ফিলিস্তিন হারেনি

ইসরায়েলি হামলায় বিধ্বস্ত ফিলিস্তিনিদের একটি ভবন

পশ্চিম এশিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র ইসরায়েল। সংখ্যায় মিসর বা তুরস্কের সমান না হলেও ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ, যন্ত্রপাতি, প্রযুক্তি ও পারমাণবিক অস্ত্রের জোর অনেক বেশি। সীমান্তের ভেতর ও অধিকৃত ফিলিস্তিন—দুই জায়গাতেই জনতাকে নিয়ন্ত্রণে এরা সমান পারদর্শী।

প্রচলিত অর্থে অধিকৃত না হলেও ২০ লাখ মানুষের খুদে ভূমি গাজার সব সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ করে ইসরায়েল। এর কোনো বন্দর নেই, বিমানবন্দর যা ছিল তা–ও বিধ্বস্ত। এর ভূমধ্যসাগর উপকূল সার্বক্ষণিক ইসরায়েলি পাহারার অধীন। গাজা কার্যত এক ছাদখোলা কারাগার।

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু সর্বদাই বলে আসছেন, তাঁর দেশ নিরাপদ। ফিলিস্তিনিদের ভয় পাওয়ার কোনো কারণই নেই। পশ্চিম তীর, বিশেষ করে পূর্ব জেরুজালেমে ইসরায়েলি বসতি স্থাপন চালিয়ে যাওয়াতেও বাধা নেই। আর মূল উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে তাদের সম্পর্কও বেশ ভালো। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ‘ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারের’ কথা বলে যাচ্ছেন। এত কিছুর পর ইসরায়েলের তো নিরাপদ বোধ করা উচিত। কিন্তু কার্যত তারা নিরাপদ বোধ করছে না। যুদ্ধে হয়তো ইসরায়েলকে হারানো সম্ভব নয়, কিন্তু তার নিরাপত্তাহীনতার বোধও বিদায় হবে না। সাম্প্রতিক সহিংসতার মধ্যেও তা স্পষ্ট।

গাজা নিয়ে ইসরায়েলের সমস্যা হলো, স্থল বাহিনীর অভিযান ছাড়া গাজা থেকে রকেট নিক্ষেপ বন্ধ করতে পারে না ইসরায়েল। শেষ ২০১৪ সালে গাজায় সৈন্য পাঠায় তারা। সেখানে তারা সুপ্রশিক্ষিত আধা সামরিক বাহিনীর মুখোমুখি হয়, শহুরে গেরিলাযুদ্ধে যারা দক্ষ। ৬৮ সৈন্য হারায় ইসরায়েল, আহত হন কয়েক শ, অনেকে চিরতরে পঙ্গু হয়ে যান। কিন্তু যখন যুদ্ধবিরতি ঘোষিত হলো, তখনো হামাসের হাতে মজুত তিন হাজার রকেট। এবারের যুদ্ধবিরতির পরও হামাস জোরদারই থাকছে। একে তারা আনন্দদায়ক বিজয় বলে ঘোষণা করেছে।

ইসরায়েলের সামরিক নেতারা মনে করেন, তাঁদের বাহিনী স্থলাভিযানের জন্য বেশি প্রস্তুত। ২০০৮ সালের ধাক্কার পরও ২০১৪ সালে তাদের ঠেকে শিখতে হলো। ২০২১ সালে তাই স্থলাভিযান ছাড়াই যুদ্ধবিরতি মেনে নিল ইসরায়েল।

গত কয়েক মাসে নেতানিয়াহু ইসরায়েলিদের পঁইপঁই করে বুঝিয়েছেন, ফিলিস্তিন পরাজিত হয়েছে, ইসরায়েলি ইহুদিদের নিরাপদ বোধ করা উচিত। এ বয়ানকে শক্তিশালী করেছে নব্বই দশকে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে আসা প্রায় ১০ লাখ ইহুদি। নতুন দেশে নিরাপদ থাকতে তারা বদ্ধপরিকর। স্বাধীন ফিলিস্তিনের স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গেছে এবং এটাই স্বাভাবিক—এমন একটা ধারণা যুক্তরাষ্ট্রের লাখো খ্রিষ্টান জায়নবাদীও প্রচার করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের উঠতি রাজনীতিবিদদের ওপর জায়নবাদীদের প্রভাবও ব্যাপক।

কিন্তু দেখা গেল, রাজনৈতিক জীবন বাঁচাতে নেতানিয়াহুকে সংগ্রাম করতে হচ্ছে। চলতি ঘটনা তাঁকে লাভবান করলেও তাঁর জোটসঙ্গীরা এর রাজনৈতিক অভিঘাত নিয়ে ভীত ও চিন্তিত। ইসরায়েলে মারাত্মক নৈরাজ্যই শুধু দেখা যায়নি, আরব ইসরায়েলিদের ক্ষমতাও বৃদ্ধি পেয়েছে।

দ্বিতীয়ত, আল–আকসা মসজিদে অনুপ্রবেশ ও মুসল্লিদের নির্যাতন ইন্দোনেশিয়া থেকে মরক্কো অবধি মুসলিম দুনিয়ায় ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে। পশ্চিম এশিয়ার স্বৈরাচারী শাসকেরা ইসরায়েলের সঙ্গে চুক্তি করলেও ফিলিস্তিনের প্রতি জনগণের সমর্থন অনেক বেশি দেখা গেছে।

চূড়ান্ত ব্যাপারটি নিয়ে সাধারণত আলোচনা হয় না। ইসরায়েলি সরকার সরাসরি গাজা দখল করতে চায় না। সাম্প্রতিক যুদ্ধেও তাদের চেষ্টা ছিল স্থল সেনা দিয়ে নয়, কীভাবে বিমান, সশস্ত্র ড্রোন ও গোলন্দাজ হামলার অভিঘাত সবচেয়ে বেশি করা যায়। এটা তারা ২০১৪ সালের ব্যর্থতা থেকে শিখেছে।

নির্মম বাস্তবতা হলো সারা দুনিয়ার সমরাস্ত্র প্রকৌশলী, নিরাপত্তা কৌশলী ও করপোরেশন এটা দেখছে এবং শিখছে। বিশ্বব্যাপী দূরনিয়ন্ত্রিত যুদ্ধের এটা অংশ। এ দৃষ্টিকোণ থেকে এত মৃত্যু ও ধ্বংস সত্ত্বেও যুদ্ধকৌশলের পরীক্ষাগার হওয়ার চেয়েও বেশি কিছু অর্জন করেছে গাজা।

ইংরেজি থেকে অনূদিত, দ্য কনভার্সেশন থেকে নেওয়া

পল রজার্স ব্র্যাডফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি অধ্যয়নের অধ্যাপক