প্রস্তাবিত আইন কি আদৌ বাস্তবসম্মত?

>প্রস্তাবিত ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতিকরণ অপরাধ’ আইনের যে খসড়া তৈরি হয়েছে, তা নিয়ে নানা মত ও বিতর্ক রয়েছে। এ নিয়ে দুই পর্বের লেখার প্রথমটি প্রকাশিত হলো আজ।
অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

আইনের শাসন বিষয়টি আমাদের দেশে যেন গুরুত্ব হারাতে বসেছে। পাশ্চাত্যের সভ্যতা এই রুল অব ল দিয়ে বিশ্বকে বশ করেছে। আর আমরা বুঝে না-বুঝে আইনের শাসন চাই। আবার এ কথাও সত্য, যেসব ভালো আইন আমাদের আছে, তার প্রয়োগ নেই। আবার প্রয়োগ থাকলেও তা খণ্ডিত। সমতার নীতি খাটছে না। একই আইনের ভিন্ন ভিন্ন প্রয়োগ ও কার্যকরতা দেখা যাচ্ছে। সমাজে যখন গণতান্ত্রিক রীতিনীতির ঘাটতি বেশি পড়ে, তখন নতুন আইনের আবির্ভাব কোনো স্বস্তির বিষয় হতে পারে না। এখন আমরা নতুন আরেকটি আইনের কথা শুনছি। প্রস্তাবিত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতিকরণ অপরাধ আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, যে কেউ মামলা করতে পারবে, এটাই সব থেকে বড় উপদ্রব হিসেবে হাজির হতে পারে।
খসড়ার প্রথম তিনটি ধারা দিয়ে শুরু করি। এতে বলা হয়েছে, তিনটি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে ‘মুক্তিযুদ্ধের’ ঘটনা ঘটেছে, যা অস্বীকার করা হবে অপরাধ। আমাদের প্রশ্ন, সংসদ বা সরকার কি তার আগে এটা ঠিক করে দেবে যে, ‘স্বীকার’ করা কাকে বলে? তা যদি সরকারি প্রজ্ঞাপনে নির্ধারিত করে দেওয়া না হয়, তাহলে আমরা দেশে হাজার হাজার মামলা পাব। হুলিয়া পাব। জামিন মঞ্জুর বা নামঞ্জুর শব্দ পাব। কিন্তু দোষী সাব্যস্ত হব কিসের ভিত্তিতে? প্রথমটি বলছে, ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট থেকে ১৯৭১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যবর্তী সময়ে ‘মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুতকারী ঘটনাসমূহ’ ঘটেছে। এটা কি সত্য? এটা আইন হলে তা কী করে আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুর মর্যাদা বাঁচাবে? এই আইনের মধ্যেই তো মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুতকারী ঘটনাসমূহকে অস্বীকার বা বিকৃতকরণ দেখতে পাওয়া যায়। একটি প্রমাণ দেওয়া যাক। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ছয় দফা বাঙালি জাতির মুক্তি ও স্বাধীনতার সনদ। আর সেই ছয় দফার প্রথম দফাতেই লাহোর প্রস্তাবের কথা আছে। তাহলে? ১৯৪০ সালে আমাদের শেরেবাংলাই তো মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুতকারী ছিলেন, নাকি ছিলেন না? লাহোর প্রস্তাবে ‘স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ’ গঠনের যে কথা ছিল, তা অত নির্বিবাদে আমরা বদলাতে দিলাম কেন? স্বাধীনতা ও পতাকা লাহোরে চূড়ান্ত করার পরেও আমরা ভাষা ও স্বায়ত্তশাসন নিয়ে লড়াইয়ে নেমেছিলাম।
প্রস্তাবিত আইনের দ্বিতীয় উপদফা বলেছে, ১৯৭১ সালের ১ থেকে ২৫ মার্চের মধ্যবর্তী সময়ের ‘ঘটনাসমূহ’ অস্বীকার
করা হবে অপরাধ। কিন্তু সেই ঘটনাসমূহ কী, তার কোনো ব্যাখ্যা বা আলোচনা নেই। এর মানে হলো, পুলিশ এবং অভিযোগকারীরা কোনটি ‘ঘটনা’ আর কোনটি ‘বিকৃতি’, তা অনুমান করে নেবে। তৃতীয় উপদফায় ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যবর্তী সময়ে ‘মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাসমূহ অস্বীকার’কে দণ্ডনীয় করা হয়েছে। বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান লিখে গেছেন কি না জানি না; আমাকে বলেছিলেন, তিনি ৭ মার্চকেই স্বাধীনতার ঘোষণা দিবস মানেন। ১ মার্চ থেকে শুরু হওয়া অসহযোগ আন্দোলনের দিনগুলোতে বঙ্গবন্ধু প্রথম জনগণের সরকারের জন্ম, বিকাশ ও তাকে ক্রিয়াশীল করে গেছেন। সুতরাং তারিখ পালনের প্রয়োজনে আমাদের সংগ্রামকে তারিখবন্দী করে ইতিহাস চর্চার পথ দুর্গম করার প্রয়াস পরিত্যাগ করাই উত্তম।
খসড়া বলেছে, গণমাধ্যমসহ যেকোনো মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ‘বিদ্বেষমূলক’ বক্তব্য, সরকারের দ্বারা প্রকাশিত যে
‘কোনো ধরনের প্রকাশনার’ অপব্যাখ্যা ও অবমূল্যায়ন অপরাধ হবে। কোন কোন প্রকাশনার অপব্যাখ্যা বা অবমূল্যায়ন করলে অপরাধ হবে, তা কি তবে নির্দিষ্ট করে বলে দেওয়া হবে? তা না হলে নাগরিকেরা কী করে বুঝবেন, কোনটা সঠিক ব্যাখ্যা ও সঠিক মূল্যায়ন? আর এ ধরনের কিছু যদি নির্ধারিত না থাকে, তবে পুলিশ কাজ করবে কিসের ভিত্তিতে? প্রশ্ন হচ্ছে, এ রকম কিছু করা কি আদৌ বাস্তবসম্মত? অথবা এ ধরনের কিছু ঠিক করে দেওয়ার কোনো সুযোগ আছে কি? সরকারি দলের নেতারা প্রতিদিন যা বলেন, সেটাই কি সঠিক ইতিহাস বলে বিবেচিত হবে? সেটাকে যদি ‘কোনো ধরনের প্রকাশনা’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তবে তার কোনো সমালোচনা বা প্রতিবাদকে সহজেই পুলিশ ‘অপব্যাখ্যা বা অবমূল্যায়ন’ হিসেবে চিহ্নিত করতে পারবে? টিভি টক শোতে ‘সরকারি ইতিহাস’ খণ্ডন করা বা ভিন্নমত প্রকাশ করা হতে পারে মামলার কারণ!
রাজাকারদের ‘অপরাধমূলক কার্যক্রমের’ পক্ষে কোনো ধরনের যুক্তি প্রদর্শন বা প্রচারণা; মুক্তিযুদ্ধের শহীদ, বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা, জনগণকে হত্যা, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ এবং লুটতরাজ-সংক্রান্ত যেকোনো তথ্যের অবনমন কিংবা তা ব্যঙ্গাত্মকভাবে উপস্থাপন নিশ্চয়ই গ্রহণযোগ্য নয়। মুক্তিযুদ্ধকে ‘জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রাম’ ভিন্ন অন্য কোনো নামে অবনমন বা অবমাননাকে অপরাধ বলা হয়েছে। অনুমান করি, পঞ্চম সংশোধনীতে সংবিধানের প্রস্তাবনায় বর্ণিত ‘ঐতিহাসিক সংগ্রাম’ কথাটি বদলে ‘যুদ্ধ’ প্রতিস্থাপন করেছিল। এর একটা অর্থ এই যে জিয়া বা তাঁর অনুসারীরা বঙ্গবন্ধুকে খাটো করতে চেয়েছিলেন। ঐতিহাসিক সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু আছেন, জিয়া নেই। আর মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি বঙ্গবন্ধু নেই, সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে জিয়া আছেন। কিন্তু সংবিধানের প্রস্তাবনার পরিবর্তনকে অপরিবর্তনীয় এবং তার অবনমন ও অবমাননার জন্য খোদ সংবিধানে ‘মৃত্যুদণ্ডের’ বিধান রেখে এখন অধস্তন আইনে পাঁচ বছরের জেলের বিধান করার কী যুক্তি থাকতে পারে? কোন আইনে বিচার হবে, এ নিয়ে কাজিয়া লাগলে বা লাগানো হলে হয়রানি দেখা যাবে, বিচার দেখা যাবে না।
খসড়ায় ‘মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ, শান্তিবিরোধী অপরাধ, গণহত্যা, যুদ্ধ অপরাধকে সমর্থন বা উক্ত রূপ অপরাধের বিচার কার্যক্রমকে প্রশ্নবিদ্ধকরণ বা এতদ্বিষয়ে কোনো ধরনের অপপ্রচার’কে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আমরা কেউ চাই আর না-ই চাই, এটাই অপ্রিয় বাস্তবতা যে যুদ্ধাপরাধের প্রতিটি রায়ের পরে জামায়াত হরতাল ডেকে পার পেয়ে গেছে। আইন না থাকার কারণে তারা এটা পেরেছিল, আর আইন করলেই তারা হরতাল ডাকা বন্ধ করবে, বাস্তবতা সেটা নির্দেশ করে কি? বিচার কার্যক্রমকে প্রশ্নবিদ্ধ করার বিষয়টিকে কে, কখন, কীভাবে ব্যাখ্যা করেন, সেটাও একটা প্রশ্ন। বিগত সংসদের করা আদালত অবমাননা আইন রায়ের বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনার অধিকার স্বীকার করেছে। তদন্ত বা প্রসিকিউশন টিমের কোনো অদক্ষতার সমালোচনা প্রধান বিচারপতি যেটা করেছেন, তা করা যাবে কি যাবে না?
