পাহাড়ে বন রক্ষা করুন

১৯৮৯, ২০০৩ ও ২০১৫ সালে ভূ-উপগ্রহ থেকে তোলা পার্বত্য চট্টগ্রামের চিত্র। এতে এই সময়ে বনভূমি ও কৃষিজমি বদলের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। গাঢ় সবুজ অংশ গভীর বনভূমি, হালকা সবুজ মাঝারি বন এবং হলুদ রং দিয়ে বনভূমি কৃষিজমিতে রূপান্তর বোঝানো হয়েছে। মানচিত্র: সিইজিআইএস ও ওয়াটারএইড
১৯৮৯, ২০০৩ ও ২০১৫ সালে ভূ-উপগ্রহ থেকে তোলা পার্বত্য চট্টগ্রামের চিত্র। এতে এই সময়ে বনভূমি ও কৃষিজমি বদলের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। গাঢ় সবুজ অংশ গভীর বনভূমি, হালকা সবুজ মাঝারি বন এবং হলুদ রং দিয়ে বনভূমি কৃষিজমিতে রূপান্তর বোঝানো হয়েছে। মানচিত্র: সিইজিআইএস ও ওয়াটারএইড

পার্বত্য চট্টগ্রামসহ পাঁচ জেলায় সাম্প্রতিক পাহাড়ধসের ঘটনা একাধারে মানবিক, রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনিক বিপর্যয়। পার্বত্য অঞ্চলের প্রতি রাষ্ট্রের নীতি ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এই দুর্যোগের ক্ষেত্র তৈরি করেছে। অথচ সরকার দুর্যোগ মোকাবিলা কিংবা পরবর্তী পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হয়েছে।

‘পাহাড়ধস: কেন, কী করণীয়’ শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনায় ভূতত্ত্ববিদ, নৃবিজ্ঞানী ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞরা এ অভিমত দেন। গতকাল রোববার সকালে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো নিজ কার্যালয়ে এই গোলটেবিল আলোচনার আয়োজন করে। বক্তারা পাহাড়ধসের মতো বিপর্যয়কর দুর্যোগ থেকে রক্ষা পেতে পাহাড়ের প্রাকৃতিক বন সংরক্ষণ এবং ভূতাত্ত্বিক জরিপ ছাড়া পার্বত্য অঞ্চলে কোনো অবকাঠামো তৈরি না করার আহ্বান জানান।

প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান গোলটেবিল বৈঠক সঞ্চালনা করেন।

ভূতাত্ত্বিক জরিপ অপরিহার্য

আলোচনায় অংশ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক হুমায়ুন আখতার বলেন, পাহাড়ধস একটি প্রাকৃতিক ঘটনা। তার ওপর এ দেশের পাহাড়গুলো পাললিক শিলা দিয়ে গঠিত। তবে মানুষের অপরিণামদর্শী ও অজ্ঞতাপ্রসূত কর্মকাণ্ড এখানে পাহাড়ধস ত্বরান্বিত করেছে। একটি সাধারণ প্রাকৃতিক ঘটনাকে মানবিক বিপর্যয়কর দুর্যোগে পরিণত হওয়ার ক্ষেত্র তৈরি করেছে।

পাহাড়ের কোন স্থানে ধসের আশঙ্কা বেশি এবং কেন বেশি, তার ভূতাত্ত্বিক কারণ ব্যাখ্যা করেন হুমায়ুন আখতার। তিনি বলেন, পার্বত্য অঞ্চলে উন্নয়ন যেমন অব্যাহত রাখতে হবে, তেমনি সেখানে যেকোনো অবকাঠামো তৈরির জন্য ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যগুলো বিবেচনায় রাখা জরুরি। এটা করা হলে প্রাকৃতিক নিয়মে পাহাড়ধস হলেও তা প্রাণহানি ঘটাবে না, মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনবে না।

সাবেক প্রধান বন সংরক্ষক ইউনুস আলী বলেন, ১৯৭৬ সাল থেকে পার্বত্য অঞ্চলের উন্নয়নে যে মডেল অনুসরণ করা হয়েছে, তাতে সেখানকার ভূতাত্ত্বিক ও প্রতিবেশগত (জিওলজিক্যাল অ্যান্ড ইকোলজিক্যাল) বিষয়গুলো উপেক্ষা করা হয়েছে।

