আমার বাসার কাছেই বেথনাল গ্রিন বারা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলার বাহিনী পূর্ব লন্ডনে সাধারণ মানুষের ওপর যেসব এলাকায় বোমা ফেলেছিল, এটি তার অন্যতম। সে সময় সাইরেন শুনলেই মানুষ প্রাণ বাঁচাতে দৌড়ে এই বেথনাল গ্রিন পাতালরেল স্টেশনে আশ্রয় নিত। এর তিন-তিনটি প্রবেশপথ থাকলেও এখানে বহু মানুষ শুধু পায়ের নিচে পিষ্ট হয়েই মারা গেছেন। মাত্র কয় বছর আগে, ভুলতে না পারা সে কাহিনির জন্য বেথনাল গ্রিনের লাইব্রেরির কোণে এবং পাতালপ্রবেশের মাথায় করা হয় একটি স্মরণ-স্থাপত্য। আমি যতবার রোমান রোড পেরিয়ে লন্ডন শহরের কেন্দ্রের দিকে গাড়ি চালিয়ে যাই, এ স্থাপত্য দেখি, ধাঁ করে আমাদের একাত্তরের কথা মনে পড়ে যায়।
কয় দিন ধরে বিবিসি, আল-জাজিরা, সিএনএন, যা-ই ছাড়ছি, দেখছি ইউক্রেনের সাধারণ মানুষের কী দৌড়াদৌড়ি, দুরবস্থা। রাশিয়া ২০১৪ সালেও তা-ই করেছে। সে সময় রাশিয়াপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দ্বারা পরিচালিত আক্রমণে আটকে ফেলা নিরীহ মানুষদের হত্যা ও নির্যাতনের এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে যে একে ‘ইউরোপের শেষ বন্দিশিবির’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এবার রাশিয়া তিন দিক থেকে ইউক্রেন আক্রমণ করেছে। কিয়েভের বর্তমান অস্থির অবস্থা দেখি আর ভাবি, তা ছিল পুতিনের অপরাধের একটি ক্ষুদ্র অংশ কিন্তু তা মানবাধিকার ও তদন্ত সংস্থা দ্বারা নথিভুক্ত করা হয়েছিল।
লন্ডনে আমাদের ঘরের কাজে সাহায্য করেন তনিয়া। তনিয়ার দেশ ইউক্রেন। জটিল কিছু বোঝাতে গেলে গুগল অনুবাদে ইংরেজি থেকে ইউক্রেনীয় না পেয়ে রাশিয়ান ভাষায় রূপান্তর করেই চলে আমাদের কাজ। ইউক্রেনের বেশির ভাগ মানুষ ইউক্রেনীয় ভাষায় কথা বলে, যা সিরিলিক বর্ণমালা ফরম দিয়ে লেখা হয়। স্লাভিক ভাষা পরিবারের পূর্ব স্লাভিক শাখার সঙ্গে রুশ এবং বেলারুশের ভাষাটি রুশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। আবার পোলিশ ভাষার সঙ্গেও এর মিল আছে। তনিয়া মুঠোফোনপটু, ইংরেজিতে একেবারেই তার উল্টো। কিন্তু নিজ সুখ-দুঃখ ভাগ করার ইচ্ছা শতভাগ।
এক সপ্তাহ আগে কাজ করতে এলে দরজা খুলে দিতেই স্বল্প ইংরেজিতে হাহাকার করে ওঠেন, মাই কান্ট্রি...মাই কান্ট্রি...। দশাসই তনিয়ার গায়ের বর্ণ গোলাপি। মনে হলো রাগে-দুঃখে তাঁর সারা শরীর লাল হয়ে গেছে। কী হয়েছে? কী হয়েছে? জিজ্ঞাসা করায় চোখে-মুখে কী উদ্বেগ নিয়ে একটি বিশাল গোলার মতো সোফার কাছে গিয়ে থপ করে বসে টান মেরে মুখের মাস্ক আলগা করেই মুঠোফোন বের করেন! আমি ভাবলাম কোনো বিশেষ শব্দ দেখব। ওটা একটা ভিডিও ক্লিপ। এক নারী চিৎকার-চ্যাঁচামেচি করছেন। আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। কিন্তু তনিয়ার চোখে জল ভর ভর। ‘মাই মাদার, মাই কান্ট্রি, ওয়ার!’
তনিয়ার পুরো পরিবার ইউক্রেনে থাকে। তিনি কীভাবে এ দেশে এসেছেন জানি না। তবে সে যাত্রা যে সুখের ছিল না, তা ধারণা করি। এ দেশে ১৮ হাজারের মতো ইউক্রেনীয় অভিবাসী ও ব্রিটিশ-ইউক্রেনীয় আছেন। তাঁদের নিজ দেশ থেকে পরবাসী হওয়ার মূল কারণই হলো অর্থনীতি। নিজ দেশে কঠোর কায়িকশ্রমের পরে ঘণ্টাপ্রতি হাতে যা আসে, তা বিলেতের দশ ভাগের এক ভাগের মতো। তারা বেশির ভাগই নির্মাণকর্মী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী বা সুপার মার্কেটের কর্মী। অথচ তাঁরা নিজ দেশে একটি পেশাজীবী অবস্থানে ছিলেন। তনিয়া প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একজন নার্স। সেটা আমি তাঁর আচরণ দিয়েও বুঝি। ইংরেজিজ্ঞানের অভাবে তাঁরা এমন উদায়াস্ত দৈহিক পরিশ্রম করেন। সব টাকা দেশে পাঠান।
মানব উন্নয়ন সূচকে ৭৪তম স্থানে ইউক্রেন। এটি ইউরোপের অন্যতম দরিদ্র দেশ। পাশাপাশি গুরুতর দুর্নীতিও আছে। যা হোক, নিজ দেশ নিয়ে কার মন্দ কথা বলতে ইচ্ছা হয়। তাই তনিয়া তাঁদের বিস্তৃত উর্বর কৃষিজমি ও ইউক্রেন বিশ্বের বৃহত্তম শস্য রপ্তানিকারকদের মধ্যে একটি বলে গর্ব করেন। আমিও দেখলাম যুদ্ধ লাগার সঙ্গে সঙ্গে এখানে রুটির দাম বেড়ে গেছে। তনিয়া বলেন, ‘মাই কান্ট্রি রিচ পিপল সেন্ড মানি টু আদার কান্ট্রি। উই পুয়োর পিপল সেন্ড মানি টু ফ্যামিলি, টু মাদার।’ এ ব্যাপারে আমাদের দেশের বড়লোক ও দুষ্টু রাজনীতিকদের এবং সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাঁদের মিল আছে। বিদেশি ব্যাংকে তাঁদের অর্থ, বিশাল বিশাল বাড়ি ও ভিন্ন নামে তাঁদের ব্যবসার কথা কে না জানে। আর অন্যদিকে আছেন মধ্যপ্রাচ্যে রোদে পুড়ে কায়িকশ্রমে যুক্ত সাধারণ বাংলাদেশিরা, যাঁরা তাঁদের সমুদয় অর্থ দেশে পাঠাচ্ছেন। তাঁদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রাই দেশে খুঁটি।
সন্দেহ নেই যে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘ সনদের লঙ্ঘন। একটা অপরাধ। রুশ-ইউক্রেনীয় যুদ্ধ হলো একটি চলমান যুদ্ধ, যেখানে প্রাথমিকভাবে একদিকে রাশিয়া, বেলারুশ, রাশিয়াপন্থী বাহিনী এবং অন্যদিকে ইউক্রেন। অথচ এ যেন ব্যাপক ও নিয়মতান্ত্রিক আন্তর্জাতিক অপরাধে জড়িত থাকাই যথেষ্ট নয়, পুতিনের বিরুদ্ধে যুক্তরাজ্যে রুশ ভিন্নমতাবলম্বীদের বিষ প্রয়োগ এবং গণতন্ত্রপন্থী ও মানবাধিকার সমর্থকদের কারাবাসের নির্দেশ দেওয়ার অভিযোগও আনা হয়েছে। পুতিনের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন ছাড়াও দুর্নীতির অভিযোগও আছে।
কিন্তু পুতিন রাশিয়া নয় এবং রাশিয়া পুতিন নয়। গত কয়েক দিনে, রাশিয়াজুড়ে হাজার হাজার বিক্ষোভকারী ইউক্রেন আক্রমণের প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছে। ‘নো টু ওয়ার’ লেখা প্ল্যাকার্ড ও গ্রাফিতিতে রাশিয়ার অনেক শহর ভরে গেছে। অনেকে গ্রেপ্তারও হয়েছে।
পুতিনের সঙ্গে কী করে পারবে তনিয়ার দেশ! ন্যাটো হতাশ করেছে। এদিকে তাদের পূর্বকীর্তির কথাও মনে করে কোনো কোনো দেশ ভাবছে, এবার মজা বোঝো! লন্ডনে লকডাউন নেই। খুলে গেছে ক্যাফে, নাট্যশালা, কবিতাকেন্দ্র। চারদিকে মিছিল হচ্ছে। গত রোববারও দুটো হলো এডিনবরায়। বুদ্ধিজীবীরা পড়েছেন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনকে নিয়ে। লকডাউনের সময় নিয়ম ভেঙে ডাউনিং স্ট্রিটে গোপন পার্টি দিয়ে যেভাবে ধরা খেয়েছেন, তার থেকে জনগণের দৃষ্টি ঘোরাতেই নাকি ইউক্রেন নিয়ে তার এত উল্লম্ফন! বরিস সাহেব যতই লাফালাফি করুন না কেন ইউরোপ ত্যাগ করায় তিনিও এখন পুতিনের চোখে পুঁটি মাছ। জার্মানি ছাড়া কোনো দেশই আর প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নেই। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাকে তুড়ি মেরে এগিয়ে চলেছে পুতিনের আগ্রাসন। ওরা ঢুকে পড়েছে ইউক্রেনের একের পর এক শহরে আর আমি শুনতে পাচ্ছি অশনিসংকেত।
শামীম আজাদ কবি ও কথাসাহিত্যিক