একজন মানুষের পূর্ণ বিকাশের জন্য রাষ্ট্র ও সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত অধিকারে সবার ন্যায্য হিস্যা থাকা দরকার। বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে একজন প্রতিবন্ধী নারীরও সব ধরনের অধিকার পাওয়ার কথা। কিন্তু আমরা যখন বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে চোখ রাখি, আদৌ কি প্রতিবন্ধী নারীদের প্রাপ্য অধিকারের বাস্তবায়ন দেখতে পাই?
এক হাজার প্রতিবন্ধী ব্যক্তির ওপর করা একটি গবেষণায় উঠে এসেছে, ১০ দশমিক ৩ শতাংশ প্রতিবন্ধী নারী যৌন সহিংসতার শিকার। সমীক্ষা থেকে দেখা যায়, দেশের ৯৬ শতাংশ প্রতিবন্ধী নারী বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের স্বীকার। এর মধ্যে শারীরিক–মানসিক নির্যাতনের পাশাপাশি একটি বড় অংশ যৌন নির্যাতনেরও শিকার হন। আমাদের দেশে প্রতিবন্ধী নারীদের মধ্যে প্রায় তিন-চতুর্থাংশ মানসিক নির্যাতনের শিকার হন। আর শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন ৩০ শতাংশের বেশি নারী। এ ছাড়া অর্ধেকের বেশি প্রতিবন্ধী মেয়ের বাল্যবিবাহ হয়, যার হার ৫২ দশমিক ৪। ৩৩ দশমিক ২ শতাংশ নারী শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় ভাগে মৌলিক অধিকারের যে বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত আছে, যেমন আইনের দৃষ্টিতে সমতা, সমানাধিকার, আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার—এসবের বাস্তব চিত্রও প্রায় একই রকম। যেমন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের (এমজেএফ) ২৫টি মামলার অনুসন্ধান থেকে জানা যায়, ২০১২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত হওয়া ২৫টি ধর্ষণ মামলার বেশির ভাগ আসামি জামিন পেয়েছেন। যদিও নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ অনুযায়ী তাঁদের জামিন পাওয়ার কথা নয়। এসব মামলার বেশির ভাগ আসামি গ্রেপ্তার হওয়ার ২৪ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে জামিন পেয়েছেন। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, থানা-পুলিশ ও বিচারপ্রক্রিয়ায় ধর্ষণের শিকার শিশু ও নারীকেই নানাভাবে দোষারোপ করা হয়। এ ছাড়া মেডিকো লিগ্যাল ও সাক্ষ্যপ্রমাণের ক্ষেত্রে টু-ফিঙ্গার টেস্টের মতো অবমাননাকর পদ্ধতি উচ্চ আদালতের রায়ে নিষিদ্ধ হলেও প্রত্যন্ত অঞ্চলে এ প্রক্রিয়া এখনো চলছে বলে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
আমরা জানি, অনেক প্রতিবন্ধী ব্যক্তির ভাষিক যোগাযোগে সমস্যা থাকে। অনেকে নিজের ভাষা প্রকাশ করতে পারেন না, কেউ কানে শোনেন না, চোখে দেখেন না বা কথা বলতে পারেন না। এসব ক্ষেত্রে তাঁরা নির্যাতনের শিকার হলে ভুক্তভোগী তাঁর ঘটনার বর্ণনা দিতে পারেন না। অনেক সময় শিশুরা ধর্ষণের শিকার হলে অভিভাবকদের বর্ণনা অনুযায়ী মামলা হয়। অনেক সময় কন্যাশিশুটির ভাষা বুঝতে তাঁদের নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়। বেশির ভাগ সময়ই তাদের ভাষা তাঁরা বোঝেন না। কিন্তু এ জনগোষ্ঠীর ভাষা বোঝার জন্য কোনো স্পিচ ও ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপি প্রশিক্ষণও তাদের দেওয়া হয় না বলে জানা গেছে। অথচ প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩–এর ১৬ (থ)-তে শ্রবণপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও বাক্প্রতিবন্ধী ব্যক্তির ইচ্ছা অনুযায়ী যথাসম্ভব বাংলা ইশারা ভাষাকে প্রথম ভাষা হিসেবে গ্রহণ করতে বলা হয়েছে। তবে আশার কথা হলো, বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা বদলাচ্ছে।
বাংলাদেশের সংবিধানে সব অধিকার, মানবসত্তার মর্যাদা, মৌলিক মানবাধিকার ও সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকারের কথা উল্লেখ আছে। এরই সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার ২০১৩ সালে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকারসংক্রান্ত জাতিসংঘ সনদের সমর্থনে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন-২০১৩ পাস করে, যেখানে উল্লেখ আছে—(ক) পূর্ণমাত্রায় বাঁচিয়া থাকা ও বিকশিত হওয়া; (খ) সর্বক্ষেত্রে সমান আইনি স্বীকৃতি এবং বিচারগম্যতা; (গ) উত্তরাধিকারপ্রাপ্তি; (ঘ) স্বাধীন অভিব্যক্তি ও মত প্রকাশ এবং