প্রকৃতিকে রক্ষার শিক্ষা দিক ভ্রমণ

সেন্ট মার্টিনের ছেঁড়া দ্বীপে পর্যটকের পদচারণা
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘ট্যুরিজম স্যাটেলাইট অ্যাকাউন্ট’ শীর্ষক জরিপের ফল অনুযায়ী, দেশে ভ্রমণের জন্য পর্যটকদের পছন্দের শীর্ষে রয়েছে ডিসেম্বর মাস। তাঁদের দ্বিতীয় ও তৃতীয় পছন্দের মাস হলো যথাক্রমে জুন ও জানুয়ারি। দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে পর্যটকেরা কক্সবাজার, চট্টগ্রামের পতেঙ্গা ও পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতে যেতে বেশি পছন্দ করেন। সুন্দরবন, রাঙামাটির সাজেক ভ্যালি ও মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলও তাঁদের পছন্দের তালিকায় আছে। বিবিএস জানাচ্ছে, জিডিপিতে এখন পর্যটন খাতের অবদান ৩ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৭৭ হাজার কোটি টাকা।

ভ্রমণের মৌসুম শুরু হয়েছে। মানুষের বিভিন্ন স্থানে বেড়াতে যাওয়া, প্রকৃতির সান্নিধ্যে সময় কাটানো আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা এবং শরীর ও মনের জন্যও ভালো। পর্যটন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতি আনে। অনেকের কর্মসংস্থান হয়। কিন্তু বেড়ানো যাতে প্রাকৃতিক ভারসাম্যের ক্ষতি না করে, সে বিষয় কি আমরা খেয়াল রাখছি?

কয়েক সপ্তাহ আগে কক্সবাজারে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। বেশ কয়েকটি সমুদ্রসৈকতে প্রচণ্ড শব্দ করে একধরনের গাড়ি চলছে। সেগুলো পর্যটকদের সৈকতে ঘোরানোর পাশাপাশি কাঁকড়া দেখাতে নিয়ে যায়। সৈকতে শব্দদূষণকারী এ ধরনের গাড়ির অনুমোদন দেওয়া হলো কোন যুক্তিতে? এই শব্দ কাঁকড়ার ভয়ের কারণ এবং অনেক দর্শনার্থীর জন্য অস্বস্তিকর। মাইকে জোরে গান বাজিয়ে জাতীয় উদ্যানে গিয়ে বনভোজন করার রীতি বলে দেয়, এসব বিষয়ে আমাদের সংবেদনশীলতা কতটা কম। বেড়াতে গিয়ে আবর্জনা যেখানে–সেখানে ফেলে পরিবেশ নোংরা করাও সাধারণ ঘটনা। গাছের পাতা ছেঁড়া, ডাল ভাঙা ও প্রাণীদের সঙ্গে নিষ্ঠুর আচরণ করতেও দেখা যায়।

প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের পুনর্মূল্যায়ন প্রয়োজন। আমরা তো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের স্থানে অতিথি হিসেবে যাই। জায়গাগুলো সেখানকার গাছপালা, পাখি ও অন্যান্য প্রাণী এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেশ কিছু মানুষের নিজের বাসস্থান। আমাদের আচরণে যাতে তারা বিরক্ত না হয়, সে বিষয়ে সতর্ক থাকা প্রয়োজন। আমাদের বাড়িতে কেউ বেড়াতে এসে হইহট্টগোল বা কিছু নষ্ট করলে ভালো লাগবে? তাহলে আমরা অন্যদের সঙ্গে তেমন করছি কোন অধিকারে?

ভ্রমণের সময় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখা, স্থানীয় খাবার খাওয়া আর ছবি তোলার গুরুত্ব আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু সেখানকার পরিবেশ, প্রাণিজগৎ ইত্যাদি নিয়ে শেখার সুযোগ থাকা প্রয়োজন। বাংলাদেশে তা নেই বললেই চলে।

কোথাও বেড়াতে গেলে সেখানকার প্রাণ ও প্রকৃতিকে সম্মান করতে হবে—এ শিক্ষা আমি বারবার পেয়েছি অস্ট্রেলিয়ার বেশ কিছু ট্যুরে। গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ, রেইনফরেস্ট, ম্যানগ্রোভ অরণ্যসহ অনেক স্থানে গিয়েছি। কুমির, সাপ ও অন্যান্য প্রাণীর নিজস্ব সীমানা মেনে চলার গুরুত্বসহ প্রাণীদের প্রতি সংবেদনশীল আচরণের বিষয়ে সচেতন হয়ে উঠেছি। যেমন কোয়ালাকে স্পর্শ করতে হলে তা হতে হবে কোমল, যাতে প্রাণীটি অস্বস্তির শিকার না হয়। ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অধিবাসীরা গাছের তেমন অংশ থেকেই বুমেরাং বানাত, যেটি আবার জন্মায়। প্রকৃতি রক্ষায় তাদের গভীর প্রজ্ঞা জেনে অনুপ্রাণিত হয়েছি। যেসব স্থানে গিয়েছি, সেখানে দর্শনার্থীদের শিক্ষিত করা হয়েছে নানা ভাবে। যেমন যাত্রাপথে গাড়িতে ভিডিও দেখানো ও নির্দেশিকা দেওয়া হয়; দর্শনীয় স্থানে বিভিন্ন অংশে প্রাসঙ্গিক বর্ণনাসংবলিত তথ্য আছে। সবকিছুতেই দর্শনার্থীদের আচরণ নিয়ে পরামর্শ থাকে। যাঁরা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞ এবং প্রকৃতিকে ভালোবাসেন, তেমন গাইডদের কথা থেকে জেনেছি অনেক কিছু।

