বঙ্গবন্ধু, ছয় দফা ও ৭ জুন

লাহোরে ছয় দফার ঘোষণা দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
লাহোরে ছয় দফার ঘোষণা দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

উনিশ শতকের আশির দশকে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পর থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত ৮৫ বছরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিভিন্ন সময় বহু দাবিনামা নিয়ে আন্দোলন করেছে। দাবিনামার অধিকাংশই ছিল ন্যায়সংগত ও জনসমর্থিত। কিন্তু দুটি দাবিনামা এই অঞ্চলের রাজনৈতিক জীবনে এনে দিয়েছে আমূল পরিবর্তন। পাল্টে দিয়েছে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ভূগোল। প্রথমটি হলো ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত প্রস্তাব, যার মুখ্য রচয়িতা মুহম্মদ আলী জিন্নাহ হলেও উত্থাপক ছিলেন শেরেবাংলা ফজলুল হক। সে প্রস্তাবের মূল দাবি ছিল—ভারতের উত্তর-পশ্চিম এবং পূর্বাঞ্চলে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলে স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। লাহোর প্রস্তাবে একটি রাষ্ট্রের কথা বলা হয়নি, বলা হয়েছিল States—একাধিক রাষ্ট্র। অর্থাৎ, পশ্চিমে পাঞ্জাব-সিন্ধু প্রভৃতি নিয়ে হবে একটি রাষ্ট্র এবং এদিকে বাংলা ভাষাভাষী এলাকায় আর একটি রাষ্ট্র। দ্বিতীয় দাবিনামাটি হলো ১৯৬৬-র ফেব্রুয়ারিতে উত্থাপিত বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা। ছয় দফা ও এর সমর্থনে আওয়ামী লীগের ডাকা ’৬৬-র ৭ জুন হরতালের দিন পুলিশের গুলিতে বহু হতাহতের ঘটনার আজ ৫০তম বার্ষিকী।
১৯৬৫-র সেপ্টেম্বরে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পরে পাকিস্তানের পরিস্থিতি ছিল সংকটাপন্ন। ১৯৬৬-র ফেব্রুয়ারিতে লাহোরে আহূত বিরোধীদলীয় সভায় শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের ১০ সদস্যের প্রতিনিধিদল যোগ দেয়। পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র নিয়ে সেখানে বিভিন্ন দলের নেতারা আলোচনা করেন। আওয়ামী লীগ আগাগোড়া ফেডারেল পদ্ধতির সংসদীয় সরকার এবং আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি জানিয়ে এসেছে। ১০ ফেব্রুয়ারি সাবজেক্ট কমিটির বৈঠক ছিল। সেখানে শেখ মুজিব একটি ছয় দফা দাবিনামা পেশ করেন। ওই দাবিনামা তখনো আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির কোনো সভায় গৃহীত সুপারিশ নয়। ওই দাবি উত্থাপনের পর পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এবং তাদের পূর্ব বাংলার তাঁবেদাররা তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠেন। তাঁরা মুহূর্ত দেরি না করে শেখ মুজিবকে কঠোর ভাষায় সমালোচনা করতে থাকেন। তাঁদের মোদ্দা কথা, শেখ মুজিব পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্র করছেন।

ছয় দফা প্রস্তাবে ছিল: ১. শাসনতান্ত্রিক গ্যারান্টির আওতায় পাকিস্তানের ফেডারেল রাষ্ট্র কাঠামোর প্রতিষ্ঠা, যার ভিত্তি হবে ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব, সরকার হবে পার্লামেন্টারি পদ্ধতির, থাকবে সর্বজনীন ভোটাধিকার ও সার্বভৌম আইন পরিষদ; ২. ফেডারেল সরকারের হাতে থাকবে প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র বিষয়, অবশিষ্ট বিষয়গুলো ফেডারেশনের ইউনিটগুলোর হাতে থাকবে; ৩. দুটি পরস্পর বিনিয়োগযোগ্য মুদ্রা বা পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক ব্যাংকিং ব্যবস্থাসহ একটি মুদ্রাব্যবস্থা। আর থাকবে পূর্ব থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে মূলধন প্রবাহ রোধের শাসনতান্ত্রিক বিধান প্রভৃতি।

ছয় দফা দাবির তীব্র সমালোচনা শুধু যে সরকারি দল করছিল তা নয়, বিরোধী দল থেকেও বিরূপ সমালোচনা হয়। অনেকে বলাবলি করেন, এটি সিআইএর তৈরি। তাদের যুক্তি আইয়ুব সরকার সেপ্টেম্বরের যুদ্ধের সময় তাঁর বন্ধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে পর্যাপ্ত সাহায্য ও সমর্থন পায়নি। তা ছাড়া কিছুকাল থেকে আইয়ুব খান ভিয়েতনামে মার্কিন নীতির সমালোচনা করার ঔদ্ধত্য দেখাচ্ছিলেন চীনকে খুশি করার জন্য। তাঁকে চাপে রাখতে শেখ মুজিবকে দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের ইস্যুটি সামনে আনা হয়। অন্য দল ছাড়াও আওয়ামী লীগের মধ্যেই ছয় দফা নিয়ে মতভেদ ছিল। দলের অনেক নেতারই ছয় দফায় সমর্থন ছিল না।

আওয়ামী লীগের পরামর্শদাতা ও দলের মুখপত্র ইত্তেফাক-এর সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন (মানিক মিয়া) তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন:

‘৬-দফার কোন কোন দফা আমি সমর্থন করি না সত্য, কিন্তু ৬-দফা ভাল কি মন্দ, সেই প্রশ্ন মুলতবী রাখিয়াও আমি বলিতে চাই যে, এই কর্মসূচী সাধারণ্যে প্রকাশ করিবার পূর্বে আমার সাথে কেহ কোন পরামর্শ করে নাই। [পাকিস্তানি রাজনীতির বিশ বছর, ঢাকা, ২০০৭]

দলের সাধারণ সম্পাদক হলেও শেখ মুজিব ছয় দফা পেশ করেন তাঁর ব্যক্তিগত সুপারিশ হিসেবে। কয়েক সপ্তাহ পরেই আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে তিনি দলের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং ছয় দফাকে অনুমোদন করিয়ে নেন। এখনকার মতো এত পত্রপত্রিকা তখন ছিল না। ফলে প্রচারপত্র, পুস্তিকা প্রভৃতির ওপর নির্ভর করতে হতো। আওয়ামী লীগের কাউন্সিলের আগে তাজউদ্দীন আহমদের নোট দেওয়া ছয় দফার একটি পুস্তিকা বের হয়। তার কিছুদিন পর দফাগুলোর ব্যাখ্যা দিয়ে শেখ মুজিব আর একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন।

প্রথম দফার হাহাকারের জবাবে বঙ্গবন্ধু লিখেছিলেন: ‘ইহাতে আপত্তির কি আছে? লাহোর প্রস্তাব পাকিস্তানের জনগণের নিকট কায়েদে আজমসহ সকল নেতার দেওয়া নির্বাচনী ওয়াদা। ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচন [পাকিস্তানের পক্ষে ম্যান্ডেট] এই প্রস্তাবের ভিত্তিতেই হইয়াছিল। মুসলিম বাংলার জনগণ এক বাক্যে পাকিস্তানের বাক্সে ভোটও দিয়াছিলেন এই প্রস্তাবের দরুনই। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব বাংলার মুসলিম আসনের শতকরা সাড়ে ৯৭টি যে একুশ দফার পক্ষে আসিয়াছিল, লাহোর-প্রস্তাবের ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনার দাবি ছিল তার অন্যতম প্রধান দাবি।...কাজেই আজ লাহোর প্রস্তাবভিত্তিক শাসনতন্ত্র রচনার দাবি করিয়া আমি কোনো নতুন দাবি তুলি নাই; পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের পুরান দাবিরই পুনরুল্লেখ করিয়াছি মাত্র। তথাপি লাহোর প্রস্তাবের নাম শুনিলেই যাঁরা আঁতকাইয়া উঠেন, তাঁরা হয় পাকিস্তান-সংগ্রামে শরিক ছিলেন না, অথবা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের দাবি-দাওয়ার বিরোধিতা ও কায়েমী স্বার্থীদের দালালী করিয়া পাকিস্তানের অনিষ্ট সাধন করিতে চান।’

দুই নম্বর দফা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন: ‘এই প্রস্তাবের দরুনই কায়েমী স্বার্থের দালালরা আমার উপর সর্বাপেক্ষা বেশী চটিয়াছেন। আমি নাকি পাকিস্তানকে দুই টুকরা করতঃ ধ্বংস করিবার প্রস্তাব দিয়াছি।...আমার প্রস্তাবে ফেডারেটিং ইউনিটকে “প্রদেশ” না বলিয়া “স্টেট” বলিয়াছি। ইহাতে কায়েমী স্বার্থী শোষকেরা জনগণকে এই বলিয়া ধোঁকা দিতে পারে এবং দিতেও শুরু করিয়াছে যে, “স্টেট” অর্থে আমি “ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্টেট” বা স্বাধীন রাষ্ট্র বুঝাইয়াছি। কিন্তু তা সত্য নয়। ফেডারেটিং ইউনিটকে দুনিয়ার সর্বত্র সব বড় বড় ফেডারেশনেই “প্রদেশ” বা “প্রভিন্স” না বলিয়া “স্টেট্স” বলা হইয়া থাকে। কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রকে ফেডারেশন অথবা ইউনিয়ন বলা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ফেডারেল জার্মেনী, এমনকি আমাদের প্রতিবেশী ভারত রাষ্ট্র সকলেই তাদের প্রদেশসমূহকে ‘স্টেট’ ও কেন্দ্রকে ইউনিয়ন বা ফেডারেশন বলিয়া থাকে।’

এই ব্যাখ্যাসংবলিত পুস্তিকাটি বঙ্গবন্ধু নিজের হাতে লিখেছিলেন, কাউকে ডিকটেশন দিয়ে লেখাননি, সে কথা আমি তাঁর কেবিনেটের খাদ্যমন্ত্রী আবদুল মোমিনের কাছে শুনেছি। পুস্তিকাটি সেকালে ব্যাপক প্রচারিত হয়েছে। আমিও আওয়ামী লীগ অফিস থেকেই সংগ্রহ করি। ছয় দফার জনপ্রিয়তার কারণে বঙ্গবন্ধুসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের ওপর নেমে আসে নির্যাতন। তাঁর জনসভাগুলোতে রাতারাতি জনসমাগম বাড়ে। মানিক মিয়া তাঁর ইত্তেফাকের ‘রাজনৈতিক মঞ্চে’ লিখেছিলেন: ‘৬-দফা প্রস্তাবের এই বিপুল জনপ্রিয়তার কারণ অবশ্য কোন ব্যক্তি এমনকি কোন দলবিশেষ নয়। আজ দেশবাসীর সম্মুখে যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক এবং আঞ্চলিক সমস্যা মাথাচাড়া দিয়া উঠিয়াছে, ৬-দফার সুনির্দিষ্ট প্রোগ্রামের মধ্যেই সেই বাঁচা-মরার সমস্যার সমাধানের পথ নিহিত রহিয়াছে, ইহাই সর্বশ্রেণীর জনগণের বিশ্বাস।’ [ইত্তেফাক, ২৭ মার্চ ১৯৬৬]

এ কালের মতো তখনো জনপ্রিয় বিরোধী দলে ভাঙন ধরানোর অপচেষ্টা হতো। আওয়ামী লীগ ও ন্যাপেও ভাঙন ধরানো হয়। ছয় দফা আন্দোলন দুর্বল করতে আওয়ামী লীগ ও ন্যাপকে বাদ দিয়ে গঠিত হয় পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট (পিডিএম)। আট দলীয় এই জোটে ছিল নূরুল আমীন, আতাউর রহমান খানদের জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট, খাজা খয়েরউদ্দিনদের কাউন্সিল মুসলিম লীগ, গোলাম আযমের জামায়াতে ইসলামী, নসরুল্লাহ খান, সালাম খানের পাকিস্তান আওয়ামী লীগ এবং মৌলবী ফরিদ আহমদের নেজামে ইসলাম পার্টি। ছয় দফার পাল্টা তারা একটি আট দফা দেয়। সেই দুর্দিনে আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আমেনা বেগমের ভূমিকা স্মরণীয়। তিনি পিডিএমের আট দফা প্রত্যাখ্যান করে ২৯ মে এক বিবৃতি দিয়ে ছয় দফার সমর্থনে ৭ জুন হরতাল পালনের আহ্বান জানান আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের। সরকার হরতাল প্রতিরোধে সর্বাত্মক বল প্রয়োগ করে। ৫০ বছর আগের এই দিনের ঢাকার দৃশ্য আজ আমারই বিশ্বাস হয় না। সে দিনের হরতালের সমর্থন শুধু আওয়ামী লীগের সমর্থকেরাই দেয়নি, শেখ মুজিবের ছয় দফাকে সমর্থন দিয়েছে দলমত-নির্বিশেষে সব শ্রেণির মানুষ।

মতলবি ইতিহাস বিকৃতি ছাড়াও অনেক সময় অনিচ্ছাকৃত ভুল তথ্য পরিবেশনের কারণে এবং তা ব্যাপক প্রচার পাওয়ায় ঐতিহাসিক ঘটনার তথ্য বিকৃত হয়ে যায়। কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের পাবলিকেশন অফিসার ও লেখক আবদুল হক তাঁর রোজনামচায় লিখেছিলেন ৭ জুনের দমন-পীড়ন সম্পর্কে মাওলানা ভাসানীর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। তাঁর ভাষায়, ‘কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, ন্যাপ সম্পূর্ণ নীরব। দুই-তিন দিন সেন্সরবিধি আরোপিত হওয়ার ফলে অবশ্য কারও কোনো সমালোচনা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়নি, কিন্তু তার আগে স্বায়ত্তশাসন দাবির বিরুদ্ধে যে দমননীতি ও ব্যাপক ধরপাকড় চলছিল ন্যাপ নেতৃবৃন্দ তারও সমালোচনা করেননি।’ ভাসানী ও তাঁর ন্যাপ সম্পর্কে এ–জাতীয় বক্তব্য আজও অনেকে অজ্ঞতাবশত সভা-সমাবেশে বলে বেড়ান। এই তথ্য সত্যের সম্পূর্ণ অপলাপ।

৮ জুনের পরের কয়েক দিন কোনো দলের ​পক্ষ থেকে কোনো বিবৃতি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি। ৭ জুন সম্পর্কে সংবাদ প্রকাশে সরকারের কড়া নিষেধাজ্ঞা ছিল। ৭ জুন মাওলানা ভাসানী ছিলেন জয়পুরহাটের আদিবাসী বুনা অধ্যুষিত এলাকায়। তিনিই যে শুধু হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানান তা-ই নয়, তাঁর দলের কেন্দ্রীয় নেতারাও ওই দিন বিকেলে দীর্ঘ বিবৃতি দেন। কোনো বিবৃতিই পত্রিকায় আসেনি। তার পরদিন ৮ জুন ন্যাপ নেতারা তাঁদের বিবৃতি একটি পুস্তিকা আকারে প্রকাশ করেন।

বিবৃতিতে ন্যাপের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল: ‘জালিমশাহীর গ‌ুলিতে আবার জনতার রক্ত ঝরিয়াছে। ৭ই জুন ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, তেজগাঁয় পুলিশের গুলিতে এ দেশের শান্তিকামী মানুষকে আবার জীবন বিসর্জন দিতে হইয়াছে। সরকারি হিসাব মতেই গুলিবর্ষণে নিহতের সংখ্যা এগার। অগণিত মানুষ আহত হইয়াছেন। ... উত্তাল গণ-আন্দোলনের মোকাবিলায় গণবিরোধী সরকার অস্ত্রের ভাষাকেই সম্বল করিয়াছে। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের উত্তাল জনসমুদ্রে উত্থিত “রাজবন্দীদের মুক্তি ও আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের” দাবির জওয়াব আসিয়াছে কামান-বন্দুকের ভাষায়—মৃত্যুর হিমশীতল ছোঁয়ায়।... খুনী জালিমের বিরুদ্ধে জনতার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনকে দুর্বার ও জোরদার করিয়া তোলাই প্রতিবাদের একমাত্র পথ।...সকল রাজনৈতিক দল, গণ-প্রতিষ্ঠান ও জনগণের প্রতি আবেদন জানাইতেছি:

(১) দেশের সর্বোচ্চ বিচার বিভাগ ও সত্যিকার গণপ্রতিনিধি সমন্বয়ে গঠিত তদন্ত কমিশন মারফত ৭ই জুনের গুলিবর্ষণ ও আনুপূর্বিক ঘটনার তদন্ত, দোষীদের আদর্শ শাস্তির ব্যবস্থা, নিহত-আহতদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দান। এই উপলক্ষে আটক ও সাজাপ্রাপ্ত সকলের মুক্তি, ১৪৪ ধারাসহ আরোপিত সকল বিধি-নিষেধ প্রত্যাহার। (২) সকল রাজবন্দীর মুক্তি, হুলিয়া প্রত্যাহার, জরুরী অবস্থা প্রত্যাহার করা, দমনমূলক সকল বিধি-নিষেধ বাতিল করা। (৩) পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন: দেশরক্ষা, পররাষ্ট্রনীতি ও মুদ্রা—মাত্র এই তিনটি ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে রাখিয়া বাকি সকল ক্ষমতা পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান আঞ্চলিক সরকারদ্বয়ের হাতে ন্যস্ত থাকিবে। (৪) ফেডারেল ও পার্লামেন্টারী শাসন ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা। ইত্যাদি...।’ [ন্যাপের প্রচারপত্র, ইস্ট পাকিস্তান প্রেস, ২৬৩ বংশাল রোড, ঢাকা, ৮ জুন ১৯৬৬]

ছয় দফা না দিলে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর দলের নেতাদের ওপর নির্যাতন নেমে আসত না। সরকার আগরতলা মামলাও হয়তো ফেঁদে বসত না। সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ম্যান্ডেটও ও রকম হতো না। তার পরের ইতিহাস সকলেরই জানা।

শ্রেণিবিভক্ত সমাজে শহীদেরও শ্রেণিচরিত্র থাকে। ৭ জুন যাঁরা স্বাধিকারের জন্য আত্মাহুতি দিয়েছিলেন, তাঁদের বংশধরেরা আজ কে কোথায় আছেন জানি না। রাষ্ট্রও জানে না। ছয় দফার প্রণেতা বঙ্গবন্ধু ও ৭ জুনের শহীদদের স্মৃতির প্রতি গভীরতম শ্রদ্ধা।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক