২০১৪ সালের নির্বাচনের পর থেকে ভোটের প্রতি মানুষের একধরনের ক্ষোভ ও অনাগ্রহ তৈরি হয়েছে। এ ক্ষোভ ক্রমাগত বেড়ে বহিঃপ্রকাশ ঘটছে সরকারি দলের প্রতীকের প্রতি। সাম্প্রতিক সময়ের নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটতে দেখা যাচ্ছে।
নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনটি এ থেকে একেবারেই আলাদা। মনে হতে পারে এটি দেশের বাইরের একটি অংশ। সন্ত্রাসের জনপদের তকমা আঁটা এ নগরের মানুষ বরাবরই শান্তির জন্য লড়াই করে চলেছে। ২০১১ সালে গঠিত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনে সে বছরই প্রথম সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী শামীম ওসমানকে স্বতন্ত্র প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী লক্ষাধিক ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেন। ভোটের আগের রাতে বিএনপি–সমর্থিত প্রার্থী তৈমুর আলম খন্দকার নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। নির্বাচনে তখন দলীয় প্রতীক ছিল না। শামীম বলতে শুরু করেন, আইভী বিএনপি-জামায়াতের ভোটে বিজয়ী হয়েছেন।
নির্বাচনে ভরাডুবিকে শামীম ওসমান মেনে নিতে পারেন না। তিনি আইভীর বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ করেন, কুশপুত্তলিকা দাহ করেন, সংসদে দাঁড়িয়ে বলেন, তাঁর লোকজন আইভীর ছবির সঙ্গে অশ্লীল বাক্যের ব্যানারে শহর ছেয়ে ফেলে। ২০১৬–এর নির্বাচনে আইভীর নাম বাদ দিয়ে শামীম মেয়র হিসেবে তৃণমূলের সমর্থিত প্রার্থীদের তালিকা পাঠান। কিন্তু দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা আইভীকেই মনোনয়ন দেন। আইভী নৌকা প্রতীক নিয়ে বিএনপিদলীয় প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেনকে পরাজিত করে নির্বাচিত হন।
নারায়ণগঞ্জে হত্যা, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, ভূমি দখল, পরিবহন সিন্ডিকেট সবকিছুতেই ওসমান পরিবারের নাম আসে। মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রির কতিপয় মালিকের সঙ্গে সিন্ডিকেট করে নারায়ণগঞ্জের হাজার হাজার একর জমি দখলে শামীমের নাম জড়িত। ২০১১–এর নির্বাচনে পরাজয়ের জন্য ওসমান পরিবার ত্বকীকে হত্যা করেছে বলে র্যাব সংবাদ সম্মেলন করে জানায়। এখানে সাত খুনের সঙ্গে শামীমের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে ওই ঘটনার সাজাপ্রাপ্ত আসামি, র্যাবের সদস্য পূর্ণেন্দু বালা তাঁর জবানবন্দিতে উল্লেখ করেছেন। আইভী এসবের বিরুদ্ধে নারায়ণগঞ্জে নাগরিক সমাজকে নিয়ে লড়ে এসেছেন। নিজ দলের হলেও তিনি এ দুষ্কর্মের প্রতিবাদ করছেন। আর সে জন্যই আইভীর পক্ষে দলমত–নির্বিশেষে মানুষ বিগত সব নির্বাচনে সমর্থন দিয়ে এসেছেন।
বিগত ১০ বছরে আইভী পিছিয়ে পড়া অঞ্চলগুলোতে দৃশ্যমান উন্নয়ন করেছেন। সরকারের সহায়তা ছাড়াও বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জাইকাসহ বিভিন্ন উন্নয়ন ও দাতা সংস্থা সিটি করপোরেশনে অর্থায়ন করেছে। দেশের অন্য কোনো সিটি করপোরেশনে তারা এভাবে করেনি। আইভী সততা ও নিষ্ঠার মধ্য দিয়ে এ আস্থা অর্জন করতে পেরেছেন।
২০১৬–এর নির্বাচনের দিন শামীম ব্যালট পেপার উঁচিয়ে সাংবাদিকদের দেখালেও তিনি আইভীর পক্ষে ছিলেন না। এবারও তিনি ও তাঁর অনুসারীরা তৈমুরের পক্ষে কাজ করছেন, তার প্রমাণ শামীমের সংবাদ সম্মেলন। নিজ দলের প্রার্থীর পক্ষে নামবেন, এতে সংবাদ সম্মেলন করে জানান দিতে হবে কেন? দলের অন্য কাউকে তো এভাবে ঘোষণা দিতে হয়নি। নিজেদের কাজের কারণে নির্বাচনের মাঠে শামীমের কোনো ভোট নেই। জিততে হলে জাল-জালিয়াতি করতে হবে, কেন্দ্র দখল করতে হবে। নারায়ণগঞ্জে বঙ্গবন্ধুকে ভালোবেসে আওয়ামী লীগ করা লোকেরা বরাবরই কোণঠাসা। শামীমের বিরুদ্ধে এ–ও অভিযোগ আছে, ১৯৮৬ ও ’৯৬ সালের জাতীয় নির্বাচনে লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থী নিজের ভাই নাসিম ওসমানকে বিজয়ী করতে নৌকার প্রতীকের প্রার্থীর বিরুদ্ধে ভোট ছিনতাই, কেন্দ্র দখলসহ সবকিছু করেছেন। নারায়ণগঞ্জের আওয়ামী লীগ ও সাধারণ মানুষ তাদের ‘লাঙ্গল মার্কা আওয়ামী লীগ’ বলে জানে।
এবারের নির্বাচনে আইভীর প্রতীক নৌকা। এ প্রতীকের প্রতি অনাগ্রহী ভোটাররাও আইভীকে ভোট দেবেন। প্রতীকের দিকে না তাকিয়ে, তাঁর দলের দিকে না তাকিয়ে আইভীকে ভোট দেবেন তাঁর সাহসিকতার জন্য আর উন্নয়নের জন্য। সারা বাংলাদেশের সঙ্গে এ নির্বাচনকে মেলানো যাবে না।
রফিউর রাব্বি নারায়ণগঞ্জের নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ও সন্ত্রাসবিরোধী ত্বকী মঞ্চের আহবায়ক