‘উন্নয়ন’-এর নামে প্রকৃতি লুণ্ঠন এবং ধ্বংস নয়, বরং কীভাবে প্রকৃতি ও মানুষের সহাবস্থান নিশ্চিত করা যায়, সে উপায় বের করা আশু প্রয়োজন। জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা আমাদের সম্মিলিত দায়িত্ব। পর্যটন যাতে পরিবেশের ক্ষতি না করে, বরং মানুষকে শেখায় প্রকৃতিকে সম্মান করতে, সে বিষয়ে আমাদের এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে।

গ্রিন আইল্যান্ডে গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ দেখার সময় গাইড জানান, একবার এক পর্যটক প্রবালের খোলসের একটা অংশ নিয়ে গিয়েছিলেন। বিমানবন্দরে ধরা পড়ায় তাঁকে ৫০ হাজার অস্ট্রেলিয়ান ডলার জরিমানা গুনতে হয়েছিল। সেখানে দর্শনার্থীদের বারবার মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে, ‘গ্রেট ব্যারিয়ার রিফে আপনার দিনটি চমৎকার কাটুক। অনুগ্রহ করে প্রাণীদের দিকেও খেয়াল রাখুন, কেননা, এটি তাদের নিজেদের বাসস্থান।’

পৃথিবীর ওপর মানবজাতির অধিকার যতখানি, ঠিক ততটাই অধিকার গাছপালা, প্রাণিজগৎ, নদীনালা, পাহাড় আর সমুদ্রের। আমাদের সবার রয়েছে পারস্পরিক নির্ভরশীলতার সম্পর্ক। ধরা যাক একটি পাখির কথা, যে বিভিন্ন গাছের ফল খেয়ে তার বীজ ছড়িয়ে দেয়। এই পাখি না থাকলে গাছগুলোও হারিয়ে যাবে। প্রাকৃতিক সামঞ্জস্য নষ্ট হয়ে গেলে কী ভয়াবহ পরিণাম হয়, তা আমরা বাংলাদেশসহ নানা দেশে দেখছি। মনে পড়ছে জীবাশ্মবিজ্ঞানী রিচার্ড লিকির দ্য সিক্সথ এক্সটিংশন বইয়ের কথা। তিনি মানবজাতিকে সতর্ক করে বলেছেন, ‘আমাদের কর্মকাণ্ডের ফলেই হয়তো একদিন পৃথিবী থেকে সমগ্র প্রাণিজগৎ বিলুপ্ত হয়ে যাবে।’ বইটি তিনি উৎসর্গ করেছেন ‘আমাদের সহপ্রজাতি ও যৌথ ভবিষ্যতের জন্য’। একটি প্রজাতিও যদি বিলুপ্ত হয়ে যায়, পৃথিবীর ভারসাম্য বিরাট ক্ষতির মুখে পড়বে।

‘উন্নয়ন’-এর নামে প্রকৃতি লুণ্ঠন এবং ধ্বংস নয়, বরং কীভাবে প্রকৃতি ও মানুষের সহাবস্থান নিশ্চিত করা যায়, সে উপায় বের করা আশু প্রয়োজন। জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা আমাদের সম্মিলিত দায়িত্ব। পর্যটন যাতে পরিবেশের ক্ষতি না করে, বরং মানুষকে শেখায় প্রকৃতিকে সম্মান করতে, সে বিষয়ে আমাদের এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে।

গাছপালা, নদী, পাখি ও অন্যান্য প্রাণী, স্থানীয় মানুষ ইত্যাদির জন্য নেতিবাচক কোনো পর্যটন প্রকল্পের অনুমোদন না দেওয়া সরকারের দায়িত্ব। কেউ প্রকৃতি ও প্রাণিজগতের ক্ষতি করলে তাকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। কোনো স্থানে ভ্রমণে যাওয়ার আগেই পর্যটকদের জানিয়ে দিতে হবে সেখানে কী করা যাবে আর কী করা যাবে না। বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন ও বেসরকারি ট্যুর অপারেটররা সবার সচেতনতা বাড়াতে পারে। নিয়োগ দিতে পারে প্রশিক্ষিত গাইড। শিশুদের বোঝার উপযোগী করেও তথ্য দিতে হবে। পরিবার ও বিদ্যালয় থেকেই প্রকৃতিকে সম্মান করার পাঠ শুরু হওয়া দরকার। এ নিয়ে সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে গণমাধ্যম ভূমিকা রাখতে পারে। আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্বশীল আচরণ করা প্রয়োজন। তাহলে আমরা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার মতো বলতে পারব, ‘আমরা কেঁচো, গুগলি, শামুক, ব্যাঙ ও সাপেদের সামঞ্জস্য ঠিকঠাক রেখেছি’।

  • লায়লা খন্দকার উন্নয়নকর্মী