প্রথম আলো আয়োজিত ‘পাহাড়ধস: কেন, কী করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে (বাঁ থেকে) ইউনুস আলী, ফিলিপ গাইন, প্রশান্ত ত্রিপুরা, হুমায়ুন আখতার, খায়রুল ইসলাম, গওহর নঈম ওয়ারা l ছবি: প্রথম আলো
প্রথম আলো আয়োজিত ‘পাহাড়ধস: কেন, কী করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে (বাঁ থেকে) ইউনুস আলী, ফিলিপ গাইন, প্রশান্ত ত্রিপুরা, হুমায়ুন আখতার, খায়রুল ইসলাম, গওহর নঈম ওয়ারা l ছবি: প্রথম আলো

দুর্যোগের ক্ষেত্র তৈরি করা হয়েছে

ইউনুস আলী বলেন, পাহাড় ও বনের সঙ্গে রাজনৈতিক অর্থনীতি যুক্ত হয়েছে। বাণিজ্য ও দুর্নীতি যুক্ত হয়েছে। সমতল এলাকার সঙ্গে পার্বত্য অঞ্চলের পার্থক্য ভুলে শস্য উৎপাদন বাড়ানোর জন্য প্রথাগত কৃষিব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা হয়েছে। এর পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে অনেক মানুষকে পার্বত্য অঞ্চলে নিয়ে বসবাসের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। অথচ তাদের পার্বত্য এলাকায় বসবাস ও জীবনযাপনের অভিজ্ঞতা ছিল না। তারা সমতলের জীবনধারার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বসবাসের ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চেয়েছে। এর সঙ্গে সঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকে শুরু করা হয়েছে অবকাঠামো তৈরির ব্যাপক কার্যক্রম। এসব মিলে পাহাড়ে বিপর্যয়কর দুর্যোগের ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। ফলে যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে, তাতে এখন পার্বত্য অঞ্চলের পুরো উন্নয়ন প্রক্রিয়া ঢেলে সাজাতে হবে।

নির্বিচারে বন নিধন

আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা ওয়াটারএইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর খায়রুল ইসলাম উপগ্রহ থেকে সংগৃহীত পার্বত্য চট্টগ্রামের বনাঞ্চল ধ্বংসের একটি চিত্র উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, নির্বিচারে প্রাকৃতিক বন নিধন করে, ভূমির ধরন পরিবর্তন করে বাগান তৈরি, অধিকসংখ্যক মানুষের পুনর্বাসন এবং অসময় ও অল্প সময়ে বেশি বৃষ্টিপাত পাহাড়কে নাজুক করে তুলেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ের পরিবেশ ও স্বাস্থ্য এতটাই খারাপ অবস্থায় পৌঁছেছে যে সেখানকার ঝরনাগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। এক যুগে ৬১ শতাংশ ঝরনা শুকিয়ে গেছে। যেটুকু বহমান আছে, তাতেও স্বচ্ছ পানির প্রবাহ নেই। প্রবাহিত হয় কাদাপানি। পাহাড়ের পরিবেশ যে মোটেই স্বাভাবিক নেই, এগুলো তার মোক্ষম নিদর্শন।

রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি বদলায়নি

বন-পাহাড় নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কর্মরত ফিলিপ গাইন পার্বত্য চট্টগ্রামের সামগ্রিক পরিস্থিতি বিপর্যয়কর বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, যেকোনো পাহাড়ি এলাকায় শহর বা জনবসতি গড়ে তোলা হয় উপত্যকায়। কিন্তু বর্তমান রাঙামাটি শহরটি গড়ে উঠেছে পাহাড়ের ওপর। পানিবিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির জন্য সৃষ্ট কাপ্তাই হ্রদ অগণিত পাহাড়ি মানুষকে উদ্বাস্তু হতে বাধ্য করেছিল, তাদের অন্য কোথাও যাওয়ার জায়গা ছিল না। কাপ্তাই হ্রদও পাহাড়িদের জীবনে এক বিপর্যয়।

ফিলিপ গাইন বলেন, পাহাড়-জঙ্গল কেটে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর স্থাপনা নির্মাণ, পুনর্বাসিত বাঙালিদের জন্য গুচ্ছগ্রাম স্থাপন, প্রাকৃতিক বন উজাড় করে রাবার ও ফলদ বাগান তৈরি, বাঁশ ধ্বংস করে পাল্প উড প্ল্যান্টেশন, তামাক চাষের বিস্তার—এসবই পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিবেশ-প্রতিবেশের জন্য বিপর্যয়কর। এ ছাড়া সাধারণভাবে দৃশ্যমান নয় এমন অনেক বিপর্যয়কর ঘটনাও পাহাড়িদের জীবনে ঘটে চলেছে। আসলে বন-পাহাড় সংরক্ষণ ও পার্বত্য অঞ্চলের উন্নয়নের নিয়ামক হচ্ছে রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিভঙ্গি এবং রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়।

সুশাসনের অভাব

ব্র্যাকের জলবায়ু ও দুর্যোগ বিভাগের পরিচালক গওহর নঈম ওয়ারা অল্প দিনের ব্যবধানে ঘটে যাওয়া দুটি ঘটনা—হাওরে বিপর্যয় ও পাহাড়ধসকে দেখছেন সুশাসনের অভাবজনিত ব্যর্থতা হিসেবে। তিনি বলেন, হাওরে ঠিকাদারদের সময়মতো টাকা না দেওয়ায় বাঁধের কাজ হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ের দাঁত আগেই নাড়িয়ে রেখে অতিবৃষ্টির ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা লক্ষ করা যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৃষ্টিপাতের ধরন বদলাচ্ছে। এটা বিবেচনায় রাখতে হবে। আবার পাহাড়ের ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য জেনেই অবকাঠামো নির্মাণ করতে হবে। পাহাড়কে সমতলের মতো ভাবলে হবে না। পাহাড়ে যারা বসবাস করবে, তাদের সেখানকার জীবনে অভ্যস্ত হতে হবে।

গওহর নঈম বলেন, ‘পাহাড়ধসের কারণে শুধু রাঙামাটিতেই প্রায় আড়াই হাজার মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছে। এদের কি যাওয়ার মতো স্থায়ী জায়গা হবে? কোথায় যাবে এরা? এদের মধ্যে যারা শিক্ষার্থী, তাদের কী হবে? তারা কি তাদের পরবর্তী পরীক্ষাগুলোতে বসতে পারবে? এসব ভাবনা তো মানুষের বিবেককে নাড়া দিয়ে যাচ্ছে। এসব বিষয় না ভাবলে তো আমরা মানুষ হতে পারব না।’

মানবিক বিপর্যয়

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন শিক্ষক নৃবিজ্ঞানী প্রশান্ত ত্রিপুরা পাহাড়ধসকে ‘একটি মানবিক বিপর্যয়, রাষ্ট্রীয় ধস ও গভর্ন্যান্স ডিজাস্টার’ বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, যেকোনো দুর্যোগে সমাজের দুর্বলতর মানুষই বেশি মারা যায়। রাঙামাটিতেও তা-ই হয়েছে। সেখানে নূরী আক্তার, বৃষ্টির মতো নিস্পাপ শিশুরা অসহায়ভাবে মারা গেছে। কিন্তু এই মানবিক বিপর্যয়ের খবরগুলো সরকারি প্রচারমাধ্যমে শোনা যায় না। এতে পাহাড়ধসের প্রতি রাষ্ট্রীয় নীতি ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি বোঝা যায়।

প্রারম্ভিক বক্তব্যে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে পাহাড়ধসে দেড় শতাধিক মানুষ মারা গেল। বৃষ্টিতে এখনো পাহাড়ে ধসের আতঙ্ক রয়ে গেছে। ধসে রাঙামাটি কার্যত একটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।

প্রথম আলোর সম্পাদক আরও বলেন, এখন সবার প্রশ্ন, কেন এমন ঘটল? এটা শুধুই অতিবৃষ্টিপাতের ফল? সেখানে কয়েক যুগ ধরে বন ধ্বংস করে, পাহাড়ের প্রাকৃতিক গঠন ও বিন্যাস না মেনে সড়ক ও বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। পাহাড় কেটে অবৈধ স্থাপনা ও জনবসতি তৈরি করা হয়েছে। ঝরনাগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। এরই পুঞ্জীভূত প্রভাবে এত বড় বিপর্যয় ঘটেছে বলে অনেকে মনে করছেন।

গোলটেবিল বৈঠকে প্রথম আলোর বিভিন্ন বিভাগের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকেরা উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন বিশেষজ্ঞরা।