তথ্যপ্রাপ্তি; (ঙ) মাতা-পিতা, বৈধ বা আইনগত অভিভাবক, সন্তান বা পরিবারের সহিত সমাজে বসবাস, বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন ও পরিবার গঠন; (চ) প্রবেশগম্যতা; (ছ) সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধিতার ধরন অনুযায়ী পূর্ণ ও কার্যকরভাবে অংশগ্রহণ; (জ) শিক্ষার সকল স্তরে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উপযুক্ত সুযোগ-সুবিধাপ্রাপ্তি সাপেক্ষে একীভূত বা সমন্বিত শিক্ষায় অংশগ্রহণ; (ঝ) সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মে নিযুক্তি; (ঞ) কর্মজীবনে প্রতিবন্ধিতার শিকার ব্যক্তি কর্মে নিয়োজিত থাকিবার, অন্যথায়, যথাযথ পুনর্বাসন বা ক্ষতিপূরণপ্রাপ্তি; (ট) নিপীড়ন হইতে সুরক্ষা এবং নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশের সুবিধাপ্রাপ্তি; (ঠ) প্রাপ্যতা সাপেক্ষে সর্বাধিক মানের স্বাস্থ্যসেবাপ্রাপ্তি; (ড) শিক্ষা, কর্মক্ষেত্রসহ প্রযোজ্য সকল ক্ষেত্রে ‘প্রয়োজনীয় স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য উপযোগী পরিবেশ ও ন্যায্য সুযোগ-সুবিধা’প্রাপ্তি; (ঢ) শারীরিক, মানসিক ও কারিগরি সক্ষমতা অর্জন করিয়া সমাজজীবনের সকল ক্ষেত্রে সম্পূর্ণভাবে একীভূত হইবার লক্ষ্যে সহায়ক সেবা ও পুনর্বাসন সুবিধাপ্রাপ্তি; (ণ) মাতা-পিতা বা পরিবারের ওপর নির্ভরশীল প্রতিবন্ধী ব্যক্তি মাতা-পিতা বা পরিবার হইতে বিচ্ছিন্ন হইলে বা তাহার আবাসন ও ভরণপোষণের যথাযথ সংস্থান না হইলে যথাসম্ভব নিরাপদ আবাসন ও পুনর্বাসন; (ত) সংস্কৃতি, বিনোদন, পর্যটন, অবকাশ ও ক্রীড়া কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ; (থ) শ্রবণপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও বাক্প্রতিবন্ধী ব্যক্তির নিজ ইচ্ছা অনুযায়ী যথাসম্ভব বাংলা ইশারা ভাষাকে প্রথম ভাষা হিসেবে গ্রহণ; (দ) ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা; (ধ) স্ব–সহায়ক সংগঠন ও কল্যাণমূলক সংঘ বা সমিতি গঠন ও পরিচালনা; (ন) জাতীয় পরিচয়পত্রপ্রাপ্তি, ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তি, ভোট প্রদান ও নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং (প) সরকার কর্তৃক সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা নির্ধারিত অন্য কোনো অধিকার প্রণয়ন। প্রতিবন্ধী নারীদের অধিকার নিশ্চায়নে আমাদের প্রয়োজন এসব অধিকারের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন।
এ ছাড়া প্রতিবন্ধী নারীদের পূর্ণ সেবা তথা যোগাযোগ ব্যবস্থাপনায় দেশের প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও জেলা সদর হাসপাতালে একজন স্পিচ ও ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপিস্ট নিয়োগ অপরিহার্য। এমনকি আইনি সহায়তা কেন্দ্র, সমাজসেবা কেন্দ্র, চিকিৎসা কেন্দ্র—সব জায়গায় প্রতিবন্ধী নারীর ভাষা বোঝার জন্য বিশেষ ভাষা বিশেষজ্ঞের নিয়োগ দেওয়াও এখন সময়ের দাবি। একটি সময় ছিল যখন বাংলাদেশে ভাষিক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, এমন মানুষদের যোগাযোগের সীমাবদ্ধতা দূর করা যথেষ্ট দক্ষ জনবলের ঘাটতি ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের বিদ্যায়তনিক পরিমণ্ডলে যোগাযোগবৈকল্য অধ্যয়ন, ভাষা ও যোগাযোগ থেরাপির মতো বিষয়গুলো যুক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিউনিকেশন ডিজঅর্ডারস বিভাগ, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিশেষ শিক্ষা বিভাগ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের অ্যাফিলিয়েট প্রতিষ্ঠান পাইজার, সেন্টার ফর দ্য রিহ্যাবিলিটেশন অব দ্য প্যারালাইজড পরিচালিত স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপি বিভাগ অন্যতম।
আন্তর্জাতিক নারী দিবস ২০২২–এ আমাদের প্রত্যাশা হোক প্রতিবন্ধী নারীর ভাষিক যোগাযোগের প্রতিবন্ধকতা দূর করার। বাংলাদেশের প্রতিবন্ধী নারী ও কন্যাশিশুর অধিকার নিশ্চিত করতে এর কোনো বিকল্প নেই। তাই চলুন, আমরা সরকারি–বেসরকারি সব পর্যায়ে প্রতিবন্ধী নারী ও কন্যাশিশুর অধিকারের ব্যাপারে তাঁদের কণ্ঠস্বর হই, তাঁদের ভাষিক যোগাযোগের অধিকার নিশ্চিত করি।
তাওহিদা জাহান চেয়ারপারসন, কমিউনিকেশন ডিজঅর্ডারস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়