ফেরেশতার খোঁজ করছি

নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি: সাংসদ পদের জন্য ফেরেশতা। চমৎকার বেতন, মন্ত্রী হওয়ার সুযোগ, পাঁচ বছর মেয়াদ। আবেদনকারীকে ‘সাদিক’ ও ‘আমিন’ অথবা সৎ ও ঋজু চরিত্রের হতে হবে।

চাহিদা হিসেবে এটাই শেষ, যার কারণে আমাদের অধিকাংশ মানুষই চুক্তি ছেড়ে বেরিয়ে যাবেন। যাঁরা জীবনে পাপ করেননি, তাঁরা হাত তুলুন। কী ব্যাপার, কেউ হাত তোলেনি? চালিয়ে যান, আমি দেখতে পাচ্ছি, অনেক বিচারক, জেনারেল, আমলা ও ব্যবসায়ী পেছন থেকে হাত তুলেছেন। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, আমাদের মাঝে বেশ কিছু সৎ ও ঋজু চরিত্রের মানুষ আছেন। তা না হলে এই বিশুদ্ধ ভূমিতে খুবই হতাশ হতাম।

আমি ফেরেশতার খোঁজ করছি, কারণ সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক রায়ে নওয়াজ শরিফকে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। এই রায়ে নিছক মানুষের পক্ষে সাংসদ হওয়ার পথে বড় প্রতিবন্ধকতা স্থাপন করা হয়েছে। মেনে নিলাম, আমার আশপাশে যাঁরা আছেন, তাঁরা সবাই পাপী, কিন্তু উচ্চ আদালত সাংসদ হওয়ার যে চাহিদা নিরূপণ করেছেন, তাতে আমার পরিচিত কেউই আর সাংসদ হতে পারবেন না। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম শুধু ইমরান খান। তাঁর সঙ্গে বেশ কয়েকবার আমার ক্ষণিকের জন্য দেখা হয়েছে। তবে তাঁর দুর্নীতিবিরোধী প্রবল আন্দোলন দেখে আমি নিশ্চিত, তিনি ‘সাদিক’ ও ‘আমিন’।

তো সুপ্রিম কোর্ট ঠিক করলেন, কারা জনগণের প্রতিনিধি হবেন। এবার দেখা যাবে অনেক এমএনএই অভিযোগ করতে শুরু করেছেন, তাঁর প্রতিপক্ষ পাকিস্তানের সংবিধানের উচ্চ আদর্শ ৬২ নম্বর ধারা মেনে চলছেন না, যে ধারার বলে নওয়াজ শরিফকে সরানো হলো। সম্ভবত, আমরা দেখব বিশেষ বেঞ্চ গঠন করে এসব মামলার শুনানি হচ্ছে।

পাঠক, আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমি বহুকাল আগেই এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হয়েছি যে শরিফ পরিবার স্বার্থের সংঘাত ধারণাটির ব্যাপারে পরিষ্কার নয়। নওয়াজ শরিফ দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার কারণে তাঁদের পরিবারের শানশওকত বহুগুণে বেড়েছে। কিন্তু পৃথিবীতে তিনি শুধু একাই পরিবারের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেন না। সমাজে আমরা সন্তান ও পরিবারবর্গকে সহায়তা করতে প্রচলিত পথের বাইরে যাই, এমনকি যদি আইন বিকৃত বা ভঙ্গ করে হলেও। আমি বহু বড় ব্যবসায়ীকে জানি, যাঁরা সন্তানের যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও তাঁদের কোম্পানিতে বড় পদে বসান।

পাকিস্তানের সাবেক প্রধান বিচারপতি ইফতেখার চৌধুরী প্রভাব খাটিয়ে নিজের ছেলেকে পুলিশে ঢুকিয়েছিলেন, তখন কিন্তু খুব বেশি মানুষের ভ্রু কুঞ্চিত হয়নি। এরপর যখন সেই উদ্যোগী ছেলে রাতারাতি কোটি কোটি টাকা কামালেন, তখন অনেকের ভ্রু কুঁচকাল। কিন্তু আবারও তাঁর পিতা প্রভাব কাজে লাগিয়ে ছেলেটিকে বাঁচিয়ে দেন। আমি আরও উদাহরণ দিতে পারি, প্রত্যেক পাঠকই সে রকম উদাহরণ দিতে পারবেন।

পরিষ্কারভাবেই একজন অর্থলোভী প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে রেহাই পাওয়া ভালো ব্যাপার। তাঁর প্রস্থান নিয়ে আমার সমস্যা নেই, কিন্তু যে তরিকায় তাঁকে বিদায় করা হলো, সেটাই আমার সমস্যার কারণ। এই রায়ে কী ভুল আছে, তা নিয়ে আইন বিশেষজ্ঞরা অনেক কথা বলেছেন। আইনে আমার বিশেষজ্ঞ জ্ঞান নেই, তা সত্ত্বেও জেআইটি (জয়েন্ট ইনভেস্টিগেশন টিম) নওয়াজ শরিফের বিরুদ্ধে এত এত অভিযোগ আনা সত্ত্বেও স্রেফ ছোট একটি কলাকৌশলগত কারণে তাঁকে অযোগ্য ঘোষণা করায় আমি ধাক্কা খেয়েছি।

বস্তুত, পাকিস্তানের সম্মানিত বিচারকদের আয়কর আইনে ‘সম্পদের’ সংজ্ঞা পরিহার করে অভিধানের দ্বারস্থ হতে হবে। তাই এমএনএদের সম্পদের মধ্যে ভবিষ্যতে আদায়যোগ্য সম্পদ যোগ করতে হলেও কতজন নগদ অর্থের ভিত্তিতে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন? যদিও সাধারণভাবে এর ভিত্তিতেই ব্যক্তির সম্পদ নির্ধারণ করা হয়।

পাকিস্তান তেহরিক–ই–ইনসাফ দল টুইটারে ও ই-মেইলে আমাকে নওয়াজ শরিফের সমর্থক হিসেবে সমালোচনা শুরু করার আগে বলে রাখি, পেশাদার লেখক হিসেবে আমি শরিফের ব্যাপারেই সবচেয়ে বেশি সমালোচনামূলক নিবন্ধ লিখেছি, অন্য যেকোনো রাজনীতিকের চেয়ে। আমি ব্যক্তির চেয়ে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান নিয়েই বেশি চিন্তিত।

কয়েক মাস আগে আমি ইঙ্গিত দিয়েছিলাম, পানামাগেট মামলা শুরু করে সুপ্রিম কোর্ট অনেক খারাপের সূচনা ঘটাবেন। এবার তাঁরা শরিফ পরিবার ও তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যদের বিরুদ্ধে নিম্ন আদালতে চলমান মামলার কার্যক্রম নজরদারির চেষ্টা করছেন। তো অভিযুক্ত ব্যক্তিরা এই পরিস্থিতিতে কি ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করতে পারেন, যখন নিম্ন আদালত ইতিমধ্যে উচ্চ আদালতের মতামত সম্পর্কে অবগত?

যা হোক, আমি যত দূর বুঝি, তাঁরা নওয়াজ শরিফকে কারাগারে ঢুকিয়ে চাবিটা ফেলে দিতে পারেন। আর অধিকাংশ নিন্দুক বলবেন, এসব আইনি সূক্ষ্মতা পাত্তা দেওয়ার দরকার কী? কিন্তু আইনি প্রক্রিয়ার গুরুত্ব আছে, বিশেষভাবে যখন সেটা প্রণয়ন
করেন সুপ্রিম কোর্ট। আজ প্রায় ৪০ বছর পরও সেই ৫-৪-এ বিজয়ী রায়ের কথা আমাদের স্মরণ আছে, যার মাধ্যমে ভুট্টোকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝোলানো হয়েছিল। তো এই বিতর্কিত রায় কি ৪০ বছর পর একইভাবে স্মরিত হবে?

আমলা, জেনারেল ও বিচারকদের সঙ্গে পাকিস্তানের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীরা খাপ খাওয়াতে পারেননি। এর ফলে একজন প্রধানমন্ত্রীও স্বাধীনতার পর মেয়াদ পূরণ করতে পারেননি। কিন্তু নওয়াজ শরিফকে এই সন্দেহজনক কারণে এই তালিকায় যুক্ত করে সুপ্রিম কোর্ট এই ধারণার গোড়ায় আগুন দিলেন যে অনির্বাচিত ব্যক্তিরা জনরায় নিয়ে বিদ্রূপ করতে পারেন।

নিশ্চিতভাবেই নিজের ও আমাদের প্রতি উচ্চ বিচারালয়ের দায়িত্ব আছে, এই রায় তাঁদের পর্যালোচনা করা উচিত।    

পাকিস্তানি দৈনিক দ্য ডন থেকে নেওয়া, অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন

ইরফান হুসেন: পাকিস্তানি সাংবাদিক।