ফানুস বন্ধ, বেলুনের কী হবে?

ফানুস ওড়ানো বন্ধের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ। ফানুস ওড়ানো যে আমাদের বৌদ্ধধর্মের বন্ধুদের বিশেষ ধর্মীয় উদ্যাপনের অনুষঙ্গ, সেটা নিশ্চয়ই বাহিনীর কর্মকর্তাদের মালুম ছিল না। আমরা আশা করব, ভবিষ্যতে এই নির্দেশ আমল করার সময় বাহিনী তাদের হুকুমনামায় ব্যতিক্রমের ব্যবস্থা রাখবে, না হলে ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’-এই বচন কানে বেসুরো ঠেকবে। ৬ জানুয়ারি একটি সুসংগঠিত ছাত্রসংগঠনের ৭০ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে আনন্দের বাতাসে ভরা বেলুন বাসে করে নিয়ে যাওয়ার সময় ঢাকার ফার্মগেটের কাছে বিস্ফোরিত হলে কমপক্ষে ১০ জন ছাত্র ও নেতার শরীর ঝলসে যায়। কোনো কোনো পত্রিকা এটাকে পুড়ে যাওয়া বলছে। নিশ্চয়ই ঝলসে যাওয়া ও পুড়ে যাওয়ার মধ্যে ব্যাকরণগত পার্থক্য আছে। চিকিৎসকেরা নিশ্চয়ই চিকিৎসার দৃষ্টিকোণ থেকে এই দুটি আলাদা করবেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটের সমন্বয়ক ডা. সামন্তলাল সেন বলেছেন, আহত ব্যক্তিদের শরীরের ৩ থেকে ৬ শতাংশ পুড়ে গেছে।

গ্যাস বেলুনসহ দুটি বাস নিয়ে যাওয়ার দায়িত্বে থাকা নেতারা বলেছিলেন, তাঁদের ধারণা, এই অনুষ্ঠান পণ্ড করার দুরভিসন্ধি নিয়ে কেউ ককটেল ছুড়ে থাকবে, তাই এই বিস্ফোরণ। সোজা কথা, তিনি এটাকে নাশকতা বলে চালিয়ে দিতে চেয়েছেন। পুলিশ এই কথার সঙ্গে একমত হয়নি। তাদের ধারণা, গাড়ির মধ্যে কেউ সিগারেট ধরিয়ে থাকবে। আর তা থেকেই এই বিস্ফোরণ। বাংলাদেশে বেলুন বিস্ফোরণে একসঙ্গে এত মানুষের দগ্ধ হওয়ার ঘটনা এর আগে তেমন একটা শোনা যায়নি। গ্যাস বেলুন ফোলানোর সময় সিলিন্ডার বিস্ফোরণের কথা শোনা গেছে। একসময় ঘন ঘন গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের খবর আসত, মৃত্যুও হতো, আহত হতো অনেকে। একসময় আইন করে যত্রতত্র বেলুন ফোলানো নিষিদ্ধ করা হয়। তবে সীমিত আকারে এখনো ঢাকাসহ নানা নগরে গোপনে-প্রকাশ্যে ক্ষমতাবানদের মাসোহারা দিয়ে এগুলো চালু আছে। বেলুন ফোলাতে এখন বেশি পয়সা দিতে হয়, এই যা।

গত ফেব্রুয়ারিতে (৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭) এ রকম এক সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ঢাকার যাত্রাবাড়ী এলাকায় এক মেসবাড়িতে দুজন ঘটনাস্থলে নিহত হন, পরে হাসপাতালে আরও দুজন মারা যান এবং তিনজন স্থায়ীভাবে পঙ্গু হন। যাঁরা যাত্রাবাড়ী, চানখাঁরপুল ও শাহবাগে গোপনে বা প্রকাশ্যে বেলুন ফোলানোর কারখানায় গিয়ে বেলুন ফুলিয়ে বাড়িতে নিয়ে এসে উদ্যাপনের হ্যাপা সামলাতে রাজি নন, আর যাঁদের পয়সা আছে, তাঁরা বেলুন ফোলানোওয়ালাদের বাড়িতে ডেকে নিয়ে কাজ সারেন-যেমন বিয়েবাড়িতে থাকেন খোদ ফুচকাওয়ালা বা কুলফি মালাইওয়ালা।