প্রস্তাবিত আইনে মূল অপরাধ সংঘটনকারীর বিষয়ে এতখানি অস্পষ্টতা রাখার পরে ৬(১) ধারায় আরও উদ্বেগজনক
বিধান করা হয়েছে, যা আমাদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা নির্বিচারে অপপ্রয়োগ করলে তাদের থামানো কঠিন হবে। আমরা উদ্বিগ্ন এটা ভেবে যে মূল অপরাধ না ঘটালেও কেউ একই শাস্তি পেতে পারেন। বলা হয়েছে, ‘কাহাকেও প্ররোচনা দিলে বা কোনোরূপ সাহায্য করিলে বা কাহারও সহিত ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হইলে, অথবা এতদুদ্দেশ্যে কোনো উদ্যোগ বা প্রচেষ্টা গ্রহণ করিলে, ওই ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট অপরাধের জন্য ধার্যকৃত দণ্ডের সমপরিমাণ দণ্ডে দণ্ডিত হইবে।’ তার মানে পুলিশ কেবল ‘প্রমাণ’ করবে যে কেউ ‘এতদুদ্দেশ্যে কোনো উদ্যোগ বা প্রচেষ্টা’ গ্রহণ করেছেন, তাহলে তাঁকেও ওই শাস্তি পেতে হবে। সব থেকে উদ্বেগের বিষয় হলো, মামলা দায়েরে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। যে দেশে বিচার বড় নয়, মামলা দায়ের, জামিন ও রিমান্ডই মূল আকর্ষণ, সেখানে সর্বোচ্চ সাবধানতা মামলা দায়েরেই নিশ্চিত করতে হবে।
অপরাধের ধরন যখন রাষ্ট্রদ্রোহমূলক, তখন সরকারের পূর্বানুমোদন রাখতে হবে। পুলিশ ও ক্ষুব্ধ নেতা–কর্মীদের আরও ক্ষমতায়ন ভয়াবহ হতে পারে। প্রস্তাব করা হয়েছে, পুলিশ বা অন্য কেউ (অপরাধের প্রস্তুতি গ্রহণেরও) অডিও ভিডিও বা ইন্টারনেট-ভিত্তিক যেকোনো দলিল, আলোচনার টেপরেকর্ড বা ডিস্ক হাজির করলে তা আদালতে সাক্ষ্য হিসেবে চলবে, এই বিধান তাই সামাজিক মিডিয়ায় ভিন্নমত চর্চার জন্য বিরাট হুমকি।
মহান স্বাধীনতার ইতিহাসের বিকৃতি হোক, তা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। কিন্তু এ ধরনের কোনো আইন দিয়ে তা ঠেকানোর ধারণাও বাস্তবসম্মত নয়। কারণ, এ ধরনের একটি আইন করতে হলে তার আগে সঠিক ও শুদ্ধ ইতিহাস কী, সেটি ঠিক করার প্রশ্ন উঠবে! ডেইলি স্টার–এ নাইম মোহাইমেন একটি নিবন্ধে শর্মিলা বোসের বইসহ বিপুলসংখ্যক প্রকাশনার একটি তালিকা গ্রন্থিত করেছেন, যা বিভিন্ন সময়ে নানা আলোচনা ও বিতর্ক তৈরি করেছে। সুতরাং প্রস্তাবিত খসড়াকে আইনে পরিণত করতে হলে ‘ক্ষতিকর ও বিকৃত ইতিহাস’ বিষয়টি আসলে কী, তা চিহ্নিত করতে হবে। যা কার্যত অবাস্তব একটি ধারণা। সবচেয়ে বড় কথা, এভাবে কি সঠিক ইতিহাস লেখা বা রক্ষা করা যায়?
এটা পরিষ্কার যে, এই আইন কার্যকর হলে তা হবে শাসন–অনুপযোগী একটি আইন। তাই বলি, দিন যতই যাচ্ছে ততই ‘রুল অব ল’ এই ভূখণ্ডে উচ্চারণ করা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ছে। এটা ভীষণ গোলমেলে ব্যাপার হয়ে যাচ্ছে। অবশ্য কোনো একটা অপরাধ বা ঘটনা ঘটামাত্রই এত সব নির্দেশ ও তদন্ত কমিটি হচ্ছে, যা প্রমাণ রাখছে যে আইনের শাসন চলছে না। আগে আইনের অপব্যবহার নিয়ে আমরা বড় উদ্বিগ্ন থাকতাম। এখন তার থেকে অবস্থা আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। কারণ, কতিপয় ক্ষেত্রে খোদ আইনটাই হচ্ছে এমনভাবে, যা ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে প্রয়োগ করার সুযোগ নেই।
আগামীকাল শেষ পর্ব: গণহত্যা ও ইতিহাস এক বিষয় নয়।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
[email protected]

আরও পড়ুন: