরাবালি।
যাঁরা কানে কম শোনেন, তাঁদের অন্য ইন্দ্রিয় সবল হয়। কিন্তু যাঁরা সব ধরনের ক্ষমতার অধিকারী, মানুষের কথা শোনার ও বোঝার ক্ষমতাই যদি না থাকে, তাঁদের সবলতাটা আসলে কোথায়? তাঁদের জন্য একটা কৌতুক। এক ভদ্রলোকের স্ত্রী কানে কম শোনেন। তো, তাঁরা দুজন গাড়ি নিয়ে আরেক শহরে বেড়াতে গেছেন। উঠেছেন এক হোটেলে। রাতে ঘুমাচ্ছেন। এর মধ্যে স্ত্রীর চিৎকারে স্বামীর ঘুম ভাঙল। কী ব্যাপার? স্ত্রীর মাথায় প্রচণ্ড ব্যথা। ওষুধ আনতেই হবে। ভদ্রলোক কোনোভাবে বেরোলেন। কিন্তু ফেরার সময় মনে করতে পারলেন না, কত নম্বর কক্ষে তাঁরা উঠেছেন। কী আর করা। তিনি তাঁর গাড়ির দরজা খুলে একটানা হর্ন বাজানো শুরু করলেন। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সব ঘরের বাতি জ্বলে উঠল, একটি ছাড়া। তিনি বুঝে গেলেন, কোন ঘরে তাঁর স্ত্রী আছেন।
আমরাও চিৎকার করে যাচ্ছি, একজন ছাড়া সবাই শুনতে পাচ্ছেন। দেশের পাঞ্জেরি হলো সরকার, কিন্তু তঁার ঘুম যে আর ভাঙছে না!
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।