পাঠকের হয়তো মনে আছে, বছরখানেক আগে ২ অক্টোবর ২০১৬-তে বনানীর এ রকম এক বাড়িতে বেলুন ফোলাতে গিয়ে নিহত হন নেত্রকোনার কলমাকান্দা থেকে আসা গরিব বেলুনওয়ালা লাল মিয়া। তিনি থাকতেন উত্তর বাড্ডার সাঁতারকুল এলাকায়, সেখানেই তিনি বেলুন বিক্রি করতেন। বনানীর মালিকেরা তাঁকে সিলিন্ডারসহ সেখান থেকে নিয়ে এসেছিলেন। এখন প্রশ্ন, সিলিন্ডার কেন বিস্ফোরিত হয় আর মানুষ কেন মরে-এখন আবার বেলুন ফুটে মানুষ দগ্ধও হচ্ছে। কারণ না খুঁজে বা সাবধান না হয়ে মন্ত্রীরা সান্ত্বনার মলম লাগিয়েছেন। এর আগে ২০০৫ সালের জুন মাসে দিল্লিতে এ রকম বিস্ফোরণ ঘটেছে। সেই ঘটনায় প্রায় ২০টি শিশু পুড়ে যায়। তাদের রাম মনোহরŚহিয়া হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তখন যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিশু অধিকার সংগঠন সেভ দ্য চিলড্রেন শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে এক মোমবাতি মিছিলের আয়োজন করেছিল। শিশুদের হাতে ছিল জ্বলন্ত মোমবাতি আর গ্যাস বেলুন। ক্লান্ত শিশুদের হাতের মোমবাতি বেলুনের কাছাকাছি চলে এলে বেলুন বিস্ফোরিত হয়ে আগুনের হলকা সৃষ্টি হয় এবং তাতে পুড়ে যায় ২০টি শিশু। আমাদের ফার্মগেটের বেলুন বিস্ফোরিত হয় নেতাদের সিগারেটের আগুনে। দিল্লি পুলিশ অবহেলা আর পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা না নেওয়ার জন্য আয়োজক সংস্থার বিরুদ্ধে মামলা করে। পরে তাদের জামিন হলেও পুলিশ ঠিক কাজটিই করেছিল। এতগুলো শিশুকে ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দেওয়া অবহেলাজনিত অপরাধ তো বটেই। কথা হলো, আপাত-নিরীহ গ্যাস বেলুন যে কী বিপদ ডেকে আনতে পারে, তা আগেভাগেই চিন্তা করা উচিত। যাঁরা তা করতে পারেন না, তাঁরা নেতা হওয়ার বা অফিস চালানোর অধিকার রাখেন কি? ওই ঘটনার পর ভারতজুড়ে গ্যাস বেলুন নিয়ে একরকম সচেতনতা আর সতর্কীকরণের কাজ জোরেশোরে শুরু হয়। বেলুনে হাইড্রোজেনের বদলে হিলিয়াম ব্যবহারে উৎসাহিত করা হয়। জানানো হয়, হিলিয়াম কেন এবং কতটা নিরাপদ আর হাইড্রোজেন কেন এড়িয়ে চলা উচিত।

মানুষ সতর্ক হলেও দুর্ঘটনা একেবারে কমেনি। হাইড্রোজেনে বিস্ফোরক উপাদান থাকা সত্ত্বেও যেহেতু এটা হিলিয়ামের চেয়েও সস্তা এবং সহজে পাওয়া বা তৈরি করা যায়, তাই হাইড্রোজেনের প্রতি ঝোঁকটাও বেশি। হাইড্রোজেন গ্যাসে ভরা বেলুন হিলিয়ামের বেলুনের চেয়ে দ্রুত আকাশে ওড়ে কিন্তু এক ঘণ্টার বেশি টেকে না, অন্যদিকে হিলিয়ামের বেলুন থাকে চার-পাঁচ ঘণ্টা। তবে হাতছাড়া বেলুন এক ঘণ্টা থাকলেও যা, পাঁচ ঘণ্টা থাকলেও তা। তাই মানুষ সস্তা জিনিসই খোঁজে। একটা ৭ কিউবেক মিটার সিলিন্ডারে হিলিয়াম ভরতে ১২ হাজার রুপি আর একই ধারণক্ষমতার সিলিন্ডারে মাত্র ১ হাজার ৩০০ রুপিতে হাইড্রোজেন ভরা সম্ভব-বাংলাদেশে খরচের তফাতটা একই রকম-হাইড্রোজেন হিলিয়ামের চেয়ে ১২-১৩ গুণ সস্তা। এই দেশে সবই গোপন, তাই সঠিক মূল্যটা জানা সম্ভব হয়নি। ঝুঁকি নেই, দাম বেশি আর ঝুঁকি অনেক, দাম কম-এই দুইয়ের মধ্যে মানুষ দ্বিতীয়টাই বেছে নিয়েছে। আমাদের সাবধান হতে হবে। হাইড্রোজেন গ্যাসে ভরা বেলুনের কাছে কোনোভাবেই আগুন, সিগারেট, বিজলিবাতি, বিদ্যুতের তার-এগুলো রাখা যাবে না। ঘরের ভেতরে কোনো অনুষ্ঠানে হাইড্রোজেন গ্যাসের বেলুন ব্যবহার একদম অনুচিত।

গওহার নঈম ওয়ারা: ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মী। শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।